পদ্মা সেতু: নিজের টাকায় অসাধ্য সাধন

প্রমত্তা পদ্মায় সেতু নির্মাণের অসাধ্য সাধন করেছে বাংলাদেশ। পাইলের গভীরতা, ফ্রিকশন বিয়ারিংয়ের ক্ষমতা ও নদী শাসনে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছে পদ্মা সেতু। 

পদ্মার মতো খরস্রোতা অশান্ত নদীতে প্রকৃতির বিরূপতা মোকাবেলা করে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণ শেষের পথে। ১০ ডিসেম্বর শেষ স্প্যান স্থাপনের মাধ্যমে পদ্মা সেতুর কাঠামো পূর্ণ দৃশ্যমান হয়েছে। বিভাজক, বিদ্যুতায়ন ও পরিষেবা লাইন বসানোর পর আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে সেতু চালু হবে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা হলেও মূল সেতু নির্মাণে ব্যয় ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। নদী শাসনে ব্যয় আট হাজার ৭০৭ টাকা ও বাকি নয় হাজার ৩৫৩ কোটি ব্যয় হয়েছে জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, পরামর্শক ব্যয়, বেতন-ভাতা, টোল প্লাজা, এপ্রোচ সড়ক, কনস্ট্রাকশন সাইট নির্মাণ বাবদ। নদী শাসন ব্যয়েও পদ্মা সেতু রেকর্ড গড়েছে। ১৪ কিলোমিটার নদী শাসন করে তীর বাঁধাই করা হয়েছে পদ্মা সেতুর জন্য। পৃথিবীতে আর কোনো সেতুর জন্য এত দীর্ঘ নদী শাসন করতে হয়নি।

২০০৯ সালে পদ্মা সেতুর যে নকশা করা হয়, তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা। পরে তা বেড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা হয়। ট্রেন চলাচলের জন্য সেতুকে দ্বিতল করায় এ ব্যয় বেড়েছিল। পরবর্তী সময়ে ব্যয় বেড়ে হয় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি। তৃতীয় দফায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ে নদী খনন করে তোলা বালি ফেলতে জমি অধিগ্রহণে। দ্বিতীয় দফায় আট হাজার কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছিল নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু না হওয়ায়। ২০১১ সালে শুরু হয়ে ২০১৪ সালে সেতুর কাজ করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু বিশ্ব ব্যাংকের কথিত দুর্নীতির অভিযোগে ঋণ চুক্তি বাতিল হওয়ায় কাজ শুরু করা যায়নি। 

এরপর সময় বাড়লেও ব্যয় বাড়েনি। প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতার কারণে ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে কাজের মেয়াদ তিন দফা বাড়ানো হয়। যা আগামী জুনে শেষ হবে। তবে এর মধ্যে ঠিকাদার চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময় চেয়েছে। মূল কাঠামো নির্মাণ হলেও এখনই চালু হচ্ছে না সেতু। দ্বিতল এই সেতুর উপরিভাগে (আপার ডেক) রোডওয়ে স্লাব ও নিচে (লোয়ার ডেকে) রেলওয়ে স্লাব বসানোর কাজ চলছে। এসব কাজ শেষে বিদ্যুতায়ন ও পরিষেবা লাইন স্থাপনের পর সেতু চালু হবে।

পদ্মা সেতু একবার ব্যবহারে মোটরসাইকেলে সর্বনিম্ন ১০৫ টাকা টোল দিতে হবে। প্রাইভেট কারে টোল দিতে হবে এক হাজার টাকা। ছোট বাসে দুই হাজার ২৫ টাকা, বড় বাসে দুই হাজার ৩৭০ টাকা। ছোট ট্রাকে এক হাজার ২০ টাকা। মাঝারি ট্রাকে দুই হাজার ১০০ টাকা, বড় ট্রাকে দুই হাজার ৭৭৫ টাকা, কাভার্ড ভ্যানে চার হাজার টাকা ও ট্রেইলারে সাত হাজার টাকা টোল দিতে হবে একবার পারপারে। ফিরতি পথেও একই পরিমাণে টোল দিতে হবে। গত বছরের আগস্টে সেতু বিভাগ ও অর্থ বিভাগের চুক্তিতে ১৫ বছরের জন্য এই টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। 

প্রশ্ন উঠেছে- নিজের টাকায় নির্মিত সেতু ব্যবহারের জন্য এত টাকা টোল কেন দিতে হবে? টোলের উচ্চ হার নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার পর সেতু সচিব বেলায়েত হোসেন সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, ‘টোল এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সরকার চাইলে টোল কমাতে পারে।’

১৯৯৭ সালে যমুনা নদীর ওপর নির্মিত ৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু সেতুতে ব্যয় হয়েছিল তিন হাজার ৭০০ কোটি টাকা। পুরো টাকাই ঋণ দিয়েছিল জাপান। ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় হবে। বাকি ৩০০ কোটি অনুদান বাবদ পাওয়া গেছে। বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে গত ২৩ বছরে ছয় হাজার ৫৪ কোটি টাকা টোল আদায় করেছে সরকার। এ টাকায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ ও সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। পদ্মা সেতুতে বিদেশি ঋণ নেই। শুধু রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় আছে। তারপরও কেন এত টোল দিতে হবে- এ প্রশ্ন ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে।

বিদেশি অর্থায়নে নির্মিত সেতুর ঋণ পরিশোধ করা হয় টোল আদায় করে। সে ক্ষেত্রে টোল আদায়ে ঋণদাতাদের নানা শর্ত ও পরামর্শ থাকে। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হওয়ায় পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে এমন শর্ত বা পরামর্শ থাকার কারণ নেই। সেতু সচিব বলছেন, পদ্মা সেতুও ঋণে নির্মিত হয়েছে। সেতু বানাতে অর্থ বিভাগ থেকে ২৮ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। এ টাকা ১ শতাংশ সুদে আগামী ৩৫ বছরে শোধ করতে হবে। সেতু সচিব যে ঋণের কথা বলছেন, তা আদতে সরকারেরই টাকা। সরকারি সংস্থা অর্থ বিভাগ আরেক সরকারি সংস্থা সেতু বিভাগকে দিয়েছে। জনগণের দেয়া কর থেকেই সরকার এ টাকা পেয়েছে।

সেতু বিভাগের অধীনে টোল আদায় হয় যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু ও মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর সেতুতে। দেশের বাকি সব সেতু সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) অধীন। এসব সেতু থেকে টোল আদায় হয় টোল নীতিমালা-২০১৪ অনুযায়ী। গাড়ির শ্রেণি ও সেতুর দৈর্ঘ্যরে ভিত্তিতে টোল নির্ধারণ করা হয়। তবে সেতু বিভাগের জন্য আলাদা নীতিমালা নেই। এ সংস্থাটি টোল হার নির্ধারণ করে সেতু নির্মাণের আগে ফেরি পারাপারে যে টাকা ভাড়া দিতে হতো, তার দেড় গুণ হিসেবে। বর্তমানে পদ্মায় ফেরিতে মোটরসাইকেল পারাপারে ভাড়া ৭০ টাকা। তাই পদ্মা সেতুতে টোল ধরা হয়েছে ১০৫ টাকা। 

সেতু বিভাগের যুক্তি হলো, ফেরি পারাপারে আড়াই তিন ঘণ্টা সময় লাগে। আবার ঝড়-বৃষ্টি, কুয়াশা থাকলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরি চলাচল বন্ধ থাকে। নাব্য সংকট হলে দিনের পর দিন অপেক্ষায় করতে হয়। আর সেতুতে ১০ মিনিটে নদী পার হওয়া যাবে। সময় সাশ্রয় হবে। তাই ফেরির ভাড়ার দেড় গুণ টোল খুব বেশি নয়। যদিও বঙ্গবন্ধু সেতুতে মোটর সাইকেলের টোল ৫০ টাকা। গাড়ির ৩০০ টাকা। ছোট বাসে ৬৫০ ও বড় বাসে ৯০০ টাকা। পদ্মায় টোলের হার যমুনার দ্বিগুণেরও বেশি। তবে সেতু সচিব বলছেন, ‘যে সময় সাশ্রয় হবে সেই তুলনায় এই অঙ্ক খুব বেশি নয়। আর ঋণ পরিশোধে টোল না নেয়ার বিকল্প নেই।’

কর্মকর্তারা বলছেন, টোল বেশি হওয়ার কারণ সেতু নির্মাণে বিশাল ব্যয়। ব্যয় নিয়ে ওঠা প্রশ্নের জবাবে এ সেতুর প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, পদ্মা খুবই অস্থির নদী। বারবার গতি পথ পরিবর্তন করে। পদ্মার তলদেশে মাটির মান ভালো নয়। এ কারণেই ব্যয় বেশি হয়েছে। পদ্মা সেতুর ৪২ খুঁটির (পিলার) মধ্যে ডাঙ্গার দুটিতে ১৬টি করে পাইল রয়েছে। নদীর মধ্যে ৪০ পিলারের ২১টিতে ছয়টি করে পাইল। বাকি ১৯টিতে সাতটি করে পাইল। প্রতিটি পাইলের গভীরতা ১১৮ থেকে ১২৮ মিটার।

প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, পৃথিবীতে আর কোনো সেতুতে এত গভীর পাইল করতে হয়নি। নদীর তলদেশে পাথরের স্তর না থাকার কারণেই এত গভীর পাইল করতে হয়েছে। এক একটি পাইলের পাইপের ব্যস তিন মিটারের বেশি। ইস্পাতের পুরুত্ব তিন ইঞ্চি। এই দীর্ঘ পাইপ পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী হাইড্রোলিক হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে নদীতে বসানো হয়েছে। তার মধ্যে বিশেষ ধরনের সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই করা হয়েছে। 

বরিশাল থেকে ভোলা পর্যন্ত নতুন একটি সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হবে শিগগিরই। প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে নয় হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা। দৈর্ঘ্যে পদ্মার চেয়ে চার কিলোমিটার বেশি হলেও ব্যয় তিন ভাগের এক ভাগেরও কম।

পদ্মা সেতুর প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, বরিশাল-ভোলার নদীতে এত প্রতিবন্ধকতা নেই। যা পদ্মায় মোকাবেলায় করতে হয়েছে। পদ্মায় বর্ষাকালে সেকেন্ডে কয়েক লাখ কিউসেক পানি প্রবাহিত হয়। আমাজনের পরই পানি প্রবাহে বৃহত্তম নদী পদ্মা। গত ৩১ জুলাই পানির তোড়ে কয়েক ঘণ্টায় পদ্মা সেতুর কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড সংলগ্ন ১৩ একর জমি তলিয়ে যায়, সাথে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সেতু নির্মাণের ৬০ কোটি টাকার মালামাল। আর কোনো নদীতে এমন পানির তোড় মোকাবেলা করতে হয়নি। 

একজন প্রকৌশলী জানিয়েছেন, ২০১৪ সালে পদ্মায় ৬৫ ফুট দৈর্ঘ্যরে পিনাক-৬ লঞ্চডুবির পর তা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পৃথিবীর কোনো নদীতে এমন ঘটনা ঘটেনি। পদ্মার এমন আচরণের কারণে পুরো সেতু পানির সমান্তরালে বানাতে হয়েছে। এতে খরচ বেড়েছে। নদীর দুই প্রান্তে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ ভায়াডাক্ট নির্মাণ করতে হয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //