ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের দাবি

‘মানবাধিকার সমুন্নতকরণ ও সংরক্ষণ: করোনাকালীন মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ শীর্ষক সংলাপে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং এই সময়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে গ্রেফতার হওয়া সাংবাদিকদের মুক্তির দাবি জানিয়েছেন বক্তারা।

বেসরকারি গবেষণা সংগঠন ‘ভয়েস’ আয়োজিত সংলাপে বক্তরা এ কথা বলেন। সেমিনারে সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন ভয়েসের নির্বাহী পরিচালক আহমেদ স্বপন মাহমুদ।

আলোচনা সভায় মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ভয়েসের প্রকল্প সমন্বয়ক এবং চলচ্চিত্রকার জায়েদ সিদ্দিকী ও গবেষণা সহযোগী আফতাব খান শাওন। সংলাপে প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খ্যাতিমান সাংবাদিক সেলিম সামাদ, সাংবাদিক খায়রুজ্জামান কামাল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক সাইমুম রেজা তালুকদার, তরুণ চলচ্চিত্রকার শাহাদাত রাসেল ও অপরাজিতা সঙ্গীতা। সংলাপটি ভয়েসের সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত হয় এবং একই সাথে অনলাইনে বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। অনলাইনে প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন আর্টিকেল ১৯-এর দক্ষিণ এশিয়া পরিচালক ফারুখ ফয়সল এবং পেন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সভাপতি ড. আইরিন জামান।

মূল বক্তব্যে বলা হয়, করোনার সময়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। এর ফলে সাংবাদিকসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার হচ্ছে, মানুষ কথা বলতে, লিখতে ভয় পাচ্ছে, যা গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। একদিকে দমন নিপীড়ন অন্যদিকে মানুষ নিজেরোই নিজেদের উপর সেন্সরশিপ আরোপ করছে। নিরাপত্তার অজুহাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে অনেক সাংবাদিক, শিক্ষক, কার্টুনিস্ট, বাউল শিল্পী, ছাত্র ও সাধারণ মানুষ। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলায় সাংবাদিকদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হয়রানি ও নির্যাতন করা হয়েছে।  

মূল নোটটিতে আরো বলা হয়েছে, যে বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও, ইন্টারনেটের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটি ৩০ লাখ, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৬২ শতাংশ। এর মধ্যে ফেসবুক ব্যবহারকারী প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ। দেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাসমান ভুল তথ্যের পরিমাণ ভীতিকর অবস্থায় রয়েছে। এই ভুল তথ্যগুলো মূলত তিনটি গ্রুপ- ইসলামপন্থি দল, সরকারি সমালোচক এবং নেটিজেনরা ছড়িয়ে থাকেন। যদিও দেশের সংবিধান মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দুর্ভাগ্যক্রমে, ডিজিটাল সুরক্ষা আইন ২০১৮, বিনা ওয়ারেন্টে অনুসন্ধান এবং গ্রেফতারের অনুমতি দিয়েছে এবং এ আইনে সাজা রাখা হয়েছে সর্বোচ্চ ১৪ বছরে কারাদণ্ড। এছাড়াও এই আইনে একটি বিশাল জরিমানার বিধানও রাখা হয়েছে। যারা সরকার বা সরকারি সংস্থার দুর্নীতি বা অনিয়মের কথা বলছেন, সাংবাদিক, সমালোচক, শিল্পী, লেখক, সাধারণ জনসাধারণ এমনকি অপ্রাপ্তবয়স্কদেরকেও এই আইনের ব্যবহার করে টার্গেট করা হচ্ছে এবং গ্রেফতার-হয়রানি করা হচ্ছে।

গত বছর (২০১৯) এই আইনের অধীনে এক হাজারেরও বেশি গ্রেফতার করা হয়েছে। এবং বাংলাদেশ সরকারের সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে প্রায় ২০০০ মামালা হয়েছে। এর মধ্যে কেবলমাত্র ২০২০ সালের প্রথম নয় মাসে ৮০০ এরও বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এতে দেশের বেশিরভাগ বিশিষ্ট সম্পাদক এবং সিনিয়র সাংবাদিকদের ক্রমবর্ধমানভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হচ্ছে।

সাংবাদিক সালেম সামাদ বলেন, সরকার দিন দিন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহারের নামে সাংবাদিক ও অন্যদের দমিয়ে রাখার পাশাপাশি মামলা ও গ্রেফতারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। একই সাথে যারা সেবাখাত ও স্বাস্থ্যখাতের সাথে জড়িত, মহামারি সম্পর্কে গণমাধ্যমে কিছু না বলার জন্য তাদের চাপ দেয়া হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যম নজরদারি করা হচ্ছে, সেই সাথে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে এমন কিছু শেয়ার করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়া এবং বাংলাদেশের আর্টিকেল ১৯ এর আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সাল বলেন, এটা খুবই অবাক করার বিষয় যে, এই সময়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহারের মাধ্যমে  সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালনে বাধা প্রদান করছে। এই আইনের দ্বারা বাক স্বাধীনতাকে অপরাধের শামিল করে তুলছে, যার ফলে ক্ষমতার বিস্তার ও আধিপত্যকে বজায় রাখছে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইমুম রেজা তালুকদার বলেন যে, করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই সরকার ত্রাণ ও স্বাস্থ্যখাত নিয়ে যেসব সাংবাদিক বা সমাজকর্মী কথা বলছে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে বা কোন না কোনোভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। এছাড়া যারাই সরকারের সমালোচনা করছে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।

পেন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সভাপতি ড. আইরিন জামান বলেন, বর্তমানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮১ টি দেশের মধ্যে ১৫১, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিচের দিকে। তিনি এর কারণ হিসেবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে দায়ী করেন।

সমাজকর্মী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা অপরাজিতা সংগীতা বলেন, বাংলাদেশ ব্যক্তি স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতার পাশাপাশি শিল্পের স্বাধীনতা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।

এছাড়া সেমিনারে আরো বক্তব্য রাখেন তরুণ চলচ্চিত্রকার সাহাদাত রাসেল, জায়েদ সিদ্দিকি, ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্ডারের প্রতিনিধি সায়েদ আহমেদ, ইউএসএইডের প্রতিনিধি সুমনা বিনতে মাসুদ প্রমুখ। 

আলোচনায় সরকারে দমন নিপিড়ন ও সাংবাদিকদের উপর নির্যাতন, গ্রেফতার মামলার সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরা হয়। এছাড়া এই আলোচনাসভা থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের দাবি তোলা হয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //