করোনাভাইরাস: ভ্যাকসিন শঙ্কায় বাংলাদেশ

করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন পাওয়ার দ্বারপ্রান্তে বিশ্ব। বাংলাদেশও ভ্যাকসিন পাবে। তবে এ নিয়ে কিছুটা শঙ্কাও তৈরি হয়েছে এই বলে যে, দেশের মানুষ সঠিক সময়ে ভ্যাকসিন পাবে কি না। এ শঙ্কা অবশ্য সরকার গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিই ব্যক্ত করেছে তাদের সভায়। 

তবে এটা ঠিক যে, বাংলাদেশ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন পাবে। সরকার কোনো ধরনের ব্যবস্থা না নিলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমেই ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই বিশ্ববাসী করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন পেতে শুরু করবে। বাংলাদেশের আমজনতা হয়তো পেতে পারে কিছুটা দেরিতে।

জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির শঙ্কা

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কিছুদিন পর বিশিষ্ট চিকিৎসকদের সমন্বয়ে সরকার জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি গঠন করেছে, যেন তারা সরকারকে করোনাভাইরাস বিষয়ক কারিগরিসহ সব ধরনের পরামর্শ দিতে পারেন। এই পরামর্শক কমিটির সদস্যরা কেউ সরকারি চাকরি করছেন, কেউ অবসরে গেছেন। তাদের সবাই নিজে নিজ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ। তাদের মধ্যে কেউই সরকারি দলের বাইরের নন। 

এই কারিগরি পরামর্শক কমিটিই বাংলাদেশের মানুষের জন্য ভ্যাকসিন সংগ্রহ, ভ্যাকসিন সংরক্ষণ ও মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া নিয়ে কিছুটা হতাশা ব্যক্ত করেছেন। গত ১৭ সেপ্টেম্বর কমিটির চেয়ারপারসন অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ১৯তম বৈঠকে ভ্যাকসিন বিষয়ক বিশেষ কিছু মতামত প্রদান করা হয়। 

ওই বৈঠকে বলা হয়, বিশ্বের অনেক দেশ করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন সংগ্রহ নিয়ে এক ধরনের প্রতিযোগিতা করছে। কোনো কোনো দেশ ভ্যাকসিনের জন্য শুরু থেকেই প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করেছে এবং গবেষণা করতে সব ধরনের সহযোগিতা করেছে। কয়েকটি দেশ ভ্যাকসিন কেনার জন্য উৎপাদনকারী কোম্পানির কাছে অগ্রিম টাকাও জমা দিয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশ এ ব্যাপারে শুধু যোগাযোগ করা ছাড়া দৃশ্যমান আর কিছু করেনি। জাতীয় 

পরামর্শক কমিটি প্রকারান্তরে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর ভ্যাকসিন সংগ্রহে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর কাছে অগ্রিম টাকা জমা দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে; কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার কী করেছে তা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেনি। 

তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক এ বি এম খুরশীদ আলম বলেছেন, ‘ভ্যাকসিন সংগ্রহে বাংলাদেশ সম্ভাব্য সব ধরনের চেষ্টাই করছে, কারও থেকে আমরা পিছিয়ে নেই।’ 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘যারাই আগে অর্থ জমা দেবে ভ্যাকসিন সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় সে দেশগুলোই আগে ভ্যাকসিন পাবে। নিজের দেশের মানুষকে নিরাপদ রাখতে হলে ভ্যাকসিন সংগ্রহে অগ্রিম বুকিং দেয়া ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই।’

ভ্যাকসিন সংগ্রহে ভ্যাকসিন এলায়েন্স

আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু হলে অনেক দেশ ওই মাসের মধ্যেই তা পেয়ে যাবে। সরকার বলছে, তারা চেষ্টা করছে যত দ্রুত সম্ভব ভ্যাকসিন নিয়ে আসতে; কিন্তু সরকারের প্রচেষ্টার অন্যতম মাধ্যম হলো ‘দ্য ভ্যাকসিন এলায়েন্স বা গ্যাভি’। এই সংগঠন বিশ্ব্ স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত। তাদের ঘোষণা অনুযায়ী, এই সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার ২০ শতাংশ মানুষের জন্য ভ্যাকসিন পাবে বিনামূল্যে। এই হিসাবে বাংলাদেশ তিন কোটি ৪০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন বিনামূল্যে পাবে। 

চলতি মাসের (সেপ্টেম্বর) শেষের দিকে গ্যাভি সিদ্ধান্ত নেবে তারা বাংলাদেশের সবার জন্য করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন বিনামূল্যে দেবে, না আংশিক অর্থের বিনিময়ে দেবে। কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতি অনুযায়ী, যেসব দেশের মানুষের মাথাপিছু বার্ষিক আয় চার হাজার ডলার বা এর চেয়ে বেশি তারা জনগণের জন্য ভ্যাকসিন কিনে নেবে। আর যাদের বার্ষিক আয় চার হাজার ডলারের নিচে তাদের গ্যাভি নির্দিষ্ট পরিমাণ ভ্যাকসিন দেবে বিনামূল্যে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য খুব ভালো সংবাদ হলেও আশঙ্কার বিষয় হলো- ভ্যাকসিন পরীক্ষা সফল হলে গ্যাভির এই বিনামূল্যের ভ্যাকসিন আগামী বছরের জুন অথবা জুলাই মাসের আগে পাওয়া যাবে না। 

জাতীয় পরামর্শক কমিটি ঠিক এই আশঙ্কাটার কথাই বলেছে তাদের ১৯তম সভায়। পরামর্শক কমিটি বলেছে, ‘গ্যাভির ভ্যাকসিন পেতে বেশ দেরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমতাবস্থায় আমাদেরও অগ্রিম টাকা জমা দিয়ে ভ্যাকসিন বুকিং করা প্রয়োজন।’ 

ভ্যাকসিনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, যেসব দেশের কোম্পানি ভ্যাকসিন তৈরি করবে সেসব দেশ আগে ভ্যাকসিন পাবে। এরপর অন্য দেশকে দেয়া হবে। এর মধ্যে যারা বেশি অর্থ খরচ করতে পারবে, তারাই আগে ভ্যাকসিন পাবে।

ভ্যাকসিন রাখার ব্যবস্থা নেই

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়েসাস বলেছেন, একজন মানুষও করোনাভাইরাস আক্রান্ত থাকলে কেউই নিরাপদ নন। ফলে দেশের সবাইকে এক যোগে ভ্যাকসিন দেয়ার কাজটি করে যেতে হবে। সকলের জন্য ভ্যাকসিন নিয়ে আসতে হলে সেগুলো সংরক্ষণ করার জন্য প্রয়োজন কোল্ড চেইন সিস্টেম (শীতলীকরণ প্রক্রিয়া)। কিন্তু বাংলাদেশে এত বেশি ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা নেই। 

এ ব্যাপারে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি বলেছে, ‘কোনো কোনো ভ্যাকসিনের জন্য প্রয়োজনীয় তাপমাত্রার কোল্ড চেইন ব্যবস্থা আমাদের নেই। ভ্যাকসিন নির্বাচনের ক্ষেত্রে সে বিষয়টির দিকে লক্ষ্য রাখা যেতে পারে অথবা উল্লিখিত তাপমাত্রার কোল্ড চেইন ব্যবস্থা তৈরি করা যেতে পারে।’ 

শিশুদের নানা ধরনের ভ্যাকসিন প্রদানে (ভ্যাকসিনেশন) সারা বিশ্বেই অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু তা আড়াই কোটি ডোজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বাংলাদেশের প্রয়োজন হবে একইসাথে কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন। এই বিশালসংখ্যক ভ্যাকসিন রাখার ব্যবস্থা আমাদের নেই। সে জন্যই জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি কোল্ড চেইন ব্যবস্থা তৈরির ওপর জোর দিয়েছে।

একাধিক উৎসের সাথে যোগাযোগ

‘সবার জন্য ভ্যাকসিন’ এ নীতি নিতে হবে সরকারকে। এজন্য একসাথে সবাইকে ভ্যাকসিন দিতে হলে একটি নয় একাধিক উৎসের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি ঠিক এই পরামর্শটাই দিয়েছে সরকারকে। 

পরামর্শক কমিটি বলেছে, ‘কোনো একটি ভ্যাকসিন সংগ্রহের চেষ্টা না করে একাধিক উৎসের সাথে যোগাযোগ ও তা সংগ্রহের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। বিশেষ করে ভ্যাকসিন তৈরিতে যেসব দেশের সরকারের সম্পৃক্ততা আছে, তাদের সাথে যোগাযোগ করা প্রয়োজন। প্রাপ্তির পর ভ্যাকসিন প্রদানের কার্যক্রম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে করতে হবে ও এখনই ডিপ্লয়মেন্ট প্ল্যান (ভ্যাকসিন বিতরণ পরিকল্পনা) চূড়ান্ত করা প্রয়োজন। ভ্যাকসিন প্রদানের পরবর্তী সময়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলোআপ করার ব্যবস্থাও থাকতে হবে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //