চিন্তা বাড়াচ্ছে করোনামুক্তদের আকস্মিক মৃত্যু

স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছে নতুন চিন্তার কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত হওয়া বা কভিড-১৯ নেগেটিভ হওয়ার পরপরই রোগীর মৃত্যু। 

সম্প্রতি এমন কয়েকটি মৃত্যুর খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কিছুটা বেড়েছে বলে জানা গেছে। 

এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুরুর দিকে করোনাভাইরাস হলে শুধু ফুসফুসে সমস্যা হতো বলেই ধারণা করে আসছিলেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু সম্প্রতি তারা গবেষণা করে নিশ্চিত হয়েছেন যে, শুধু ফুসফুসে নয় করোনাভাইরাসের ফলে বহু মানুষের অন্যান্য রিমোট অরগান যেমন- কিডনি, লিভার, হার্ট ও মস্তিষ্কে পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর এই ক্ষতি হচ্ছে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য।

চিকিৎসকরা মনে করেন, যেসব রোগী করোনাভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার পর অতিরিক্ত সমস্যায় ভোগেন, তারা করোনাভাইরাস থেকে সেরে ওঠার পর বাড়িতে ফিরলেও তাদের আরো কিছু দিন নিয়মিত ফলোআপে রাখা জরুরি। যদিও স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, রোগীকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়ার পর ফলোআপ করার মতো সক্ষমতা তাদের নেই।

গত ১০ সেপ্টেম্বর একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন ঢাকা ওয়াসার বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এ রশিদ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের ৬৭ বছর বয়সী সাবেক এই অধ্যাপক মৃত্যুর প্রায় দেড় মাস আগে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন বলে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান সংবাদমাধ্যমকে জানান। 

তাকসিম এ খান বলেন, ‘কভিড-১৯ শনাক্ত হওয়ার পর গত ১৬ জুলাই থেকে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের ভেন্টিলেশনে ছিলেন অধ্যাপক এম এ রশিদ। অবস্থা কিছুটা ভালো হলে ১ সেপ্টেম্বর তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। সর্বশেষ নমুনা পরীক্ষায় তার কভিড-১৯ নেগেটিভ এসেছিল; কিন্তু ৩ সেপ্টেম্বর তার অবস্থা আবার খারাপ হয়। এরপর আবারো তাকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। তিন-চার দিন ধরেই তার অবস্থা সংকটাপন্ন ছিল। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, কভিডের কারণে তার কিছু অরগান কর্মক্ষমতা হারায়।’

গত ৮ সেপ্টেম্বর বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সাবেক উপ-পরিচালক ডা. নির্মলেন্দু চৌধুরী (৫৯) মারা যান। তিনি করোনাভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার পর মৃত্যুর আগে করোনাভাইরাস নেগেটিভ রিপোর্ট এসেছিল। পরিবারের সূত্রে জানা গেছে, গত ২ আগস্ট বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য নমুনা দেন ডা. নির্মলেন্দু। ৩ আগস্ট পজিটিভ রিপোর্ট আসে। ৫ আগস্ট অসুস্থতা বেড়ে গেলে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেয়া হয়। ১৩ দিন পর তার করোনাভাইরাস নেগেটিভ রিপোর্ট আসে; কিন্তু ফুসফুসের সমস্যা থাকায় ১৮ আগস্ট ঢাকার আসগর আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে ২২ আগস্ট তাকে লাইফ সাপোর্ট দেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮ সেপ্টেম্বর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

গত ২ সেপ্টেম্বর করোনাভাইরাস ‘নেগেটিভ’ রিপোর্ট পাওয়ার ২৭দিন পর সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্মসচিব খলিলুর রহমান (৬৮) মারা যান। গত ২৭ জুলাই তিনি করোনাভাইরাস পজিটিভ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। গত ৫ আগস্ট তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। ওই হাসপাতালের পরীক্ষায় ৬ আগস্ট তার নেগেটিভ রিপোর্ট আসে।

গত ৩ জুলাই সাবেক মন্ত্রী ও শরীয়তপুর জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এ টি এম গিয়াস উদ্দিন মারা যান। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শ্যামা ওবায়েদ জানান, গিয়াস উদ্দিন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন; কিন্তু মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে পরীক্ষায় করোনাভাইরাস নেগেটিভ আসে। গত ১০ জুলাই করোনাভাইরাস থেকে সেরে উঠে নেগেটিভ রিপোর্ট আসার একদিন পর নিজ বাড়িতে মারা যান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মোগড়া গ্রামের ব্যবসায়ী তাপস সাহা।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র হাবিবুর রহমান বলেন, ‘করোনাভাইরাস রিপোর্ট নেগেটিভ আসা ব্যক্তিদের মৃত্যুর কোনো পরিসংখ্যান অধিদফতরের কাছে নেই এবং এই মুহূর্তে এই বিষয়টি নিয়ে অধিদফতর কোনো কাজ করছে না।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘যেহেতু বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে, তাই খুব দ্রুতই এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করা হবে। যদিও করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা নিয়েই অধিদফতর বেশি ব্যস্ত, তবুও পৃথিবীর অন্যান্য দেশ এই বিষয়টিকে কিভাবে মোকাবেলা করেছে সেই খোঁজ খবর নিয়ে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।’

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, ‘এই বিষয়টি নিয়ে ডাক্তারদের বা ক্লিনিক্যাল স্টেজ থেকে কাজ করা সহজ। তবে কোনো গবেষণা বা করণীয় থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করবে আইইডিসিআর।’

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারকে অবশ্যই এই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে করোনাভাইরাস থেকে সেরে ওঠা রোগীদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘বিশেষ করে যেসব রোগী অতি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে থেকেছেন তাদের হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়ার পরও যাতে নিয়মিত যোগাযোগের মধ্যে রাখা যায়, তার একটা সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’

ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল (ডিসিএইচ) ট্রাস্ট ও কমিউনিটি ইনিশিয়েটিভ সোসাইটির (সিআইএস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী কামরুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশে রোগীর ফলোআপ করার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি এখনো গড়ে ওঠেনি। সরকারকে এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়ে একটি স্বচ্ছ জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তিরা নেগেটিভ রিপোর্ট আসা মানেই ধরে নেন তিনি সুস্থ হয়ে গেছেন- এই ধারণাটি সঠিক নয়। নেগেটিভ রিপোর্ট শুধু এটা প্রমাণ করে যে, তার শরীরে জীবন্ত ভাইরাস নেই। এর মাধ্যমে মোটেও নিশ্চিত হওয়ার কারণ নেই যে, রোগ সেরে গেছে! কারণ ভাইরাসটি অনেক অঙ্গের দীর্ঘ মেয়াদেও ক্ষতি করে থাকতে পারে। তাই করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের খুব সহজেই স্বস্তিতে ভোগার কারণ নেই।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //