দুর্যোগে দরিদ্রতার সাথে বাড়ে কোটিপতি

করোনাভাইরাসের ধাক্কা লেগেছে সমগ্র বিশ্ব অর্থনীতিতেই। আয় কমেছে মানুষের। মহামারির ছয় মাসে নতুন করে দরিদ্রসীমার নিচে নেমেছে দেশের আরো দেড় কোটি মানুষ। 

তবে সবার জন্য সর্বনাশ হয়ে আসেনি কভিড-১৯, কারও জন্য পৌষ মাসও বটে! নানা সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেকেই হয়েছেন আঙুল ফুলে কলাগাছ, একেবারে কোটিপতি। সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত মার্চ থেকে জুন- করোনাকালের এই তিন মাসে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে তিন হাজার ৪১২ জন। মোটা দাগে দেশের অর্থনীতিতে এটিকে সুসংবাদ মনে হলেও, বিশেষজ্ঞরা বলছেন অশনিসংকেত। বৈষম্যমূলক অর্থনীতির কারণে জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধির সুফল এই গুটিকয়েক মানুষের কাছেই যে জমা হচ্ছে।

ভালো আছি...

বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বলছে, করোনাভাইরাসে বিধ্বস্তদের মধ্যে নিম্নবিত্ত ২০ ভাগ, আর ২০ ভাগ উচ্চবিত্ত। মাঝের যে ৬০ ভাগ এরা নিম্ন মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত। এই সংখ্যা আড়াই কোটি পরিবার হবে। এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী, মাল্টিন্যাশনাল ও বড় কোম্পানিতে কাজ করা কিছু মানুষ বাদে অন্যরা সবাই এখন চরম সংকটে। তাদের বড় একটা অংশই চাকরি হারিয়েছেন কিংবা হারানোর ঝুঁকিতে আছেন। আবার যাদের চাকরি কোনো রকমে টিকে আছে, তাদের অনেকেরই বেতন অনিয়মিত, কারও কারও নেমে এসেছে অর্ধেকে। এছাড়া যারা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করেন, তাদের বেশিরভাগই কর্মহীন। হতাশায় অনেকে শহর ছেড়েছেন।

  • (সব সংকটের সময়ই দেশে কোটিপতি বাড়ে; সেটা দুর্ভিক্ষ হোক, বন্যা কিংবা যুদ্ধ। এই শ্রেণিটি যেহেতু ক্ষমতার সাথে থাকে, সেহেতু যে কোনো দুর্যোগেই সুবিধা ভোগ করে। এবার করোনাকালে তা-ই দেখা গেছে এবং কোটিপতিও বেড়েছে )

তথ্য মতে, কাজের সংকট কিংবা কর্মহীন মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির বেশির ভাগই এখন সঞ্চয় ভেঙে জীবন চালাচ্ছেন। ব্যাংকে থাকা যৎসামান্য ডিপোজিট বা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা শেষ সম্বলটুকুও ভেঙে ফেলছেন অনেকে। যাদের সেটিও নেই, তারা চলছেন ধার-কর্জে। 

এ অবস্থায় আবার কোটিপতির সংখ্যাও বাড়ছে দ্রুত। অর্থাৎ যারা ধনী তারা দিন দিন সম্পদ গড়ছেন। আর যারা গরিব কিংবা মধ্যবিত্ত তারা যেন সেই বলয় থেকে বেরোতে পারছেন না। যা আরো তলানির দিকে যাচ্ছে।

পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম ১০-১৫ বছর কোটিপতি বেড়েছে ধীরগতিতে। আর অশ্বগতিতে বাড়তে থাকে ১৯৯০ সালের পর থেকে। ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি অ্যাকাউন্টধারী ছিলেন মাত্র পাঁচজন। ১৯৭৫ সালের শেষে এ সংখ্যা ৪৭ জনে দাঁড়ায়। ১৯৮০ সালে ছিল ৯৮ জন। এর ১০ বছর পর ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪৩ জনে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালের জুনে ছিল দুই হাজার ৫৯৪ জন। এরপর অক্টোবর ২০০১ থেকে ডিসেম্বর ২০০৬ পর্যন্ত নতুন করে আট হাজার ৮৮৭ জন কোটিপতি হয়, আর মোট সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১৪ হাজার জনে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর শেষে সেই অ্যাকাউন্ট বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪ হাজার ৭২৭টিতে। বিশ্লেষকদের মতে, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত, দশ বছরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে সব থেকে বেশি, প্রায় ৭১ হাজার। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট কোটিপতি অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজার ৮৩৯টি। বাঁকাপথে আয় এবং ব্যাংকিং চ্যানেলের অসাধু কর্মকর্তা ও গ্রাহকের কারসাজির মাধ্যমে বড় অঙ্কের টাকা লেনদেনই হঠাৎ করে এভাবে কোটিপতি বাড়ার অন্যতম কারণ। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূলত সব তফসিলি ব্যাংকের কাছ থেকে প্রাপ্ত হিসাবের ভিত্তিতে কোটিপতির সংখ্যা নির্ধারণ করে। তবে এটি শুধু কাগজে-কলমে এবং ব্যাংকে গচ্ছিত আর্থিক স্থিতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি। অন্যান্য দিক ও সম্পদের বিবেচনায় এ সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি বলেই মনে করেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। 

তারা বলছেন, হাতেগোনা কিছু মানুষের কাছে দেশের ৪০ শতাংশের বেশি সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ায় আয় বৈষম্য অনেক বেড়ে গেছে। ধনী-গরিবের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে আকাশ-পাতাল ব্যবধান, যা শোষণের পর্যায়ে পড়ে।

একটি দেশের আয়বৈষম্য পরিমাপের মানদণ্ড হলো গিনি কো-এফিসিয়েন্ট। বর্তমান সরকার ২০০৮ সালে যখন ক্ষমতায় আসে, তখন এটি ছিল ০.৩২ শতাংশ। ১০ বছর পর এসে তা বেড়ে ০.৪৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদদের পরিভাষায় এটি উদ্বেগজনক। পৃথিবীর কোথাও বা আমাদের পার্শ্ববর্তী কোনো দেশেই এমন আয়বৈষম্য নেই। কম-বেশি ০.৩০ থাকলে এটি সহনীয় পর্যায়ে আছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

দেশে অর্থনীতির আকার ক্রমেই বড় হচ্ছে বলে মত বিশ্লেষকদের। প্রতি বছরই বাড়ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়। এতে মানুষের সঞ্চয়প্রবণতা বেড়েছে। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গুণগত মান না বাড়ায় সমাজের একটি শ্রেণির কাছেই বেশি সম্পদ ও অর্থ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। 

তিনি বলেন, ‘যে কোনো দেশেই কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধিকে উন্নয়নের প্রতিফলন হিসেবে দেখা হয়। তাই আমরাও চাইব আমাদের দেশে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ুক। কারণ দেশে যতই সম্পদশালী বাড়বে অর্থনীতি ততই শক্তিশালী হবে; কিন্তু সেই সম্পদ যদি মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত থাকে। মানুষে মানুষে অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বেড়ে যায়। তখন সেটি হয় উদ্বেগজনক। করোনাকালেও যেসব সূচক প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে বৈষম্য বাড়ার ইঙ্গিত মিলছে।’

বিভিন্ন উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থার তথ্যমতে, করোনাকালে আয় কমেছে শতকরা ৭২.৬ শতাংশ পরিবারের। আর যাদের বার্ষিক আয় এক লাখ টাকার কম, তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। আবার গতি হারানো অর্থনীতির অন্য পিঠে আছে নতুন ধনীর পরিসংখ্যানও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন মাস শেষে ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৬ হাজার ৩৭ জন। মার্চ শেষে সংখ্যাটি ছিল ৮২ হাজার ৬২৫ জন। আগের বছরের জুন মাস শেষে ছিল ৮০ হাজার ৩৯৬ কোটিপতি আমানতকারী। অর্থাৎ এক বছরে বেড়েছে পাঁচ হাজার ৬৪১ জন। এর মধ্যে করোনাকালেই বেড়েছে ৩ হাজার ৪১২ কোটিপতি। ব্যাংক কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর ব্যাংকে কোটিপতির সংখ্যা কিছু কমে যায়। করোনাকালের প্রথম তিন মাসে অবশ্য সেই সংখ্যাটা হঠাৎ বেড়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘দেশের কোটি কোটি লোক নিঃস্ব হয়েছে বলেই করোনাকালীন সাড়ে তিন হাজার মানুষ নতুন করে কোটিপতি হয়েছেন। আবার ব্যাংক লুটেও একটি শ্রেণি কোটি কোটি টাকার মালিক হচ্ছেন। তারাই হয়তো ব্যাংকে টাকা রাখছেন। হঠাৎ কোটিপতি আমানতকারী বেড়ে যাওয়া তারই প্রমাণ।’

অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘দেশের এই আয় বৈষম্যটা উন্নয়নের যে মান, সেটিকে কমিয়ে দেয়। এটি যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে নানান কিছুর মধ্যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। যদিও করোনাকালে আমদানি ও ভ্রমণের জন্য ব্যয় কম হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে আমাদের বড় রকমের অবস্থান আছে। যা দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালীই করেছে।’

আরো চাই

বিভিন্ন জাতীয় দুর্যোগ সাধারণ মানুষের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনলেও এক শ্রেণির জনপ্রতিনিধি থাকেন এর প্রতিক্ষায়! করোনাভাইরাস সংকটেও তারা গোঁফে তেল মেখেছেন ইচ্ছে মতো। হতদরিদ্রের ত্রাণ নয়-ছয় করে হয়েছেন কোটিপতি। আবার অতিরিক্ত খেয়ে হজম করতে না পারা সেই ত্রাণ পাওয়া যায় কারও পুকুরে, মাটির নিচে ও খাটের তলায়। 

এদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সারা বিশ্বেই মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবসা এখন তুঙ্গে। বহুগুণে বেড়েছে চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই), গগলস, ফেস শিল্ড, স্যুট, বুট কভার, ইনফিউশন পাম্প, ব্যাকপ্যাক ডিসইনফ্যাকট্যান্ট স্প্রেয়ার, হ্যান্ড-হেল্ড আইআর থার্মোমিটার, থার্মাল ইমেজিং টেম্পারেচার, করোনাভাইরাস টেস্টিং কিট ও কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস দেওয়ার মেশিন ভেন্টিলেটরের চাহিদাও। আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন এসব পণ্য উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িতরা। উপরের মহলকে ম্যানেজ করে ফুলে ফেঁপে উঠেছে এক ধাক্কায়। তাদেরই একজন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অন্যতম ঠিকাদার জেএমআই গ্রুপের মালিক আব্দুর রাজ্জাক। চিকিৎসকদের জন্য তার প্রতিষ্ঠান ২০ হাজার ৬০০টি এন৯৫ মাস্ক সরবরাহ করে, যার সবই ছিল নকল। চলামান করোনাভাইরাস সংকটকে পুঁজি করে তার মতো অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যে পোয়াবারো। 

অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘সব সংকটের সময়ই দেশে কোটিপতি বাড়ে; সেটা দুর্ভিক্ষ হোক, বন্যা কিংবা যুদ্ধ। এই শ্রেণিটি যেহেতু ক্ষমতার সাথে থাকে, সেহেতু যে কোনো দুর্যোগেই সুবিধা ভোগ করে। এবার করোনাকালে তা-ই দেখা গেছে এবং কোটিপতিও বেড়েছে।’ 

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের নব্য বিত্তবান বা লুম্পেন কোটিপতি অনেক। অর্থ উপার্জনের জন্য তারা উৎপাদনশীল পথের চেয়ে দ্রুত মুনাফা অর্জনে সহজ ও চোরাইপথ গ্রহণে বেশি আগ্রহী। এর মধ্যে চোরাচালানি, মাদক ব্যবসা, ব্যাংক ঋণ লোপাট, জবরদখল, জালিয়াতি উল্লেখযোগ্য। তাদের জন্য আবার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, স্বাধীন গণমাধ্যম, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় প্রকল্প ও অর্থ বরাদ্দে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, স্বাধীন নির্বাচনব্যবস্থা, স্বাধীন বিদ্যাচর্চা-সংস্কৃতিচর্চাটা বেশ বিপজ্জনক। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া যত অস্বচ্ছ ও অগণতান্ত্রিক হবে, ততই সুবিধা। তাই এই গোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজন হয় কতিপয় ব্যক্তির হাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত রাখা; যাদের সঙ্গে সহজেই সমঝোতা, অংশীদারিত্ব ও চুক্তি করা সম্ভব। কারণ ওই ব্যক্তিদের অংশীদার বানিয়ে তরতর করে বিত্তের সিঁড়ি অতিক্রম করা সহজ।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //