বিচারহীনতায় বাড়ছে সংখ্যালঘু নির্যাতন

স্বাধীনতার ৫০ বছরেও ক্রমাগত হয়রানি, হুমকি ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বিভিন্ন জাতিসত্তা, ভাষা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।

সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিপীড়নের অভিযোগ নতুন করে সামনে এসেছে। এর আগেও কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, কুমিল্লার মুরাদনগর, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, ঢাকার মিরপুরে বিহারিদের ওপর, পাবনার সাঁথিয়া, রংপুরের গঙ্গাচড়া, দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা দেশে-বিদেশে বেশ আলোচিত হয়েছিল। 

সাধারণভাবে এসব নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনায় বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন ও দলগুলোকে দায়ী করা হয়েছিল। আবার অনেকেই মনে করে থাকেন, সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি যতটা না ধর্মীয়, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক। 

মূলত ক্ষমতাসীনরা সংখ্যালঘুদের জমি-জমা দখল নিতে ও নিজেদের অপরিহার্যতা প্রমাণের কৌশলের অংশ হিসেবেই নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে রাজনৈতিক রূপ দেয়। আর এসব কারণেই যেকোনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনার পর তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও রাজনীতি হয়; কিন্তু ঝুলে থাকে এর বিচার। নেপথ্যে ক্ষমতাসীনরা জড়িত থাকায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা যায় না বলেও অভিযোগ আছে। প্রায় প্রতিবছরই ঘটে যাওয়া এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সবগুলোর পেছনেই মূলত সম্পদ দখলের রাজনীতি। নতুন ইস্যুতে পুরনো ঘটনা চাপা পড়া ও রাষ্ট্র নিশ্চুপ থাকায় হামলাকারীরাও প্রশ্রয় পায়।

২০২০ সালের উপাত্ত দিয়ে বছর শেষে সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, তা সত্যিই উদ্বেগের। সংগঠনগুলোর দাবি, বিদায়ী বছরে সারাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৪৯ জনকে হত্যা করা হয়। এছাড়া ২৪৪টি পরিবার ও মন্দিরে লুটের অভিযোগও রয়েছে। এর মধ্যে কেবল লুটের ঘটনাতেই ক্ষতি হয়েছে ১ হাজার ৩২২ কোটি ২১ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। 

প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়, গেল বছর বসতবাড়ি হামলা ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে ৪৫৪টি। অগ্নিসংযোগ ১১৬টি ও ১০১টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটেছে। ভূমি দখল হয়েছে ১০ হাজার ২৩৬ দশমিক ৭৩ একর; যার মধ্যে চাক, ম্রো ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ৮ হাজার ২০০ একর ও হিন্দুদের ২ হাজার ২৩৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ জমি রয়েছে। ঘরবাড়ি দখলের ঘটনা ঘটেছে ৭০টি। নিজের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে ২ হাজার ১২৫ পরিবারকে। উচ্ছেদের চেষ্টা হয় ১ হাজার ৭১৩ পরিবার, উচ্ছেদের হুমকি আসে ২ হাজার ৯৩ পরিবার ও আটটি ম্রো ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা গ্রামে। দেশত্যাগের বাধ্য করা হয়েছে ৬২৯ পরিবারকে। আর ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২০ সালে হিন্দু নির্যাতন বেড়েছে কয়েকগুণ।

নন্দ ঘোষ ফেসবুক 

বেশ কয়েক বছর ধরেই ফেসবুক স্ট্যাটাসকে ঘিরে দেশে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটছে। শুরুটা হয়েছিল ২০১২ সালে। পবিত্র কোরআন শরীফকে অবমাননা করে স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছে- এ অভিযোগে ওই বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রামুতে হামলার ঘটনা ঘটে। সেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বৌদ্ধপল্লিতেও। দু’দিনের ওই সহিংস ঘটনায় আহত হন বহু বৌদ্ধধর্মাবলম্বী, ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৯টি বৌদ্ধবিহার। তখন এলাকা ও দেশত্যাগ করে কয়েকটি বৌদ্ধ পরিবার। যার বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল, সেই উত্তম কুমার বড়ুয়ারও কোনো খোঁজ নেই। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ এনে ২০১৩ সালে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বনগ্রাম বাজারে অর্ধশত হিন্দু বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। যদিও পুলিশের তদন্তে এমন কোনো পোস্ট পাওয়া যায়নি বলেই উঠে আসে।

রসরাজ দাস নামের একজনের ফেসবুকে উস্কানিমূলক ছবি পোস্টকে ঘিরে ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে তাণ্ডব চালানো হয়। সেই হামলায় একজন নিহত হন। আটটি হিন্দুপাড়ায় ভাঙচুর করা হয়েছিল অন্তত ৩০০ বাড়ি-ঘর, মন্দির ও দেবতার মূর্তি। অনেকেরই ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় হামলাকারীরা। আতঙ্ক নিয়ে অনেকেই চলে গেছেন এলাকা ছেড়ে। নাসিরনগরের এ হামলার নেপথ্যে ক্ষমতাসীন দলে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও তার ভাই জড়িত বলেও অভিযোগ রয়েছে। 

মহানবীকে নিয়ে ফেসবুকে এক হিন্দু যুবকের পোস্টকে কেন্দ্র করে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় হিন্দুপাড়ায় হামলার ঘটনা ঘটে। ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বরের সেই ঘটনায় এক ব্যক্তির মৃত্যুও হয়। ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় এক হিন্দু যুবকের ফেসবুক ম্যাসেজের জের ধরে ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর সৃষ্ট তাণ্ডবে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান অন্তত চারজন। সেই যুবক আগেই থানায় গিয়ে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক হওয়ার কথা জানিয়ে জিডি করেছিলেন। তদন্ত করে পুলিশও তাই জানিয়েছে। 

শাল্লায় কী ঘটেছিল 

সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় গেল ১৫ মার্চ শানে রিসালাত নামে এক সমাবেশের আয়োজন করে হেফাজতে ইসলাম। এতে আমন্ত্রিত হয়ে বক্তব্য দেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় আমির জুনায়েদ বাবুনগরী, নায়েবে আমির নূরুল ইসলাম খান, জুনাইদ আল হাবীব ও যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক। সম্মেলনের পরে মামুনুল হককে নিয়ে নিজের ফেসবুকে কটূক্তি করেন শাল্লা উপজেলার হিন্দু অধ্যুষিত নোয়াগাঁও গ্রামের গুপেন্দ্র দাশের ছেলে ঝুমন দাশ আপন নামের এক যুবক। সাথে সাথে তা ভাইরাল হয়ে যায়। আশপাশের গ্রামের মামুনুল হকের অনুসারীরা জড়ো হয়ে বিক্ষোভ দেখায়। 

এ নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা দেখা দিলে ১৬ মার্চ রাতে ওই গ্রামের কয়েকজন হিন্দু ঝুমনকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়; কিন্তু তাকে আটক করা হলেও এর পরদিন সকাল ৮টায় দিরাইয়ের কয়েকটি গ্রাম থেকে মামুনুল হকের অনুসারী কয়েকশ’ যুবক-কিশোর লাঠিসোঁটা নিয়ে নোয়াগাঁওয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। 

স্থানীয়দের কেউ কেউ আবার বলছেন, হামলার মূল নেতৃত্বে ছিলেন দিরাই উপজেলার নাচনীর ইউপি সদস্য শহীদুল ইসলাম স্বাধীন ও একই গ্রামের পক্কন মিয়া। এর মধ্যে স্বাধীন মেম্বার স্থানীয় বরাম হাওরের কুচাখাই বিলের ইজারাদার। জলমহাল নিয়ে তার সাথে কিছুদিন ধরে ঝুমন দাশসহ নোয়াগাঁও গ্রামে কিছু লোকের বিরোধ চলছিল। কারণ জলমহালে অবৈধভাবে মৎস্য আহরণ ও পানি শুকিয়ে ফেলায় চাষাবাদে সেচের পানির সংকট দেখা দেয়। এ ব্যাপারে হরিপদ দাশ ও মুক্তিযোদ্ধা জগদীশ চন্দ্র দাস শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ৮ জানুয়ারি ওই বিলে গিয়ে অবৈধ শ্যালোমেশিনসহ মাছ ধরার বিভিন্ন উপকরণ জব্দ ও জলমহালের পানি ছেড়ে দেন ইউএনও আল মোক্তাদির হোসেন। সেই দৃশ্য ফেসবুকে প্রচার করেন ঝুমন দাশ। ওই ঘটনার পর থেকে স্বাধীন মেম্বার নোয়াগাঁওয়ের হিন্দুদের হুমকি-ধমকি দিয়ে আছিলেন বলে অভিযোগ আছে। 

সম্প্রতি হেফাজত নেতা মামুনুল হককে নিয়ে ঝুমনের ফেসবুক স্ট্যাটাসকেই কাজে লাগিয়ে প্রতিশোধ নেন স্বাধীন মেম্বার ও পক্কন মিয়া। বলা যায়, মামুনুল হকের অনুসারীদের কাঁধে ভর করে হিন্দুদের বাড়িতে তাণ্ডব চালান তারা। ঘটনার মূলহোতা স্বাধীন স্থানীয় যুবলীগ নেতা। এরই মধ্যে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে। এ ঘটনায় দায়ের দুই মামলায় আরো ৩৩ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, ‘ঘটনার আগের দিন উত্তেজিত মানুষদের দাবির প্রেক্ষিতে ঝুমনকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর উত্তেজিতরা উচ্ছৃঙ্খল আচরণ না করারও প্রতিশ্রুতি দেয়। রাতে নোয়াগাঁও গ্রামের পাশের দারাইন বাজারে শাল্লা থানা থেকে একজন এসআইসহ সাত পুলিশ সদস্যও মোতায়েন করা হয়; কিন্তু গ্রামটি পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বি। কিছু হামলাকারী তাই উত্তর-পূর্ব পাড়ের দিকে প্রবেশ করে ভাঙচুর চালিয়েছে।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘ঝুমনকে গ্রেফতারের পরও কেন মসজিদে মসজিদে প্রচার দিয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের গ্রামে হামলা হয়েছে, সেটি নিবিরভাবে তদন্ত করছে পুলিশ। সেইসাথে এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ওখানে পুলিশ মোতায়েন থাকবে।’

এ প্রসঙ্গে হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘মূলত কতিপয় গণমাধ্যম যাচাই-বাছাই ছাড়াই শাল্লায় হিন্দুদের বাড়িঘরে চালানো তান্ডবের সাথে হেফাজতকে দায়ী করে সংবাদ প্রচার করেছে। অথচ এ হামলার সাথে হেফাজতের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।’ 

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নিমচন্দ্র ভৌমিক জানান, ‘এর আগে রামু, নাসিরনগর, সাঁথিয়া, গোবিন্দগঞ্জ, মুরাদনগরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে। এসব ঘটনার বিচার হয়নি বলেই সুনামগঞ্জের শাল্লায় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হয়েছে। তাদের সহায়-সম্পত্তি লুট করা হয়েছে।’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলেন, ‘হামলার আগে এলাকায় সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে যে সুসম্পর্ক থাকে, সেটি আর ফিরে আসে না। নষ্ট হয়ে যায় একে অপরের প্রতি আস্থা, জায়গাটা তাদের জন্য আর স্বস্তিকর ও নিরাপদ থাকে না। জীবনের নিরাপত্তার জন্য তাই অনেকে চুপি চুপি এলাকা বা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //