ইইউর দ্বিগুণেরও বেশি দামে
করোনাভাইরাস
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২০, ০৮:৫১ এএম
আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২০, ০৮:৫৩ এএম
প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২০, ০৮:৫১ এএম
করোনাভাইরাস
নিজস্ব প্রতিবেদক
আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২০, ০৮:৫৩ এএম
বাংলাদেশ ৭২৫ কোটি টাকারও বেশি অতিরিক্ত খরচ করে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি তিন কোটি ডোজ করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন ক্রয় করছে।
সরকার অবশ্য সরাসরি সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে এ ভ্যাকসিন কিনছে না। বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস সিরাম থেকে এ ভ্যাকসিন কেনার চুক্তি করেছে। পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের মাধ্যমে এ ভ্যাকসিন কিনে নেবে বেক্সিমকো থেকে। এ বিষয়ক একটি চুক্তিও হয়েছে সরকারের সাথে বেক্সিমকো ফার্মার। সরকার বেক্সিমকো থেকে প্রতি ডোজ ভ্যাকসিন ৫ ডলারে কিনবে বলে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে সিরাম ইনস্টিটিউট ও বেক্সিমকো ফার্মাসিউক্যালসের ব্যবসা রয়েছে।
ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট অ্যাংলো-সুইডিশ বহুজাতিক কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকার সম্ভাব্য ভ্যাকসিনটি অনুমতি নিয়ে ভারতে উৎপাদন করবে। তবে বাংলাদেশ সরকার যদি অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনটি সরাসরি অ্যাস্ট্রাজেনেকা থেকে কিনতে পারতো, তাহলে প্রতি ডোজ ভ্যাকসিন ১.৭৮ ইউরোতে (২.১৫ ডলার) অথবা এর কাছাকাছি দামে কিনতে পারতো বলে মনে করছেন বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যবিদরা।
গত ১৯ ডিসেম্বর ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান বেলজিয়ামের বাজেট বিষয়ক স্টেট মিনিস্টার ইভা ডি ব্লিকারকে উদ্ধৃত করে করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের দাম বিষয়ক একটি নিউজ প্রকাশ করেছে। ইভা ডি ব্লিকার ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে করোনাভাইরাসের বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে সম্পাদিত একটি গোপনীয় দাম উল্লেখ করেন তার টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে। যদিও কিছুক্ষণ পর তিনি ওই টুইট বার্তাটি মুছে দেন; তার ফলোয়াররা ওই টুইটের স্ক্রিনশট নিয়ে রাখেন ও শেয়ার করেন।
টুইট বার্তায় ইভা ডি ব্লিকার অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রতি ডোজ ভ্যাকসিনের দাম উল্লেখ করেছেন ১.৭৮ ইউরো (১.৬১ পাউন্ড)। জনসন অ্যান্ড জনসনের ভ্যাকসিন ৮.৫০ ডলার (৬.৩০ পাউন্ড), সানোফি-জিএসকের ভ্যাকসিন প্রতিটি ৭.৫৬ ইউরো, ফাইজার-বায়োএনটেক ১২ ইউরো, কিউরভ্যাক ১০ ইউরো এবং মডার্নার ভ্যাকসিন প্রতি ডোজ ১৮ ডলার বলে উল্লেখ করেন। ইভা উল্লেখ করেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রতি ডোজ ভ্যাকসিনের জন্য ১.৭৮ ইউরো (২.১৫৩৮ ডলার) দিতে সম্মত হয়েছে।
বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যবিদ ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক সরকারের বেশি দামে ভ্যাকসিন কেনার বিষয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ সিরামের করোনা ভ্যাকসিন প্রাপ্তির চেষ্টা না করে সরাসরি অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে চুক্তি করতে পারলে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারতো।’ সিরাম-বেক্সিমকোর মাধ্যমে ভ্যাকসিন আনতে গিয়ে বাংলাদেশকে প্রতি ডোজ ভ্যাকসিনে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে ২.৮৪৬২ ডলার। টাকার অঙ্কে প্রতি ডোজ ভ্যাকসিনে বাংলাদেশকে বেশি দিতে হবে ২৪১.৯৩ টাকা। এই হিসেবে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিনে বাংলাদেশকে বেশি ব্যয় করতে হবে ৭২৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকার (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা হিসেবে) বেশি। সিরাম-বেক্সিমকো থেকে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কিনতে বাংলাদেশকে ১৫ কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে। ১৫ কোটি ডলারে বাংলাদেশি টাকায় হয় এক হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। সরাসরি অ্যাস্ট্রাজেনেকা থেকে ভ্যাকসিন আনতে পারলে এই তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দামেই বাংলাদেশকে ব্যয় করতে হতো ৫৪৯ কোটি ২২ লাখ টাকা অথবা এর কাছাকাছি কোনো অঙ্ক। তবে ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘দরিদ্র দেশ হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দামে হয়তো বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হতো না। আরও কম দামে বাংলাদেশ পেতে পারতো সরাসরি ওই কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করতে পারলে। প্রথমদিকে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে চুক্তি করতে পারলে লাভবান হতো; কিন্তু আমরা সে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করিনি। তবে এখনো সময় আছে অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে চুক্তি করে কম দামে বাংলাদেশ ভ্যাকসিন নিয়ে আসতে পারে।’
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন তৈরির শুরু থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বিনিয়োগ নিয়েছে। ফলে শুরু থেকে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ঘোষণা দিয়েছে- তারা করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন থেকে কোনো মুনাফা করবে না। এই কোম্পানির ভ্যাকসিনের নেতৃত্বদানকারী গবেষক প্রফেসর সারা গিলবার্টও ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি ভ্যাকসিন উন্নয়নে কোনো অর্থ নেবেন না। অ্যাস্ট্রাজেনেকা অথবা সারা গিলবার্টের টিম শুধু খরচের জন্য যা প্রয়োজন, তা-ই নেবে। এসব কারণে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে এই ভ্যাকসিনটি অন্য যে কোনো ভ্যাকসিন থেকে কম দামে পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের আরও ভ্যাকসিন লাগবে। পরবর্তী ধাপের কেনায় সরকার সরাসরি অ্যাস্ট্রাজেনেকা থেকে ভ্যাকসিন নিয়ে আসতে পারে।
ভ্যাকসিন প্রাপ্তির অন্যান্য চেষ্টা
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী ভ্যাকসিন বিষয়ক আলোচনায় বলেছেন, সরকার সব ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। তবে দৃশ্যত বেক্সিমকোর মাধ্যমে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি করা ছাড়া সরকার আর কোনো কোম্পানির সঙ্গে ভ্যাকসিন সংগ্রহের চুক্তি করতে পারেনি।
তবে গত ২১ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ সচিব আনোয়ারুল ইসলাম স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেককে উদ্ধৃত করে জানান, আগামী মে-জুনের মধ্যে সাড়ে চার কোটি ভ্যাকসিন আসবে। এটি সিরাম ইনস্টিটিউটের তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের অতিরিক্ত। নতুন ঘোষিত ভ্যাকসিন কোন দেশ থেকে বা কোন কোম্পানি থেকে আসছে তা উল্লেখ করেননি আনোয়ারুল ইসলাম।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে উপযোগী হলো অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন। এই ভ্যাকসিনটি ৪ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যাবে। ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মানুষকে ফাইজার-বায়োএনটেকের ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছে। ওই ভ্যাকসিনটি মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (মাইনাস ৯৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) অথবা এর চেয়ে আরও নিচের তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। এভাবে সংরক্ষণ করার সুযোগ-সুবিধা বাংলাদেশে নেই। সে কারণে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের উচিৎ অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন আনা। আর তা আনা দরকার মূল কোম্পানি থেকে, বেশি দামে ভারত থেকে নয়।
বাংলাদেশ কি শুধু বেসরকারি ব্যবস্থাপনাতেই ভ্যাকসিন আনতে যাচ্ছে? এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট- সিরাম থেকেই বাংলাদেশ ভ্যাকসিন আনতে যাচ্ছে। দৃশ্যত আর কোনো কোম্পানির সাথে চুক্তি করা সম্ভব হয়নি। বেক্সিমকোর এমডি নাজমুল হাসান, এমপি বাংলাদেশের একটি সংবাদমাধ্যমকে সিরামের ভ্যাকসিন ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের নোভাভ্যাক্স থেকেও তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন আনা হবে বলে জানিয়েছেন, যা সরকার পরে বেক্সিমকোর কাছ থেকে কিনে নেবে।
এছাড়া ভারতের নিজস্ব চারটি কোম্পানি ভ্যাকসিন তৈরির দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। চূড়ান্ত হলে সেখান থেকেও হয়তো ভ্যাকসিন আনতে পারে বাংলাদেশ। ওই ভ্যাকসিনগুলোর তৃতীয় দফার ট্রায়ালও বাংলাদেশে হতে পারে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয় শঙ্করকে উদ্ধৃত করে গত ২৯ সেপ্টেম্বর ইউএনবির খবরে বলা হয়, বাংলাদেশ ভারতীয় ভ্যাকসিনের ট্রায়াল করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
মোদ্দা কথা হলো- অবস্থাদৃষ্টে বাংলাদেশকে এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিনের জন্য ভারতের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh