পিপিই ব্যবহারে কমছে ওজন

করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা করলেও দেহের ওজন কমিয়ে দিচ্ছে পারসোনাল প্রোটেক্টিভ ইক্যুইপমেন্ট (পিপিই)। শুধু চিকিৎসকদেরই নয়- নার্স, ওয়ার্ড বয় ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরও একই অবস্থা। 

এই পেশার অনেকেই দেহের স্থূলতা সমস্যায় ভুগছেন, তাই কোনো কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে ওজন কমে যাওয়াকে আশীর্বাদ হিসেবে দেখা হচ্ছে। আবার কারও কারও ক্ষতির কারণও হতে পারে এই পিপিই। 

গত কয়েক মাসের করোনাকালীন চিকিৎসায় নিয়োজিত থেকে স্লিম হয়ে গেছেন এমন কয়েকজন চিকিৎসকের সাথে কথা বলে জানা গেছে- করোনাকালীন চিকিৎসা কাজে নিয়োজিত থেকে তারা ৮ থেকে ১০ কেজি ওজন কমিয়েছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৫ কেজি ওজন কমে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। 

শুধু যে ওজন কমে গেছে তা নয়। পিপিই পরিহিত অবস্থায় দীর্ঘ সময় প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে না পেরে মূত্রথলির রোগের সংক্রমণ বৃদ্ধির ঘটনাও ঘটেছে অনেকের। সরকারি অথবা বেসরকারি হাসপাতালে ডিউটি করতে গিয়ে এমনটা হয়েছে তাও নয়, প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখেও এমন অবস্থা হচ্ছে। অবশ্য অনেকে এমনো আছেন, যারা হাসপাতালের বাইরে পিপিই পরেন না, তাদের কথা আলাদা।

পিপিই ব্যবহারের শর্ত হলো- তা একবার ব্যবহার করে ফেলে দিতে হবে। ফলে একটি পিপিই দিয়ে দীর্ঘ ৮ ঘণ্টা ডিউটি শেষ করে খুলতে হয়। যদিও প্রথম দিকে বাংলাদেশে অরিজিনাল পিপিই দিয়ে নির্দেশ দেয়া হয় একাধিকবার ব্যবহার করার জন্য। কিন্তু ঢাকায় অনেক চিকিৎসকই নিজেকে অধিকতর নিরাপদ রাখতে একটা পিপিই একাধিকবার ব্যবহার করেন না। ফলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করতে না পারলেও, ব্যক্তিগতভাবে কিনে নিজেদের নিরাপদ রাখার চেষ্টা করছেন তারা। 

একজন চিকিৎসক জানান, ‘এক নাগাড়ে ৮ ঘণ্টা ডিউটি করে অবসন্নতা চলে আসে। কোনো কিছু খাওয়া যায় না, মাস্কও খোলা যায় না। এমনকি ইউরিনেশনের (প্রশ্রাব) জন্য পর্যন্ত হাসপাতালের ওয়াশরুমে যাওয়া যায় না। সাধারণ সময়ে ৮ ঘণ্টার মধ্যে আমরা পানি পান করে থাকি বেশ কয়েকবার, কিন্তু করোনাকালীন ডিউটি করার জন্য ও নিজেকে নিরাপদ রাখতে পিপিই ও মাস্ক খুলে পানিটুকু পান করতে পারি না।’ 

তিনি আরো জানান, ‘এটি অনেকের কাছে অসহনীয় মনে হয়। কয়েকজন ডাক্তার ও নার্সকে দেখেছি নিজ রুমে গিয়ে পিপিই ও মাস্ক খুলে পানি পান করতে অথবা একটা কিছু খেয়ে আসতে। এটি বিপজ্জনক জেনেও তারা করে থাকেন; কিন্তু আমি এ কাজ করি না। নিজেকে নিরাপদ রেখে আমার কাজটি চালিয়ে যেতে চাই। সে কারণে ৮ ঘণ্টা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কষ্টটুকু সহ্য করে যাই।’

একটি সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক জানান, ‘আমি নিজে কিছু পিপিই কিনে নিয়েছি। একইসাথে এন-৯৫ মাস্কও কিনেছি। কর্তৃপক্ষ আমাকে যথেষ্ট পিপিই দিতে পারছে না। আমাদের সীমাবদ্ধতাও রয়েছে, আবার ইচ্ছা শক্তিও লাগে। যথেষ্ট পিপিই সরবরাহ করার ইচ্ছা শক্তি কবে হবে সেজন্য বসে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ মনে করি না। চিকিৎসক হয়েছি চিকিৎসা দেয়ার জন্য। নিজের কাজটুকু সুচারুরূপে করার জন্য নিজের গাটের টাকা খরচ করে পিপিই কিনেছি বেশ কিছু। তবে এগুলো একবার ব্যবহার করে ফেলে দেই না। বাসায় গিয়ে বিশেষভাবে স্টেরিলাইজ (জীবাণুমুক্ত করা) করে নিয়ে আবার ব্যবহার করি যতদিন করা যায়। সাবান-পানি দিয়ে ওয়াশ করি না। করলে এর গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যাবে।’

আরেকজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, তিনি পিপিই পরিধানকে নিজের জন্য কল্যাণকর বলে মনে করছেন। করোনাকালীন হাসপাতালে ডিউটি করায় তার দেহের ওজন কমেছে ১১ কেজি। এই ওজনটুকু তার কমানোর প্রয়োজন ছিল। 

তিনি বলেন, ‘আমার কিছুটা ওজন কমানোর প্রয়োজন ছিল। আমি কোনোভাবেই চেষ্টা করে সময় বের করতে পারছিলাম না জিমে গিয়ে অথবা বাসায় যে ব্যায়ামের ইন্সট্রুমেন্ট আছে সেগুলো ব্যবহার করে অতিরিক্ত ওজনটুকু কমিয়ে ফেলতে। করোনাকালীন গত ৮ মাসে দীর্ঘ সময় না খেয়ে এমনিতেই অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে ফেলতে পেরেছি। তবে ওজন কমানোর এটি যে খুব ভালো একটি প্রসেস, তা কিন্তু নয়। এই ক’দিনে অতিরিক্ত ওজন ঝরিয়ে ফেলতে পেরেছি। বেঁচে থাকলে আরো অনেক দিন করোনাভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকতে হাসপাতালে অথবা প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখতে হবে। তখন পিপিই পরার কারণে যে ওজন কমে যাবে, তা হয়তো ক্ষতিকর হতে পারে। নির্দিষ্ট পরিমাণ ওজন না থাকলে শরীর দুর্বল হয়ে অন্যান্য কিছু রোগ বাসা বাধার সুযোগ থাকে।’

পিপিই পরার কারণে ওজন কমে যাওয়ার সঙ্গে আরও কিছু সমস্যা তৈরি হচ্ছে চিকিৎসকদের। কয়েকজন চিকিৎসকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘ সময় এন-৯৫ অথবা আরো উন্নত ধরনের মাস্ক পরলে শরীরে অক্সিজেন ঘাটতি দেখা দিচ্ছে তাদের। শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাচ্ছে অনেকের। যে ডাক্তার, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের শ্বাসকষ্টের সমস্যা রয়েছে, তাদের জন্য মাস্ক ব্যবহার বিপদের কারণ হতে পারে। এ কারণে অনেক স্বাস্থ্যকর্মীরা জীবন ঝুঁকিতে নিয়ে মাস্ক না পরেই হাসপাতালে কাজ করেছেন। 

কেউ কেউ এখন পর্যন্ত নিরাপদে আছেন। কেউ কেউ ডিহাইড্রেশনেও ভুগে থাকেন। গরমে পুরো শরীর বিশ্রিভাবে ভিজে যাচ্ছে। ভিজে যাওয়া থেকে অনেকেরই হাইপ্রোক্সিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এসব কারণে পিপিই পরিহিত যে কেউ বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারেন। এক সময় ঘামজনিত অস্বস্তিতে ডিউটি ছেড়ে বের হয়ে যেতে হয়। এসি রুমে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আসতে হয় যেন ঠান্ডায় ঘাম কমে যায়, শরীরে স্বস্তি ফিরে আসে। 

পিপিই পরিধানকারীদের কষ্ট হওয়ার সাথে সাথে রোগীর সেবাও বিঘ্নিত হয়। সব জায়গায় এসির ব্যবস্থা থাকে না। বৈদ্যুতিক পাখার বাতাসে পিপিই পরিহিত ব্যক্তির ভেতরের ঘাম শুকাতে পারে না। তবে সামনের শীত পিপিই চিকিৎসককে কিছুটা স্বস্তি দেবে বলে আশা করা যায়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //