সবার জন্য নিরাপদ বাসস্থানই মুজিববর্ষের লক্ষ্য: প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সবার জন্য নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করাই হবে মুজিববর্ষের লক্ষ্য, যাতে দেশের প্রতিটি মানুষ উন্নত জীবন-যাপন করতে পারে। দেশের ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে ঘর দিতে পারার চেয়ে বড় কোনো উৎসব আর কিছুই হতে পারে না।

তিনি আরো বলেন, এভাবেই মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে সমগ্র বাংলাদেশের গৃহহীনদের নিরাপদ বাসস্থান তৈরি করে দেয়া হবে যাতে দেশের একটি লোক ও গৃহহীন না থাকে। যাতে তারা উন্নত জীবন যাপন করতে পারে, আমরা সে ব্যবস্থা করে দেবো। যাদের থাকার ঘর নেই, ঠিকানা নেই আমরা তাদের যেভাবেই হোক একটা ঠিকানা করে দেবো।

আজ শনিবার (২৩ জানুয়ারি) মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে জমি ও গৃহ প্রদান উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মুল অনুষ্ঠানে সংযুক্ত হয়ে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন।

গণভবনের সাথে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় (পিএমও) ও সারাদেশের ৪৯২টি উপজেলা প্রান্ত ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত ছিল এবং বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করে।

শেখ হাসিনা বলেন, মুজিববষের অনেক কর্মসূচি আমাদের ছিল। সেগুলো আমরা করোনাভাইরাসের কারণে করতে পারিনি। তবে করোনা এক দিকে আশীর্বাদও হয়েছে কারণ আমরা এই একটি কাজের দিকেই নজর দিতে পেরেছি। আজকে এটাই আমাদের সব চেয়ে বড় উৎসব।

তিনি বলেন, আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে তারপরেও সীমিত আকারে আমরা করে দিচ্ছি ও একটা ঠিকানা আমি সমস্ত মানুষের জন্য করে দেবো। কারণ আমি বিশ্বাস করি যখন এই মানুষগুলো ঘরে থাকবে তখন আমার বাবা ও মা- যারা সারাটা জীবন এদেশের জন্য তাগ স্বীকার করে গিয়েছেন তাদের আত্মা শান্তি পাবে।

তিনি আরো বলেন, লাখো শহীদ রক্ত দিয়ে এদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, তাদের আত্মাটা অন্তত শান্তি পাবে। কারণ এদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করাটাই ছিল আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের একমাত্র লক্ষ্য। আজকে আমি সবচেয়ে খুশি যে এত অল্প সময়ে এতগুলো পরিকারকে আমরা একটা ঠিকানা দিতে পেরেছি। এই শীতের মধ্যে তারা থাকতে পারবে। কেননা আমাদের যারা শরণার্থী (রোহিঙ্গা) তাদের জন্যও আমরা ভাসানচরে ঘর করে দিয়েছি। 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়া যখন ক্ষমতায় ছিলেন, ’৯১ সালের ঘুর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থদেরকেও কক্সবাজার ও পিরোজপুরে আমরা ফ্ল্যাট করে দিয়েছি অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থদেরকেও ঘর করে দিয়েছি এবং সেখানে শিগগিরই আরো একশ’টি ভবন তৈরি করা হবে। আজ এক লাখ ৬৬ হাজার ১৮৯ টি ঘর করে দিলাম ও শিগগিরই আরো এক লাখ ঘর আমরা করে দেব।

অনুষ্ঠানে সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ওপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি পরিবেশিত হয়। প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার কাঠালতলা গ্রাম, নীলফামারি জেলার সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুর গ্রাম, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট ও চাপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার উপকারভোগীদেও সাথে মতবিনিময় করেন।

প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সারাদেশের বিভিন্ন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা উপকারভোগীদের মাঝে বাড়ির চাবি ও দলিল হস্তান্তর করেন।

পিএমও সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া ভিডিও কনফারেন্সটি সঞ্চালনা করেন। প্রধানমন্ত্রী এই স্বল্প সময়ে সফলভাবে গৃহনির্মাণ ও কাগজপত্র তৈরির মতো জটিল কাজ ঠিকাদার নিয়োগ না দিয়ে সম্পন্ন করতে পারায় জেলা প্রশাসন ও তার দফতর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানান।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এত দ্রত সময়ে পৃথিবীর কোনো দেশে কোনো সময় কোনো সরকার একসাথে ৬৬ হাজার ১৮৯টি ঘর করে দিয়েছে কি-না আমার জানা নেই। যেহেতু যারা প্রশাসনে রয়েছেন তারা সরাসরি ঘরগুলোর তৈরি করেছেন তাই সম্ভব হয়েছে ও মানসম্মত হয়েছে, সেজন্য সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, আমাদের সরকারি কর্মচারীরা যেভাবে সবসময় আন্তরিকতার সাথে কাজ করেছেন এটা অতুলনীয়। আর সেই সাথে আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, মেয়র থেকে শুরু করে সকলে সহযোগিতা করেছেন। এই একটি কাজে আমরা দেখেছি সকলের সম্মিলিত প্রয়াস। তাই আজ আমরা এত বড় একটা দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি।

তিনি বলেন, এই গৃহায়ন প্রকল্পে কোনো শ্রেণি বাদ যাচ্ছে না, বেদে শ্রেণিকেও আমরা ঘর করে দিয়েছি। হিজড়াদের স্বীকৃতি দিয়েছি ও তাদেরকেও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দলিত বা হরিজন শ্রেণির জন্য উচ্চমানের ফ্লাট তৈরি করে দিচ্ছি। চা শ্রমিকদের জন্য করে দিয়েছি- এভাবে প্রত্যেকটা শ্রেণির মানুষের পুনর্বাসনে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

এদিন ভিক্ষুক, ছিন্নমূল ও বিধাবাসহ ৬৬ হাজার ১৮৯টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে জমি ও গৃহ প্রদান করা হয়। সরকার মুজিববর্ষ উপলক্ষে গৃহহীনদের জন্য এক হাজার ১৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬৬ হাজার ১৮৯টি বাড়ি নির্মাণ করেছে। একইসাথে ৩ হাজার ৭১৫টি পরিবারকে ব্যারাকে পুনর্বাসন করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অধীন আশ্রয়ন প্রকল্প মুজিববর্ষ উদযাপনকালে ২১টি জেলায় ৩৬টি উপজেলায় ৪৪টি প্রকল্পের অধীনে ৭৪৩টি ব্যারাক নির্মাণ করে তিন হাজার ৭১৫টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করছে। ইতোমধ্যে সারাদেশের ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এ তালিকা অনুযায়ী গৃহ নির্মাণ ও পরিবার পুনর্বাসনের কার্যক্রম চলবে।

উপকারভোগী প্রতিটি পরিবারকে দুই শতক জমির রেজিস্ট্রার্ড মালিকানা দলিল হস্তান্তরসহ নতুন খতিয়ান ও সনদ হস্তান্তর করা হয়। প্রতিটি জমি ও বাড়ির মালিকানা স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে দেয়া হয়েছে।

প্রতিটি দুই রুমের সেমি পাকা টিনশেড বাড়িতে রান্নাঘর, টয়লেট, বারান্দাসহ বিদ্যুৎ ও পানির নাগরিক সুবিধা রয়েছে। গ্রোথ সেন্টারের পাশে হওয়ায় প্রকল্প এলাকায় পাকা রাস্তা, স্কুল, মসজিদ-মাদ্রাসা ও বাজার রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা তার সাড়ে তিন বছরের দেশ পরিচালনায় যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ পুনর্গঠনকালে যে সংবিধান প্রণয়ন করেন তার ১৫(ক) অনুচ্ছেদে দেশের প্রতিটি নাগরিকের বাসস্থান পাওয়ার অধিকারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে যান। জাতির পিতা গৃহহীন-অসহায় মানুষের পুনর্বাসনে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।

তিনি বলেন, জাতির পিতা ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালী জেলার (বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলা) চরপোড়াগাছা গ্রাম পরিদর্শনে যান এবং ভূমি ও গৃহহীন অসহায় মানুষের পুনর্বাসনের নির্দেশ দেন। তার নির্দেশনাতেই ভূমি ও গৃহহীন, ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত সরকার ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালীন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ’৯৭ পরবর্তী সময়ে চালু করা আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ভূমিহীনদের ঘর দেয়ার প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সময় বাংলাদেশের জন্য একটি অন্ধকার যুগ ছিল। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, নৈরাজ্যের কারণে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল।

সে সময়ে বিরোধী দলে থাকলেও বিনাকারণে কারাবন্দি হওয়ার স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বন্দি হয়ে গেলাম আমি। তারপরেও আমি আশা ছাড়িনি, আল্লাহ একদিন সময় দেবে ও এদেশের মানুষের জন্য কাজ করতে পারবো।

তিনি ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে জয় যুক্ত করায় পুনরায় জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করে বলেন, নৌকা মার্কায় ভোট পেয়েছিলাম বলেই জয়ী হয়ে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করতে পারলাম ও পুনরায় আমাদের প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন শুরু করলাম।

করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বের স্থবিরতায় ঘরগুলো হস্তান্তরকালে সশরীরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে না পারার আক্ষেপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইচ্ছে ছিল নিজ হাতে আপনাদের কাছে বাড়ির দলিলগুলো তুলে দেব। কিন্তু এই করোনাভাইরাসের কারণে সেটা করতে পারলাম না। তবে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলেছিলাম বলেই আপনাদের সামনে এভাবে হাজির হতে পেরেছি।

আমাদের দেশের মানুষ যেন অন্ন, বস্ত্র ও উন্নত জীবন পায় সেটা নিশ্চিত করাই জাতির পিতার একমাত্র লক্ষ্য ছিল উল্লেখ করে তিনি ৭৫ পরবর্তী সরকারগুলোর বিশেষ করে সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের তথাকথিত গণতন্ত্রায়নের নামে দেশের বিরাজনীতি করণের ও কঠোর সমালোচনা করেন।

তিনি প্রশ্ন তোলেন, একজন মিলিটারি ডিক্টেটর রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে একদিন ঘোষণা দিল আজকে রাষ্ট্রপতি হলাম, আর সেটাই গণতন্ত্র হয়ে গেল? হ্যাঁ অনেকগুলো রাজনৈতিকক দল করার সুযোগ করে দিলো (যুদ্ধাপরাধী ও কারাগারে আটক খুনী অপরাধীদের) কিন্তু মানুষকে দুর্নীতি করার, মানি লন্ডারিং করার, ঋণ খেলাপি হওয়ার, টাকা ছাপিয়ে নিয়ে সেগুলো ছড়িয়ে দিয়ে ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ বা ‘আই উইল মেইক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট’- তাদের কাজই ছিল এদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলার। আর দরিদ্রকে দরিদ্র করে রাখা ও মুষ্টিমেয় লোককে অর্থবিত্ত করে দিয়ে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করা।

জিয়ার নির্বাচনের নামে প্রহসনের উদাহারণ টেনে ‘হ্যাঁ-না’ ভোটে ‘না’ ভোটের বাক্স না রাখা বা ১১০ শতাংশ ভোট পড়ারও অভিযোগ উত্থাপন করে তিনি বলেন, যারা গণতন্ত্র নিয়ে আজকে কথা বলেন তাদের কাছে আমার এটাই প্রশ্ন- এটা কি করে গণতন্ত্র হতে পারে? একটা দল হলো হাটতে চলতেও শিখলো না (বিএনপি) ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে যে দলের সৃষ্টি তারাই ক্ষমতায় কি করে আসে?

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের দরবারের সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে যেন চলতে পারি, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। এ সময় বাংলাদেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলায় সকলের দোয়া ও সহযোগিতার প্রত্যাশাও পুনর্ব্যক্ত করেন শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভিডিও কনফারেন্স উপলক্ষে সারাদেশের উপজেলা প্রান্তগুলোতে উৎসবের আমেজ পরিলক্ষিত হয়। চারটি স্থানের সাথে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি মতবিনিময় করলেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাগণ তাদের ও স্থানীয় জনগণের ভিডিও বার্তা মূল অনুষ্ঠানে প্রেরণ করেন। নতুন গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সারাদেশের উপকারভোগীদের নিয়ে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। সেইসাথে দেশব্যাপী মিষ্টি মুখ করানো হয় বলেও তথ্য মিলেছে। -বাসস

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //