ফিরে দেখা ২০২০

ভূরাজনীতির লড়াইয়ের বছরে বেকায়দায় বাংলাদেশ

ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বিদায়ী বছরে অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল। কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিলকে কেন্দ্র করে উত্তেজনার সূত্রপাত। তারপর লাদাখ সীমান্তে ভারত ও চীনের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় উত্তেজনা আরো বিস্তৃত হয়। 

তবে উত্তেজনা চলছিল অনেক আগে থেকে চীনের সাথে পাকিস্তানের সিল্করোড করিডোর নির্মাণকে কেন্দ্র করে। চীনের সাথে ভারতের একবার যুদ্ধ হয়েছে। পাকিস্তানের সাথে ভারতের যুদ্ধ হয়েছে তিনবার। ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় বিবেচনায় এই অঞ্চল আগে থেকেই স্পর্শকাতর। এক ধরনের সহাবস্থানের কালচার গড়ে উঠলেও, মাঝে মধ্যে এতে উত্তেজনা দেখা দেয়। সেই উত্তেজনা প্রশমনে অনেক সময় লেগে যায়। 

নিকটবর্তী ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে তাদের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় বেকায়দায় পড়ে বাংলাদেশ।

ভারত, পাকিস্তান, চীনের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় শামিল হচ্ছে। বিশেষ করে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস) গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সাথে সখ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার প্রতিটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আলাদা ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রয়েছে। এখন সবাই চায় বাংলাদেশকে নিজের বলয়ের মধ্যে রাখতে। এর সঙ্গে ভারসাম্য রাখতে গিয়ে বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশকে। প্রভাবশালী দেশগুলো বাংলাদেশের গতি-প্রকৃতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে। কোনো এক দিকে একটু বেশি ঝুঁকে পড়লে অন্য দেশগুলো সেখান থেকে দূরে সরাতে চেষ্টা চালায়। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ এ বিষয়টি বেশি মোকাবেলা করছে চীনের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার ক্ষেত্রে। 

বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে চীনের অবদান রয়েছে। বিশেষ করে অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে চীন বর্তমানে বেশি ঋণ দিচ্ছে। পদ্মা সেতুসহ বড় বড় সেতু নির্মাণে চীনের অর্থায়ন ও প্রযুক্তিগত সহায়তা রয়েছে। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশ সফরে এসে বাংলাদেশ-চীন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কৌশলগত সহযোগিতায় উন্নীত হয়েছে বলে ঘোষণা দেন। চীনের সবচেয়ে বড় প্রকল্প বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) যোগদান করে বাংলাদেশ। মেরিটাইম সিল্করোড উদ্যোগেও চীনের সাথে যোগ দেয় বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য চীনের সাথে সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন নয়; বাংলাদেশের সমরাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামাদির বেশিরভাগই চীন থেকে ক্রয় করা হয়। চীন থেকে বাংলাদেশকে একটি সাবমেরিন দেওয়ার পর ভারতে রীতিমতো হইচই পড়ে যায়। 

রাজনৈতিক পর্যায়েও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের দিকে কিছুটা হলেও ঝুঁকেছে বাংলাদেশ। একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পর পশ্চিমারা হতাশা ব্যক্ত করে; কিন্তু ভারত ওই নির্বাচনকে সমর্থন করে। একক কোনো দেশের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে সরকার টিকে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ। এটি নিশ্চয়ই সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের জানা রয়েছে। সরকার তাই সবগুলো ডিম এক ঝুড়িতে রাখতে চায়নি। নতুন নতুন জানালা খোলার চেষ্টায় আছে। তার অংশ হিসেবে চীনের সাথে সম্পর্ক জোরালো করা হচ্ছে বলে ধারণা করা যায়। কেননা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো কারণে ভারত যদি সমর্থন প্রত্যাহার করে, সেক্ষেত্রে চীনের সমর্থন তখন কাজে লাগবে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির আরেকটি বড় কারণ- রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের সহায়তা নেওয়া। মিয়ানমারের ওপর চীনের প্রভাব অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বেশি। ফলে চীনের সহায়তা জরুরি।

মুশকিল হলো- চীনের সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধির কারণে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুবই নাখোশ। তাই চীনকে দূরে সরাতে ভারত অনেক বেশি সক্রিয় তৎপরতা শুরু করে। লাদাখে ভারত ও চীনের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ভারত তাই ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও নিবিড় করার চেষ্টা করছে।

বিদায়ী বছরে মহামারির মধ্যেই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বাংলাদেশ সফরে আসেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বছরের শেষে ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে ভার্চুয়াল বৈঠক করেন। নতুন বছরে মার্চে বাংলাদেশ সফরে আসছেন মোদি। আসন্ন এ সফর ঘিরেও চলবে নানান প্রস্তুতি। ফলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককেও যথেষ্ট মূল্য দেয় বাংলাদেশ। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে ভারত অনেক বেশি নাক গলানোর চেষ্টা করে। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য ভারত ফ্যাক্টর এই সময়ে অনেক বেশি সক্রিয়। সার্বিক বিবেচনায় ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্যের একটি সংকট চলছে। এই ভারসাম্য মেলানো যথেষ্ট দুরূহ কাজ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিদায়ী বছরে নির্বাচন হয়েছে। আগামী ২০ জানুয়ারি জো বাইডেনের নেতৃত্বে নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে সরকার বদলে বাংলাদেশের নীতিতে খুব বেশি পরিবর্তন হয় না। যদিও বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের কোনো কোনো নীতি নির্ধারকের মনে ‘ইউনূস ফ্যাক্টর’ কাজ করে।

নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে শেখ হাসিনার সরকারের দূরত্ব কারও অজানা নয়। ইউনূসের সাথে হিলারি ক্লিনটনের যোগাযোগের কথা সবারই জানা। এসব যোগ-বিয়োগ করে একটা সমীকরণ করা যায় বটে; কিন্তু বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট কিংবা রিপাবলিকান উভয় প্রশাসন বাংলাদেশের সাথে একই ধরনের সম্পর্ক বজায় রাখে। যদিও ট্রাম্প প্রশাসন ব্যবসা-বাণিজ্যকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছে; তার বিপরীতে বাইডেনের সরকার রাজনীতি, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন, সংখ্যালঘু অধিকার, সন্ত্রাসবাদ প্রভৃতির বিষয়ে সোচ্চার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব দিক দিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের জন্য কিঞ্চিৎ অস্বস্তির কারণ হতে পারে।

অবশ্য ডেমোক্র্যাটদের সাথে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংযোগ বেশি। তাই অভিবাসন নিয়ে নমনীয় বাইডেন প্রশাসনের সাথে সম্পর্কের সেতুবন্ধ হতে পারে বাংলাদেশি ডায়াসপোরা। চীন ফ্যাক্টর নিয়ে ভূরাজনীতির প্রতিযোগিতা কিছুটা হলেও কমতে পারে। এটিও বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক।

এশিয়ায় ভূরাজনীতির উত্তেজনা নিয়ে শেষ হচ্ছে ২০২০ সাল। নতুন বছরে সেই ধারা বজায় থাকা অস্বাভাবিক নয়। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সহযোগিতার ক্ষেত্রে স্থায়ী বন্ধন বজায় রাখার পাশাপাশি কিছুটা বিরতি দিয়ে হলেও একেকটা দেশের কাছ থেকে নিবিড় আর্থিক ও কৌশলগত সহায়তা নিতে হবে। অর্থাৎ ভূরাজনীতির প্রতিযোগিতা চ্যালেঞ্জ হলেও, তার থেকে বেনিফিট আদায়ের কৌশল রপ্ত করা জরুরি।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //