সর্দি-কাশির ভাইরাসে নতুন আতঙ্ক

বাংলাদেশে বিদ্যমান সাধারণ সর্দি-কাশির জন্য দায়ী করোনাভাইরাসের অন্য গোত্রগুলো, ঠান্ডা পড়লে যা অনেক বেশি ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। ঠান্ডায় সর্দি-কাশি সাধারণ বিষয় হলেও শীতে এই ভাইরাসগুলোই নতুন করোনাভাইরাসের সাথে বাড়াতে পারে নতুন আতঙ্ক। সর্দি-কাশি হলেও কেউ ভেবে নিতে পারেন তিনি কভিড-১৯ আক্রান্ত এবং এতে যোগ হতে পারে নতুন মানসিক কষ্ট।

সাধারণ সর্দিজ্বরের জন্য চার রকম করোনাভাইরাস দায়ী। শীতের মধ্যে প্রতিটিই সহজে ছড়িয়ে পড়ে। সর্দি-কাশির জন্য দায়ী ইনফ্লুয়েঞ্জা, রাইনোভাইরাস ও আরএসভি নামে আরেকটি ভাইরাসের আচরণ মোটামুটি একই রকম। রোটাভাইরাস নামে আরেকটি ভাইরাস মানুষের মধ্যে ডায়রিয়ার সৃষ্টি করে। দেশভেদে অবশ্য এসব ভাইরাস বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে বলে গবেষকরা জানিয়েছেন। 

কভিড-১৯ ও সর্দি-কাশির ভাইরাসের উপসর্গে মিল রয়েছে। সে কারণে সাধারণ সর্দি-কাশির উপসর্গ দেখা দিলে বিলম্ব না করে করোনাভাইরাস হয়েছে কি-না, তা পরীক্ষা করে নেয়া উচিত। তাহলে অজানা আতঙ্ক যেমন কমে যাবে, তেমনি করোনাভাইরাস হলেও সচেতনতা বাড়ায় তা কম ছড়াবে।

কম তাপ ও আর্দ্রতায় বেশি বাঁচে 

কম তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা করোনাভাইরাসকে আরো বেশি সময়ের জন্য বেঁচে থাকার সুযোগ করে দিতে পারে। এ কারণে শীতে করোনাভাইরাসের আরেক দফা সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে।

গত নভেম্বর থেকে ধীরে ধীরে সংক্রমণের হার বাড়ায় এই যুক্তিটিই প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যে, শীতে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়বে, যদিও এখন পর্যন্ত আশঙ্কাজনক কিছু ঘটেনি। শুধু বাংলাদেশে নয়, শীতপ্রধান দেশগুলোতেও বাড়ছে নতুন আক্রান্তের হার। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে অবশ্য করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। এখন পর্যন্ত বলা যায়, বাংলাদেশে শীতে নয়, গরমেই করোনাভাইরাসের বিশাল ঢেউটি আঘাত করে গেছে। সামনে শীত আরো বাড়লে কী হবে, তা কেউ প্রমাণসহ বলতে পারছেন না। দ্বিতীয় ঢেউ যে বাংলাদেশে আসবেই, এমন কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণও নেই। কারণ ঠান্ডার সাথে করোনাভাইরাসের কোনো সম্পর্ক রয়েছে বলে তা এখনো পুরোপুরি প্রমাণিত হয়নি। 

তবে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাতাসে আর্দ্রতার এক শতাংশ কমলে কভিড-১৯ সংক্রমণ ৬ শতাংশ হারে বাড়তে পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘করোনাভাইরাস সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে, তাতে ধরেই নেয়া যায়- শীতকালে এ ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ায় প্রকোপ বাড়বে।’ 

তিনি আরো বলেন, “বছরের এ সময় মানুষের মধ্যে শ্বাসকষ্টজনিত রোগ ছাড়াও আরো কয়েকটি ফ্লু জাতীয় ভাইরাস অ্যাক্টিভ হয়। একই সঙ্গে ভিটামিন ডি’র ঘাটতি দেখা দিলে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে করোনাভাইরাস মানুষের মধ্যে নতুন আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে।

বক্ষব্যাধির রোগীদের ঝুঁকি বেশি

সাধারণ সর্দি-কাশির মতো অনেক রোগ শীতকালে বেড়ে যায়। যাদের নিউমোনিয়া বা বক্ষব্যাধি রয়েছে তারা এ সময়ে বেশি কাবু হয়ে পড়েন। বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ রওশন আরা খানম বলেন, ‘লক্ষণগুলো অনেকটা একই রকম হওয়ায় সাধারণ ভাইরাস ও কভিড-১৯ আলাদা করার সুযোগ কম। কারণ করোনাভাইরাস ও সাধারণ ফ্লু’র লক্ষ্মণ অনেক সময় একই রকমের হয়ে থাকে। ফলে কারও এ ধরনের লক্ষ্মণ দেখা গেলে তাকে করোনাভাইরাসের মতোই সতর্ক ব্যবস্থা নিতে হবে।’ 

বিজ্ঞানীদের কাছে আরেকটি চিন্তার বিষয় হলো- কভিড-১৯ অন্য ভাইরাসের সাথে মিশে যেতে শুরু করে কি-না। গবেষণায় দেখা গেছে, এক ধরনের ভাইরাল ইনফেকশন অন্য ভাইরাসকে আক্রমণের জন্য সুযোগ করে দেয়। তবে এক্ষেত্রে একটি ভাইরাসের আক্রমণে শরীর যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে, তা অন্য ভাইরাসের আক্রমণ ঠেকাতেও সহায়তা করে। তবে একইসাথে একাধিক ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার উদাহরণও রয়েছে।

কভিড-১৯ সংক্রমণ হার আবার বাড়ছে 

বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সেপ্টেম্বরের পর ভাইরাসের প্রকোপ কিছুটা কমে আসার পর এখন আবার বাড়তে শুরু করেছে। বিশ্লেষণে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) মধ্যে একেবারেই নতুন বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে।’ 

তিনি আরো জানান, বাংলাদেশে শীতের শেষে গত মার্চে করোনাভাইরাসের বিস্তার শুরু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসের দিকে। এ সময়টিতে বাংলাদেশে প্রচুর গরম থাকে। প্রতিবেশী ভারতের ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে। দেখা যায়, করোনাভাইরাসের বিস্তারে গরম আবহাওয়া কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। গরম প্রধান দেশেও ভাইরাসের বিস্তার ঘটতে দেখা গেছে। শীতপ্রধান দেশগুলোতে গ্রীষ্মের সময়ও করোনাভাইরাসের বিস্তার বন্ধ হয়নি। ঠান্ডার সাথে এই ভাইরাসের বিশেষ সম্পর্ক ও ঠান্ডা বাড়লে ভাইরাসের বিস্তার বাড়বে, এমন সম্পর্ক গবেষণায় পাওয়া যায়নি।

মহামারি বিস্তারে স্বাস্থ্য বিধি না মানা দায়ী 

শুধু আবহাওয়া নয়, কর্তৃপক্ষের নীতি, জনসচেতনতার মতো অনেক বিষয় কাজ করে করোনাভাইরাসের বিস্তারে। আবার করোনাভাইরাস বিভিন্ন দেশে জিনে পরিবর্তন এনে ভিন্ন আচরণও করছে বলে জিনোম পরীক্ষায় দেখিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বলা হয়, ফেস মাস্ক ভাইরাসটির বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনের মতো কাজ করে; কিন্তু বাংলাদেশে মানুষ এটি ব্যবহারে আগ্রহী নয়। 

এত প্রচারণা ও জরিমানার পরও মাস্ক ব্যবহার না করেই বাইরে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেকে। হাত ধোয়াও আরেক ধরনের ভ্যাকসিনের কাজ করে এই ভাইরাসটির বিরুদ্ধে। এতেও অনীহা রয়েছে মানুষের মধ্যে। 

ঠান্ডা আবহাওয়া ভাইরাসের জন্য আদর্শ

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক এবং অণুজীব বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, ‘করোনাভাইরাস সংক্রমণে ঠান্ডার সময়টি আদর্শ। এ কারণেই ধারণা করা হচ্ছে, শীতকালে এই ভাইরাসের বিস্তার বেশি হতে পারে।’

শীতে বাতাসের আর্দ্রতা কম থাকায় হাঁচি, কাশি দেওয়া হলে বাতাসে জীবাণুর ক্ষুদ্র কণা অনেকক্ষণ ধরে ভেসে থাকতে পারে। ফলে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি থাকে। 

ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, ‘শীতকালে মানুষ ঘরের ভেতর বেশি থাকে, দরজা জানালা বন্ধ থাকে। পরিবেশ শুষ্ক থাকে, মানুষও কিছুটা কাছাকাছি বসবাস করে। ফলে এই সময় ভাইরাস নিজেদের মধ্যেই ছড়ানোর বেশি সুযোগ থাকে।’ 

বিশেষজ্ঞরা বলেন, করোনাভাইরাস বিস্তারের জন্য ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বিশেষ অনুকূল। বাংলাদেশে শীতে তাপমাত্রা সাধারণত ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামে না। দেখা গেছে, করোনাভাইরাস পরিবারের অন্য যেসব ভাইরাস রয়েছে, সেগুলোও ঠান্ডা আবহাওয়ায় বেশি বিস্তার ঘটে। করোনা জীবাণুর বাইরে নিউক্লীয় ইনভেলপ নামে একটি তৈলাক্ত আবরণ থাকে। শীতের পরিবেশে সেটা অনেকক্ষণ টিকে থাকতে পারে। ভাইরাসটি নিস্ক্রিয় করতে সক্ষম সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি; কিন্তু শীতে তাও কম থাকে। এ কারণেই শীতে ভাইরাসটির সংক্রমণ বাড়তে পারে।

সর্দি-কাশি হলেই কভিড-১৯ পরীক্ষা

সর্দি-কাশির লক্ষ্মণ দেখা দেয়ার পর পরীক্ষা করানোর জন্য মানুষকে আগ্রহী করে তোলা প্রয়োজন। সে জন্য বাড়াতে হবে প্রচারণা, মানুষকে সচেতন করতে হবে এ বিষয়টিতে। সেইসাথে করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষা পেতে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা, হাত ধোয়ার মতো যেসব সতর্কতা পালন করার কথা বলা হয়, সেগুলো সবাইকে কড়াকড়িভাবে পালন করতে হবে। নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর জোর দিতে হবে। হাত ধোয়া, হাঁচি কাশির সময় শিষ্টাচার রক্ষা করা ইত্যাদি বিষয়গুলো কড়াকড়িভাবে পালন করতে হবে। 

একইসাথে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়গুলোও সবার মাথায় রাখতে হবে এবং এটি যেন মানুষ মানে সেজন্য নতুন নতুন কৌশল তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তি ও ডিজাইন ব্যবহার করা যেতে পারে।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //