সম্ভাবনা ও বাস্তবতা: বিদেশে ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং’

বিদেশে কৃষিজমি লিজ নিয়ে এবং দেশ থেকে সেখানে শ্রমিক নিয়ে চাষাবাদ করার কথা ভাবছে সরকার। সম্প্রতি ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং অ্যান্ড জব অপরচুনিটি ফর বাংলাদেশ অ্যাব্রোড’ বিষয়ক সেমিনারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এই ধারণা দিয়েছেন। সেমিনারে বিদেশে জমি কিনে চাষাবাদ বা কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের ওপর ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি উদ্যোগে না হলেও বেসরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশিরা ইতিমধ্যেই আফ্রিকার নানা দেশে কাজ শুরু করেছেন। কেনিয়া, উগান্ডা, জাম্বিয়াা, সেনেগাল, লাইবেরিয়া, আইভরি কোস্ট এবং ঘানার মতো দেশগুলোতেও কৃষিজমি নিয়ে চাষাবাদের ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে; কিন্তু নানা জটিলতার কারণে ১০ বছর আগে থেকেই উদ্যোগ নেওয়া প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখনি। ভবিষ্যতেও দেখবে কি-না, সে বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।

সেমিনারে ২০১২ সালে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে নিজের সফরের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘দেশটি বাংলাদেশের চেয়ে সাড়ে পাঁচ গুণ বড়; কিন্তু ফসল ফলে না এবং যুদ্ধের কারণে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয় তারা। সেখানে আমাদের দেশের মতো বৃষ্টি হয় ও মাটি উর্বর। আমি সেখানকার প্রেসিডেন্টকে বলেছিলাম, আপনার জমি আমাদের দিন, আমরা কৃষক আনব, যারা এখানে ফসল ফলাবে। জবাবে প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন দশ হাজার লোকের জন্য জমি বর্গা দিতে রাজি আছেন তারা; কিন্তু তারপর আর বিষয়টি এগোয়নি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কর্মকর্তারা অনেক দেশে গেছেন কৃষিকাজ দেখার জন্য; কিন্তু সেগুলোও বেশি অগ্রসর হয়নি।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের সেখানে বিনিয়োগ করতে হবে। কৃষিজমি নিতে হবে। নিজেদের লোক সেখানে নিতে হবে। আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে সেই সুযোগ তৈরি করা যায়। সুদানের সঙ্গে আলাপ করেছি। কেনিয়া জমি দেবে এমন প্রস্তাব আসছে। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের কোনো টাকাও লাগবে না।’

বাংলাদেশি একটি প্রতিষ্ঠান পূর্ব আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ায় ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে ধান, ভুট্টা ও ডালের আবাদ শুরু করে ২০১১ সালে। তখন যে চুক্তি হয়েছিল দু’পক্ষের মধ্যে, সেখানে প্রয়োজনীয় শ্রমিকের ৭০ শতাংশ বাংলাদেশ থেকেই নেওয়ার কথা ছিল। এর আগের বছর থেকেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আফ্রিকা-বিষয়ক অনুবিভাগ মহাদেশটির বিভিন্ন দেশে বিপুল পরিমাণ পতিত জমিতে আবাদের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে শুরু করে।

গোলাম মসিহ জানান, বিদেশে বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলোতে জমি কিনে চাষাবাদ করতে পারলে এটি খাদ্য নিরাপত্তায় যেমন ভূমিকা রাখবে, তেমনি বাংলাদেশিদের জন্য কর্মসংস্থানও তৈরি করবে। ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং’ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সরকার উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন দেশে কৃষিজমি কিনবে এবং পরে বাংলাদেশ থেকেই শ্রমিকরা গিয়ে সেখানে কাজ করবে ও ফসল ফলাবে। এটি সরকার সরাসরি বা কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও কিনতে পারে। আর এ জন্য আফ্রিকার দেশগুলোকেই পছন্দের তালিকায় রাখতে হবে।’ এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ‘তাদের অনেক কৃষিজমি অনাবাদি পড়ে আছে। দেশগুলোতে অভাবও রয়েছে। আমরা জমি নিয়ে চাষাবাদ করলে তারাও কম মূল্যে কিনতে পারবে, আবার আমাদেরও কর্মসংস্থান হবে। আবার সেখানকার উৎপাদিত ফসল প্রয়োজনমতো বাংলাদেশেও আনা যাবে। নানা দিক থেকে আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের কিছু মিল আছে। সেখানে প্রচুর ভারতীয় ও পাকিস্তানি আছে, যা বাংলাদেশিদের জন্য সহজ পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রাখবে। আফ্রিকায় প্রচুর জমির পাশাপাশি পানি আছে। আবহাওয়াও আমাদের সঙ্গে মিল আছে। এসব মিলিয়ে চিন্তা করলে বাংলাদেশের জন্য দারুণ সুযোগ অপেক্ষা করছে।’

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম এম আকাশ সরকারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, ‘সরকার ২০১০ সাল থেকেই এই ধরনের একটি কাজ করার চেষ্টা করছে। তবে সরকার আন্তরিক হলে এত সময় লাগত না। আমি ওই সেমিনারে উপস্থিত ছিলাম। রাষ্ট্রদূত মসিহ যে ধারণাপত্র পাঠ করেছেন, সেটি শুধু একটি প্রস্তাবনা মাত্র। ধারণাপত্রটি পড়ে যা বুঝেছি, সরকারিভাবে কিছু করার বিষয়টি এখনো ধারণার পর্যায়ে আছে। আমাদের দেশের বাইরের শ্রমবাজারে নানা সংকট রয়েছে। যে দেশে আপনি জমি লিজ নেবেন, সেই দেশের কৃষি উপকৃত হবে। ধারণাপত্রে উল্লেখ আছে- প্রয়োজনে উৎপাদিত ফসল দেশে আনা হবে। বিদেশে আমাদের টাকায় উৎপাদিত ফসল আমাদের অর্থনীতিকে কীভাবে চাঙ্গা রাখবে, এটিও একটা বিষয়। তবে সরকার যদি সত্যিই আন্তরিক হয়, এ বিষয়ে কর্মসংস্থানের একটি দ্বার উন্মোচন হতে পারে।’

তবে আরেক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘আমাদের দেশেই তো কত জমি অনাবাদি পড়ে আছে। অনেক ফসলি জমি দখল করে গড়ে উঠছে ইটভাটা। পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। সেদিকে আগে মনোযোগ দিতে হবে। বিদেশে জমি লিজ না নিয়ে দেশে কৃষি ভর্তুকি আরও বাড়িয়ে দেওয়া হোক। আমাদের দেশের বেকার যুবশক্তিকে দেশের মাটিতে কৃষি কাজে উৎসাহিত করা হোক। অনেক যুবক এখন কৃষির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে। প্রথমে তাদের উৎসাহিত করতে এবং পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। শুধু সেমিনার করে ধারণাপত্র পাঠ করে দেশের কৃষি এবং অর্থনীতির কোনো অগ্রগতি হবে না।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //