বিদেশে সম্পদের পাহাড়!

অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনাসহ নানারকম অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িতদের দেশের তুলনায় বিদেশে বেশি সম্পদের খোঁজ পাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। 

সংস্থাগুলোর প্রাথমিক তদন্তে এসব ব্যক্তির তেমন কোনো সম্পদের হদিস না পাওয়া গেলেও ক্রমান্বয়ে বেরিয়ে আসছে সম্পদের সন্ধান। এসব সম্পদের বেশির ভাগই দেশে নয়, বিদেশে।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, গত বছর অবৈধ ক্যাসিনো ও অন্যভাবে অবৈধ সম্পদ গড়ার অভিযোগে যে অভিযান শুরু করেছে তার ফলশ্রুতিতে এখন পর্যন্ত মোট ২২টি মামলা করেছে রাষ্ট্রীয় এই দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাটি। এসব মামলায় আসামি করা হয় ২৫ ব্যক্তিকে, যাদের ১৯ জন বর্তমানে গ্রেফতার অবস্থায়, তিনজন জামিনে ও বাকি তিনজন পলাতক রয়েছেন। 

গত বছর নভেম্বর মাসের ১২ তারিখে যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করে দুদক। এই মামলায় সম্রাটের অবৈধ সম্পদ পাওয়া যায় মাত্র দুই কোটি ৯৪ লাখ টাকা সমপরিমাণের। এত বড় আলোচিত ‘ক্যাসিনো গডফাদারের’ এই ‘সামান্য’ সম্পদে হতাশ হয়েছিলেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। 

তবে সম্প্রতি দুদকের পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমকে জানানো হয়, সম্রাট দেশের বাইরে কী পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন তা খুঁজে বের করতে শুরু করেছে দুদক। এরই মধ্যে সিঙ্গাপুরে পাচার করা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২২৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা পাচারের প্রমাণ দুদকের হাতে এসেছে। সিঙ্গাপুরের মুদ্রায় যা তিন কোটি ৬৫ ডলার। একইসাথে মালয়েশিয়ায় পাচার করা ৪০ লাখ টাকার আংশিক তথ্য পেয়েছে দুদক। 

চিঠিপত্র বিনিময় করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মাধ্যমে সম্রাটের পাচার করা এই অর্থের সন্ধান পেয়েছে দুদক। এছাড়া দুদকের মামলায় সম্রাটের দুটি ব্যাংক হিসাবে ৮৮ লাখ ৭৪ হাজার ১৮ টাকার তথ্যও দেয়া হয়। তার এই টাকা ফ্রিজ করা হয়েছে।

এদিকে গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর রমনা থানায় সম্রাটের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং আইনে মামলা করে সিআইডি। এ মামলায় সম্রাটের বিরুদ্ধে পৃথকভাবে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে ১৯৫ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ আনে সিআইডি। জানা গেছে, তিনি নয় মাসেরও বেশি সময় ধরে  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ছিলেন। প্রথমে তাকে নেয়া হয়েছিল জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটেও। সেখানে একই সমস্যায় গত অক্টোবরেও তাকে দেয়া হয়েছিল সুস্থতার ছাড়পত্র। তার হাসপাতালবাসের কারণে আট মাস আগে অস্ত্র ও মাদক মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা হলেও শুরু হয়নি বিচার।

সুস্থ থাকলে হাসপাতালে কেন সম্রাট- এ প্রশ্নের জবাবে বিএসএমএমইউর হৃদরোগ বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী মেশকাত আহমেদ সংবাদমাধ্যমে দাবি করেন, তার হৃদস্পন্দন অনিয়মিত। আর এ চিকিৎসা বিএসএমএমইউতে নেই জানিয়ে মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত পরিচালককে তিনটি চিঠি দিয়েছে মেডিক্যাল বোর্ড। তাহলে সম্রাটকে ছাড়পত্র কেন দেয়া হচ্ছে না- জানতে চাইলে হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুলফিকার আহমেদ আমিন জানান, সম্রাটকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে স্থানান্তরের জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে। অথচ একই জটিলতা নিয়ে অক্টোবরে ভর্তির পর সুস্থ বলে ছাড়পত্র দিয়েছিল হৃদরোগ ইনস্টিটিউট।

গত বছরের অক্টোবরে প্রধান গ্রুপের কর্ণধার সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে মামলা করে দুদক; কিন্তু সম্প্রতি অনলাইন জুয়ার কারবারি সেলিম প্রধান দেশ থেকে ১৩ কোটি টাকা থাইল্যান্ডে পাচার করেছেন বলে প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে দুদক। 

সেলিমের মালিকানায় থাইল্যান্ডে প্রধান গ্লোবাল ট্রেডিং, এশিয়া ইউনাইটেড এন্টারটেন্ট মেন্টলি, তমা হোম পাতায়া কোং লিমিটেডসহ সাতটি কোম্পানির নথিও পেয়েছে দুদক। থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ব্যাংক, দি সায়েম কমার্শিয়াল ব্যাংকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সময়ে সেলিম প্রধান ২০ কোটি টাকারও বেশি ‘অবৈধ’ লেনদেন করেছেন বলেও তথ্য প্রমাণ পেয়েছে দুদক।

এর আগে দুদক সেলিম প্রধানের নামে থাকা প্রায় ১২০টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে। গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে রাজধানীতে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করে সরকার। এ সময়ে গডফাদারসহ ২০ জনের বেশি সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তারই ধারাবাহিকতায় গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর বিতর্কিতদের সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। এজন্য পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়। 

সেপ্টেম্বরে শুদ্ধি অভিযান শুরুর প্রথম দিনই রাজধানীর ইয়াংমেনস ফকিরাপুল ক্লাব থেকে গ্রেফতার হন ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক (পরে বহিষ্কৃত) খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া।

এরপর বিভিন্ন অভিযানে একে একে গ্রেফতার হন যুবলীগ নেতা ও ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম, সম্রাট, তার সহযোগী এনামুল হক ওরফে আরমান, অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান, তারেকুজ্জামান রাজীব ও ময়নুল হক মঞ্জু।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //