ঝুঁকি নিয়ে দেশান্তরী হচ্ছেন তরুণরা

শরীয়তপুরের মাসুদ রানা (৩৬) দুই বছর আগে দেশ ছাড়েন যুক্তরাষ্ট্রের নেশায়। আট দেশ ঘুরে ১৮ মাসে অবশেষে স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় পৌঁছান ২৭ লাখ টাকা খরচ করে। বিভিন্ন দেশের কারাগারে ছিলেন বছরখানেক। বাংলাদেশ থেকে যারা তার সঙ্গী হয়েছিলেন, তাদের কয়েকজন মারা গেছেন পথেই। মৃত্যু শঙ্কা ছিল মাসুদ রানারও। 

প্রশ্ন হলো- তার মতো তরুণরা কেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উন্নত জীবনের স্বপ্নে ইউরোপ, আমেরিকা যাচ্ছেন? সবার এক জবাব, দেশে ভবিষ্যৎ নিরাপদ নয়। 

মাসুদ এখন আছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। চার মাস কারাগারে কাটিয়ে আইনি লড়াইয়ে দেশটিতে শরণার্থী হিসেবে থাকার অনুমতি পেয়েছেন। ২০১৮ সালের আগস্টে দালালের দেখানো পথে দেশ ছাড়েন মাসুদ। প্রথমে ঢাকা থেকে পর্যটক ভিসায় দুবাই। সেখান থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা। সেখানে কিছুদিন কাটিয়ে দালাল ধরে ব্রাজিলের উদ্দেশ্যে উড়াল দেন। এবারো পর্যটক ভিসায়। আর তা জোগাড় করে দেয় দালাল চক্র। ব্রাজিল নামার পর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় আমাজন জঙ্গলের কাছাকাছি শহর ক্রজোরিও ডো সে লে। এই পর্যন্ত আরামদায়ক মাসুদের যাত্রা পথ।

ক্রজোরিও ডো সোলের চার দিকে ঘন আমাজন জঙ্গল। শহরের প্রান্তসীমার বনের ধারে এক বাড়িতে মাসুদকে নিয়ে যায় দালাল। সেখানে আগে থেকেই ছিল বিভিন্ন দেশের আরো ৬০-৭০ জন। তাদের মধ্যে অন্তত ২৫-৩০ জন ছিলেন বাংলাদেশি। ক্রজোরিও ডো সোলে কিছুদিন কাটিয়ে পায়ে হেঁটে সীমানা পেরিয়ে মাফিয়ার উর্বর ভূমি কলম্বিয়ায় পৌঁছান মাসুদসহ বাকিরা। সীমান্ত পার করায় দালালরা। এরপর কখনো হেঁটে, কখনো গাড়িতে করে দীর্ঘ এক মাসে কলম্বিয়া থেকে পানামা পৌঁছান মাসুদ। প্রথম গ্রেফতার হন সেখানে। মাসখানেকের কারাবাসের পর মুক্তি পান। মুক্ত করায় দালালরাই। 

এরপর একই প্রক্রিয়ায় কোস্টারিকা, হন্ডুরাস, গুয়েতেমালা পার হন মাসুদ। পথে পথে ছিল মৃত্যুর ভয়। জঙ্গলে, পরিত্যক্ত বাড়িতে কেটেছে দিনরাত। নিজেই রান্না করে খেতে হতো। খাবার বলতে ছিল ভাত ও লাতিন লাল আলুর ভর্তা। লাখ লাখ টাকা নেয়া দালালরা সদয় হয়ে কখনো মাছ, মাংস দিলে খেতেন। এই সময়ে দালালদের ঠিক করা বাড়িতে থেকেছেন। 

তবে সব সময়ই ছিল টাকার জন্য দালালের চাপ। দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা নিয়ে দালালের চাহিদা মেটান মাসুদ ও তার বাকি সঙ্গীরা। গুয়েতেমালা পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় ১৫ লাখ খরচ হয়ে যায় মাসুদের। এর মধ্যে প্রতি দেশে দালালের হাত বদল হয়। দেশ ছাড়ার ১৪ মাস পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী দেশ মেক্সিকোতে প্রবেশ করেন মাসুদ। সেখানে ফের গ্রেফতার হন। এ যাত্রায় তাকে জেলে কাটাতে হয় প্রায় মাস ছয়েক। ছাড়া পাওয়ার পর আগের ঠিক করা দালালরাই তাকে যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তে নিয়ে যায়। করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে গত মার্চে রক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাসুদসহ ৪০/৪৫ জন আমেরিকায় প্রবেশ করেন। এরপর ধরা পড়েন পুলিশের হাতে। ফের ঠিকানা হয় কারাগার। 

মাসুদ জানান, দেশে দেশে দালাল চক্র রয়েছে। তারাই সীমান্ত পার করে দেয়। বাংলাদেশে থাকা দালালকে টাকা দিতে হয়। বাংলাদেশি দালালই বাকি দেশের দালালদের টাকা পৌঁছে দেয়। এটি একটি আন্তর্জাতিক দালাল চক্র। 

২৭ লাখ টাকায় দেশেই ভালো ব্যবসা করা সম্ভব ছিল। তারপরও কেন দেশান্তরী হলেন? নিউইয়র্ক থেকে টেলিফোনে এ প্রশ্নের জবাবে মাসুদের দাবি, দেশে চাকরির সুযোগ সীমিত। তার মতো এসএসসি, এইচএসসি পাস তরুণদের জন্য ভালো চাকরি নেই। আর ব্যবসায় আছে পদে পদে বাধা। ব্যবসা করাও এত সহজ নয়। তাই নিরাপদ ভবিষ্যতের আশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছেন। দেশে নিরাপদ বোধ করলে তা করতেন না। 

মাসুদের মতো এমন হাজারো তরুণ প্রতি বছর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করে আমেরিকা, ইউরোপের দিকে ছুটছেন,। তাদের কেউ লিবিয়া হয়ে ইতালিতে পাড়ি জমানোর চেষ্টায় সাগরে ডুবে মরছে। কেউ মরছে আমাজন জঙ্গলের তীব্র গরম ও আর্দ্র পরিবেশে। আবার কেউ মরছে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টায় বলকান দেশগুলোর জঙ্গলে তীব্র শীতে। 

কেন তরুণরা এমন মৃত্যুঝুঁকি নিচ্ছেন? জরিপ বলছে, ৮২ শতাংশ তরুণই দেশ ছাড়তে চান। তারা মনে করেন, দেশে ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। অভিবাসন বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর প্রধান নির্বাহী ড. সি আর আবরার বলেছেন, ‘উন্নত দেশের মোহও একটি কারণ। অনেকের ধারণা ইউরোপ, আমেরিকা যেতে পারলেই ইউরো, ডলার উপার্জনের অবারিত সুযোগ খুলে যাবে। মাসে লাখ লাখ টাকা কামাই হবে; কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। তারপরও তরুণদের ঠেকানো যাচ্ছে না। কেন যাচ্ছে না- এর জবাব খুঁজতে হবে।’ 

শুধু দেশ থেকে নয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চাকরি করা বাংলাদেশিরাও ইউরোপের মোহে ছুটছে। তাদের একজন সম্প্রতি বলকান হয়ে ইতালিতে পাড়ি জমানো আবু নাসের জনি। তিনি ছিলেন কাতারে। তেলের পড়তি মূল্যের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি বেহাল। এতে চাকরি হারান জনি। দেশে ফেরার চেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টাকে ভালো বিকল্প মনে হয় তার। 

জনির বক্তব্য, ছয় বছর কাতার থেকে ১০/১২ লাখ সঞ্চয় করেছিলেন। এ টাকায় দেশে করার মতো কিছু খুঁজে পাননি। একবার গার্মেন্টস ব্যবসায় বিনিয়োগ করে লোকসান করেন। তাই দেশে না ফিরে তুরস্ক, আলবেনিয়া, বসনিয়া, স্লোভেনিয়া হয়ে ১২ লাখ টাকা খরচ করে ইতালি চলে আসেন। তবে সেখানে তারা ভালো নেই। অবৈধ শ্রমিক হিসেবে আসায় অর্ধেক বেতনে কাজ করেন; কিন্তু দেশে ফেরার চেয়ে বর্তমান জীবনকে ভালো বলছেন জনি। 

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, পূর্ব ইউরোপের দেশ ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্সে প্রবেশের চেষ্টায় বসনিয়ার জঙ্গলে এখনো শ’পাঁচেক বাংলাদেশি আটকে রয়েছেন। তাদের দেশান্তরী হওয়ার গল্পগুলোও জনি, মাসুদের মতো। তারা তীব্র শীতে জঙ্গলে প্রাণের ঝুঁকি থাকলেও দেশে ফিরতে রাজি নন। প্রত্যেকে ১০/১২ লাখ টাকা ব্যয় করে এতদূর এসেছেন।

স্লোভিনিয়ার নোভা গোরিছা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পদার্থবিদ্যা বিভাগে উচ্চতর ডিগ্রি নিচ্ছেন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী রাকিব হাসান রাফি। তিনি সেখান থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিকে সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন। 

রাফি জানান, নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশিরা দালালের হাত ধরে বলকান অঞ্চলের দেশ বসনিয়া, সার্বিয়া, হার্জেগোভিনা, স্লোভেনিয়া হয়ে ইতালিতে প্রবেশ করতেন। গাদ্দাফির পতনের পর লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ আসা শুরু হয়। গত ১০ বছরে ভূমধ্যসাগরে ডুবে হাজার হাজার অভিবাসন প্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে। যাদের মধ্যে তিন শতাধিক বাংলাদেশি। গত বছরের মে মাসে ৩৯ বাংলাদেশি সাগরে ডুবে মারা যান। 

তিনি জানান, পালেরমো প্রটোকল সইয়ের পর সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ কঠিন হয়েছে। ইতালি, গ্রিসের নৌরক্ষীরা এখন অভিবাসন প্রত্যাশীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠায়। এ কারণে বলকানের দেশগুলো আবার মানব পাচারের রুট হয়ে উঠেছে। এসব দেশে শাসন ব্যবস্থা দুর্বল ও ইউরোপের সেনজেনভুক্ত দেশগুলোর তুলনায় দুর্নীতিও বেশি। এ কারণে বলকান এলাকায় দালালের রমরমা অবস্থা। তাদের মাধ্যমেই বাংলাদেশিরা ইতালি, ফান্স, জার্মানিতে প্রবেশ করে। 

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগর দিয়ে যত মানুষ ইউরোপে প্রবেশ করার চেষ্টা করছেন, সেই তালিকায় গত চার বছর ধরে সবসময় শীর্ষ দশে থাকছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। চলতি বছর তিন হাজার ৪৫৫ জন বাংলাদেশি ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করতে গিয়ে গ্রেফতার হন। এ কারণেই বলকান আবার মানবপাচারের রুট হয়ে উঠেছে। 

অন্য যেসব দেশ তালিকায় রয়েছে সেগুলো হলো- তিউনিশিয়া, আলজেরিয়া, আফগানিস্তান, সিরিয়া, মরক্কো, মালি, আইভরি কোস্ট ও ঘানা। আফ্রিকার গরিব দেশ ও যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান, সিরিয়ার তরুণদের সঙ্গে বাংলাদেশিরাও কেন দেশান্তরী হচ্ছে, এর জবাব পাওয়া যায় অভিবাসন প্রত্যাশীদের জবানিতেই। তারা বলছেন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও নিরাপদ জীবন-জীবিকার আশায় দেশ ছাড়ছেন; ইউরোপ, আমেরিকায় আশ্রয় পেতে শরণার্থীর পরিচয় নিচ্ছেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //