ভাষা আন্দোলনের অর্ধশতাব্দী পর...

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে সময়ের ব্যবধানে আমরা আজ অনেক দূরে এসে পৌঁছেছি। নির্মোহভাবে তাই আজকের দিনে এসে হয়তো বলা যাবে অনেক কথা। 

ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তখনকার দিনের চেয়ে আজও কী কম জরুরি, এ প্রশ্নটিও করা দরকার সর্বাগ্রে। দীর্ঘ সময় পার করে এসেছি আমরা নিজেদের ভাষার কালগত দিক বিবেচনায়। নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য যে আন্দোলন ’৫২-তে হয়েছিল- প্রাণ দিয়েছিল ভাষাপ্রিয় শিক্ষার্থীরা, তাদের সে ত্যাগ আজ কোথায়? 

আমাদের সামাজিকতা যেন সব ধুলোয় মিশেছে। এ মুহূর্তে আমাদের সামাজিক ও জাতীয় জীবনে যে পরিমাণ অসংবেদনা, নিষ্ঠুরতা, গণউষ্ণতা ও কাণ্ডজ্ঞানহীনতা দেখা যাচ্ছে, প্রতিদিন সংবাদপত্রে যত হত্যা ও মৃত্যুর সংবাদ পড়ছি, তাতে কারও মনে সঙ্গতভাবে এমন প্রশ্ন আজ অন্তত দেখা দিতেই পারে: ভাষা আন্দোলনে কটা মানুষই বা মরেছিল, যার জন্য এত বড় একটা হুলস্থুল কাণ্ড বায়ান্ন সালে ঘটে গিয়েছিল! তাজ্জব! আজকাল প্রত্যেক দিন তো গণ্ডায় গণ্ডায় লোক মরছে। তবুও আমরা নিশ্চুপ বসে আছি।

জনৈক আত্মীয়া একবার একটি দামি স্কুলের গল্প বলেছিলেন। গুলশানের নামি ইংরেজি স্কুল সেটি। ইংরেজিভাষী বিদেশিনী দ্বারা পরিচালিত সে স্কুলের শিক্ষার্থীরা প্রত্যাশিতভাবেই বেশ কিছু বিদেশি দূতাবাসের লোকজনের ছেলে-মেয়ে; কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠরা হলো এ দেশের বাঙালি নব্যধনিক শ্রেণির সন্তান। আমার ওই আত্মীয়ার অভিজ্ঞতাও দারুণ হয়েছিল। তাকে এই সত্যের মুখোমুখি হতে হয়েছিল- সে স্কুলের শতকরা ১০জনের বেশি কোনো ছেলে-মেয়ে জানেই না একুশে ফেব্রুয়ারি বা ভাষা-আন্দোলন কী! 

বড় আক্ষেপের বিষয়, এই শিক্ষার্থীরা সবাই কিন্তু বঙ্গসন্তান। তাদের শিক্ষক যখন একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা তাদের শোনাচ্ছিলেন- তখন বছর দশেকের একটি মেয়ে বিরক্তি ভরে বলে ওঠে- ‘ওহ, মিস, ইট হ্যাপেনড সাচ আ লং টাইম ব্যাক!’ অর্থাৎ, দেখো কী কাণ্ড, ফালতু পুরনো কাসুন্দি ঘাটছে! সত্যিই বড় কষ্টকর এই গল্পটি শোনা; কিন্তু এটিই বাস্তবতা। শিক্ষা মাধ্যমে আজ ঢুকে পড়েছে ভিনদেশি ভাষা। যে মা-বাবা তার সন্তানকে বঙ্গের সন্তান বলে পরিচয় দিতে চান না তারাই কী কেবল এমন বিদেশি ভাষায় পড়ালেখা করিয়ে বিদেশে পাঠাতে চান সন্তানকে? তা চাইতেও পারেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে- সবারই নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার রয়েছে; কিন্তু একটি কথা বলে রাখা দরকার, আজকে যে সন্তানকে আপনি বিদেশের জন্য প্রস্তুত করছেন- যে সন্তানকে আপনি সেরা বানাতে চান বিদেশে পাঠিয়ে। সে যে একদিন আপনাকেও ভুলে যাবে না, সেটি কি আপনি গ্যারান্টি দিতে পারবেন? 

আজ সম্মান আর আভিজাত্যের জন্য হয়তো বাংলা শেখাচ্ছেন না, বাংলা স্কুলে পাঠাচ্ছেন না, বাংলা সংস্কৃতি-উৎসব কিংবা ইতিহাসও জানাচ্ছেন না- এমন শেকড় ছেঁড়া সন্তান তো আপনাকেও ছাড়বে, এটিই স্বাভাবিক ঘটনা। জানি না কোন জাতের বাঙালি তারা! বাংলা স্কুলগুলো বরং ইংরেজি অনেকখানি শেখাতে পারে; কিন্তু ইংরেজি মিডিয়ামের স্কুলে বাংলা শেখানো সম্ভবই নয়, কারণ যারা পড়তে আসে তাদের বাবা-মা বাংলাদেশে জন্মালেও তাদের চিন্তায় বা অনুভবে বাংলাদেশ বলে কিছু নেই।

’৫২-এর ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি, মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তখন ঢাকায় যে আগুন জ্বলেছিল তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আর আজ পঞ্চাশ বছর পর, সে আগুন রাজধানী শহরেই জ্বালানো যাচ্ছে না। বাংলা ভাষা চর্চার প্রতি নেই আগ্রহ। কোনো চিন্তাও নেই এ নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে। রেডিও-টেলিভিশন থেকে শুরু করে সব মিডিয়াতে একই দশা। বাংলা সাহিত্যেরও একই দশা।

’৫২ সালের একুশে ও বাইশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় যখন ছাত্রদের মিছিলের ওপর গুলি চলে, তখন আমি তের বছরের বালক মাত্র। মিছিলের মধ্যে আমার বয়সী ছোট ছেলে অনেক ছিল। ঢাকার স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত, সব বিদ্যায়তনের ছেলে-মেয়েরা তখন রাস্তায়। আমার যতটা মনে পড়ছে, আলিয়া মাদ্রাসা পড়ুয়ারাও ছিল। মনে পড়ে এ জন্য যে, লক্ষ্মীবাজারের নেতাজী সুভাষচন্দ্র রোডের ওপর চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে আলিয়া মাদ্রাসাও ছিল এবং আমি অন্য তিনটির মধ্যে একটিতে পড়ছি। বলতে চাইছি, সব রকমের ছাত্র ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল ওই সব মিছিল ও আন্দোলনে। 

আমি বলতে চাইছি- এতটা সহজেই কী সেদিনের সেই মিছিল বেরিয়েছিল? এতটাই কী সহজ মিছিল করে গুলি খাওয়া? তা তো হওয়ার নয়। তবে কেন গুলি বুকে নিয়েছিল সেদিনের স্বর্ণসন্তানরা? এর কারণ একটিই- এই ভাষা তার মায়ের। এ সেই মা, যে মায়ের বুকে সে বড় হয়েছে। মাকে পৃথিবীর সব জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ ভালোবাসে জানি। তবে বাঙালিরা বোধহয় একটু বেশিই ভালোবাসে। না হলে বুকের রক্ত ঢেলে মায়ের ভাষা কেড়ে নেওয়ার ঘোষণায় এমন প্রতিরোধ কোন জাতি গড়েছে? কোনো জাতিকে ধ্বংস করার প্রথম পদক্ষেপই তো ভাষা। সেই ভাষার ওপরেই প্রথম আঘাত হেনে জনাব জিন্নাহ ঠিক করেননি, পেয়ে গেলেন জবাব সঙ্গে সঙ্গে। 

ভাবুন, যে পাকিস্তানের জন্য সবাই এক হলো সেই ধর্মভিত্তিক দেশ পাকিস্তান আঘাত করতে করতে চাইল তারই দেশের আরেকটি সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষার ওপর। এ তো ঘোর অপরাধ, এ অপরাধ-অন্যায় মানেনি দামাল ছেলেরা, তাই তো রুখে দিয়েছিল সেদিন তারা। ফলে ঢাকার রাজপথে ওরকম গণজাগরণের উত্তাল মিছিল সম্ভব হয়েছিল।

দুই

ভাষা-আন্দোলন নিয়ে এখন অবধি বিভিন্ন বই-পত্র যেমন কম হয়নি, তেমনি এ নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণও কম হয়নি। বিপুলা এ বঙ্গে তবুও কেন বাংলা ভাষার প্রতি দরদ তৈরি হয়নি বাঙালি জাতির এ নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন রয়ে যায়। ভাষা-বিষয়ক বিভিন্ন বইয়ের পাঠ শেষে এটুকু বুঝতে পারি যে, ভাষা আন্দোলনের যেসব কারণ ছিল তার একটি হলো- ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হওয়ার পশ্চাতে রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানাবিধ কারণের সম্মিলিত মিথষ্ক্রিয়া কার্যকর ছিল। 

দ্বিতীয়টি হলো- এই ভূখণ্ডের মানুষজনের ভেতরে বাঙালি জাতিসত্তার উপলব্ধি প্রথম অঙ্কুরিত হয় এই ঘটনা থেকে, বা বঞ্চনার ইতিহাস বাঙালির মনে পড়ে, ফলে ’৫২-তে তার বিস্ফোরণ ঘটে। পূর্ব বাংলার মুসলমানরা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল; কিন্তু নিজের ভাষা জলাঞ্জলি দিয়ে নয়, ফলে আন্দোলন বেগবান হয়েছিল। 

একটি কথা আমরা সবাই জানি, একাত্তরে আমরা যে মুক্তি পেয়েছিলাম তার প্রথম ফুলটি ফুটেছিল এই ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আর একটি জাতি বিশ্ব পরিসরে তার মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে তখনই, যখন সে তার নিজের ভাষা-সংস্কৃতিতে শক্তিশালী অবস্থানে থাকে। বাংলা সাহিত্য তো এত কম কিছু নয়- প্রাচীন চর্যাপদ থেকে পাঠ করে দেখুন কত নিখুঁত সে বুনন, তবুও আমরা কেন হীনম্মন্যতায় ভুগি তা বুঝতে পারি না। 

আমরা যতদিন না নিজের ভাষার মর্যাদা দিতে পারব জাতি হিসেবে ততদিন আমরা পিছিয়েই থাকব। ফলে একুশের অঙ্গিকার হোক- বাংলাভাষা শেখার, বাংলা ভাষা জানার।

লেখক : কবি, প্রবন্ধকার

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //