মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা

১৬ ডিসেম্বর বাঙালির অবিস্মরণীয় দিন। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর মা-বোনদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া বিজয়ের দিন। এই দিনটিকে ঘিরে আমাদের আবেগ অনুভূতির শেষ নেই। বিজয়ের দিনে ঘুরে আসতে পারেন আমাদের গৌরবগাঁথা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলো থেকে। লিখেছেন মাহমুদ সালেহীন খান

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান
ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বাংলাদেশের বহু ইতিহাসের সাক্ষী। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ও পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষর হয়েছিল এখানেই। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) থেকেই স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে জেনারেল নিয়াজী ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে এই উদ্যানেই মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটাই সবচেয়ে বড় আত্মসমর্পণের ঘটনা।

সেই স্মৃতিকে জ্বালিয়ে রাখতেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থাপন করা হয়েছে ‘শিখা চিরন্তন’। ১৯৯৭ সালের ৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিখা চিরন্তন প্রজ্বোলন ও দেশব্যাপী শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন। ১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ এটি স্থাপন করেন শান্তিতে নোবেলজয়ী দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যান্ডেলা, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, তুরস্কের সোলেমান ডেমিরেল ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শিখা চিরন্তন স্বাধীনতাসংগ্রামের জ্বলন্ত স্মারক, বাঙালির শৌর্যবীর্য আর অহংকারের প্রতীক।

জাতীয় স্মৃতিসৌধ
যাদের প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতার সূর্যোদয় হয়েছে, সেইসব শহীদের স্মৃতিতে নিবেদিত স্মারক স্থাপনা জাতীয় স্মৃতিসৌধ। ঢাকার সাভারে অবস্থিত এই স্মৃতিসৌধ মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষার এক উজ্জ্বল স্মারক। অসমান উচ্চতা ও স্বতন্ত্র ভিত্তির ওপর সাতটি ত্রিভুজ আকৃতির প্রাচীর নিয়ে মূল সৌধ গঠিত। সর্বোচ্চ স্তম্ভটি সর্বনিম্ন দৈর্ঘ্যরে ভিত্তির ওপর, আর সর্বোচ্চ ভিত্তির ওপর স্থাপিত স্তম্ভটি সবচেয়ে কম উচ্চতার। ১৯৭৯ সালে শুরুর পর ১৯৮২ সালে এই স্মৃতিসৌধের কাজ শেষ হয়। প্রায় ৩৪ হেক্টর (৮৪ একর) জমির ওপর নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভটি। এর স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন।

সাতটি ত্রিভুজ আকৃতির এই মিনারের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের একেকটি ধাপের ব্যঞ্জনা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যা শুরু হয়ে একে একে চুয়ান্ন, ছাপ্পান্ন, বাষট্টি, ছেষট্টি ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় নিদর্শনের মধ্য দিয়ে সাতটি ত্রিভুজ ক্রমানুযায়ী একটি আরেকটির চেয়ে ছোট থেকে বড় রাখা হয়েছে। স্মৃতিসৌধের সাতটি স্তম্ভ বহন করছে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সাত ধাপের ভাবব্যঞ্জনা ও ভাবগাম্ভীর্য।

ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি
বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামের সঙ্গে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে আছে একটি বাড়ি। যে বাড়িটিতে বসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধিকারের সংগ্রামে জাতিকে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। এই বাড়িটি আজ তার নানা স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহনকারী এই বাড়িটি ১৯৯৪ সালে পরিণত হয়েছে জাদুঘরে। জাদুঘরটির নাম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর। 

বঙ্গবন্ধু এই বাড়িতে আসার পর কত গুরুত্বপূর্ণ সভা যে এখানে হয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। কত শত মানুষ যে এখানে এসেছে, বসেছে তার হিসাব কেউ রাখেনি। শুধু বঙ্গবন্ধুর কারণে এ বাড়িটি একসময় হয়ে যায় বাঙালির আশা-আকাঙক্ষা এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখার বাড়ি। মাঝখানে এই বাড়িটি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৮১ সালের ১১ জুন পর্যন্ত বন্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধু শাহাদাতবরণের পর সরকার বাড়িটি সিল করে দেয়।

১৯৬২ সালের আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফার আন্দোলন, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৭১-এর শুরুতে অসহযোগ আন্দোলন, এই সবগুলো ক্ষেত্রেই বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা প্রণয়ন, দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়, সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা শোনা-এ সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু ছিল ৩২ নম্বরের এই বাড়িটি। দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরাও এই বাড়িতে ভিড় করেছেন ’৭১-এর উত্তাল দিনগুলোতে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের সেই ভাষণের রূপরেখাটি বঙ্গবন্ধু তৈরি করেছিলেন এই বাড়ির কনফারেন্স টেবিলে বসে। স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি, তখনো তিনি এই বাড়িটি থেকে রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম পরিচালনা করতেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ২৯ শ্রাবণ ১৩৮২। শুক্রবার ভোরে ফজরের আজান শুরু হয়েছে মাত্র। রাতের অন্ধকারের শেষ রেশটুকু ফিকে হয়ে আসতে শুরু করেছে। শ্রাবণের শেষ দিন। এই বাড়ির সামনের রাস্তায় হঠাৎ সামরিক জিপ, ট্যাংক ও ভারী ট্রাকের ছোটাছুটি শোনা গেল। তারপর গুলি আর গুলি। প্রথমেই খুনিদের একটি দল নিচতলার প্রতিটি ঘরে ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালায়। ঘাতকরা দোতলায় ওঠার সিঁড়ির প্রথম ধাপ পেরিয়ে দ্বিতীয় ধাপে এসে দাঁড়াল। বঙ্গবন্ধু লুঙ্গির ওপর সাদা পাঞ্জাবি পরে সিঁড়িতে এসে দাঁড়িয়েছেন। এমন সময় ঠাঠা গুলি। বঙ্গবন্ধু পড়ে গেলেন লম্বা হয়ে সিঁড়িতে। এরপর ঘাতকের দল শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ একে একে পরিবারের ১৬ জনকে হত্যা করে। 

বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করে। নাম দেয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর। ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয়। এটা এখন আর কোনো সাধারণ বাড়ি নয়। এটি এখন ইতিহাসের বাড়ি।

শহীদ স্মৃতি ভাস্কর্য, চট্টগ্রাম
হালিশহর এলাকার মধ্যম নাথপাড়ায় ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম শহরে প্রথম গণহত্যার ঘটনাটি ঘটে । ইতিহাসের বর্বরোচিত এই গণহত্যা সংঘটিত হয় একাত্তরের ৩১ মার্চ। পাকবাহিনীর সশস্ত্র সহযোগিতায় স্থানীয় বিহারি বাসিন্দারা এ হত্যাকা- চালায়। এই হত্যাকা-ে নিরীহ ৩৯ পাড়াবাসীসহ হালিশহর সংলগ্ন তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল (ইপিআর) ক্যাম্পের ৪০ জন সদস্য নিহত হন। ২৫ মার্চ কালরাতের পরপরই ইপিআর ক্যাম্পের সদস্যরা সীমিত শক্তি নিয়েই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শুরু করেন। এ সময় দক্ষিণ হালিশহর এলাকার স্থানীয় জনগণও ইপিআর সদস্যদের সঙ্গে যোগ দেন। পাকবাহিনী খুব দ্রুতই এ খবর পেয়ে বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী এ এলাকায় হামলা চালানোর জন্য অগ্রসর হয় এবং একপর্যায়ে ক্যাম্পসহ গোটা এলাকা ঘিরে ফেলে। ফলে দুর্বল প্রতিরোধ ভেঙে গেলে ইপিআর সদস্যরা সংলগ্ন নাথপাড়ার বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নেন। এরপর পাকবাহিনী ও তার দোসররা নাথপাড়ার ঘরে ঘরে ঢুকে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং গোটা পাড়া আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। নাথপাড়ার এই নির্মম হত্যাযজ্ঞকে স্মরণীয় করে রাখতে ওই স্থানে ‘শহীদ বেদি’ শীর্ষক একটি স্মৃতি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। এর নকশা করেন চিত্রশিল্পী ঢালী আল মামুন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //