করোনায় বেকায়দায় নিম্নআয়ের মানুষ

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বছর ঘুরে আবার এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ব্যাপকহারে বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার। 

কিন্তু এই সংক্রমণ বৃদ্ধি নিম্নআয়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। অধিকাংশ মানুয়ের আয় কমে এবং কারও কারও আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। টিকে থাকতে সঞ্চয় ভাঙতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। 

যাদের সঞ্চয় নেই, তারাও ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। নাজুক পরিস্থিতির কারণে ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়েছেন অনেকেই। অন্তত ৮০ শতাংশ প্রান্তিক মানুষ আগের তুলনায় খাবার গ্রহণ কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। 

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রথম ধরা পড়ে গত বছরের ৮ মার্চ। সংক্রমণ এড়াতে প্রায় ২ মাসের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এরপর সংক্রমণ কমতে থাকে; কিন্তু চলতি বছরের মার্চ থেকে সংক্রমণ তীব্র হতে থাকে। যদিও টিকা দেওয়া চলছে; কিন্তু সংক্রমণের তীব্রতা ক্রমেই বাড়ছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে নতুন সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার প্রতিদিন সর্বোচ্চ পরিমাণে রেকর্ড ছাড়াচ্ছে। সংক্রমণ এড়াতে ৫ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউনে নানা সীমিত কর্মকা- ঘোষণা করেছে সরকার। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং বাইরে না আসার প্রবণতা জনগণের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। এখন আবার সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। 

আগের দুই মাসের সাধারণ ছুটি দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ২ শতাংশের পরিবর্তে ৫ দশমিক ২ শতাংশ নেমে আসে। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েন শ্রমজীবী মানুষ। এই শ্রেণির মানুষদের মধ্যে ৮০ শতাংশের আয় কমে যায়। নতুন করে দরিদ্রতার হার বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। করোনা সংক্রমণের আগে যেখানে দেশে দরিদ্রতার হার ছিল- ২০ দশমিক ৫ শতাংশ; কিন্তু সংক্রমণের পর তা বেড়ে গিয়ে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ হয়েছে বলে একাধিক গবেষণা সংস্থা জানিয়েছে। করোনাভাইরাসের ব্যবসায়িক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। এর আওতায় প্রায় ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ দেওয়া হয়েছে; কিন্তু প্রান্তিক মানুষ এই সুবিধা পাননি। 

করোনাভাইরাসের ক্ষতির পরিমাণ জানতে সম্প্রতি একটি জরিপ চালিয়েছে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ। ওই জরিপের আওতায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ জুড়ে প্রায় ১৬শ’টি জায়গায় সমীক্ষা চালানো হয়। সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত বছরের মার্চের তুলনায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রান্তিক গোষ্ঠীর আয় ১৫.৮ শতাংশ ও ব্যয় ৮.১ শতাংশ কমেছে। এই পরিবারগুলোর প্রায় ৭৮.৮ শতাংশ অতিমারির ফলে আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল, যার ৭৮.৫ শতাংশই পুনরুদ্ধার হয়নি। সমীক্ষা করা পরিবারের প্রায় ৬০.৮ শতাংশ পরিবারকে বিকল্প পন্থা হিসেবে ঋণ নিতে হয়েছিল এবং সেটি পরিশোধ করতে তাদের গড়পড়তা প্রায় দুই বছর সময় লাগতে পারে।

‘কীভাবে অতিমারিকে মোকাবেলা করছে বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী : খানা জরিপের ফলাফল’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সঞ্চয় কমেছে ৬৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। কোভিড সমস্যার কারণে ৮০ দশমিক ৬০ শতাংশ পরিবার খাদ্যগ্রহণ কমিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে চরের ৭৪ দশমিক ৭০, হাওরের ৭৮ দশমিক ৯০, উপকূলের ৬৯ দশমিক ৮০, বস্তির ৭৮ দশমিক ৮০, দলিত ৬৫ দশমিক ৭০, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ৮৯ দশমিক ২০, প্রতিবন্ধী ৮০ দশমিক ৪০, অভিবাসী ৭৮ দশমিক ১০ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা ৮৪ দশমিক ১০ শতাংশ পরিবার খাবার গ্রহণ কমিয়ে দিয়েছেন।

অপরদিকে খাদ্যবহির্ভূত খরচ কমিয়ে দিয়েছে ৬৪ দশমিক ৫০ শতাংশ পরিবার। এর মধ্যে চরের ৫৮ দশমিক ৭০, হাওরের ৭০ দশমিক ৪০, উপকূলের ৩৮ দশমিক ৪০, বস্তির ৬১ দশমিক ৬০, দলিত ৪১ দশমিক ৮০, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ৮৩ দশমিক ৩০, প্রতিবন্ধী ৫৮, অভিবাসী ৫৯ দশমিক ৪০ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা ৭৪ দশমিক ১০ শতাংশ পরিবার খাদ্যবহির্ভূত খরচ কমিয়ে দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, চরের ১০০টি, হাওরের ১০০টি, উপকূলের ১০০টি, বস্তির ৪০০টি, দলিত ১০০টি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ৩০০টি, প্রতিবন্ধী ১৫০টি, অভিবাসী ১৫০টি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা ২০০টি পরিবারের থেকে তথ্য নিয়ে ওই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, প্রথাগতভাবে আমাদের দেশে যারা বিপন্ন মানুষ, এটি (কোভিড-১৯) তাদের জন্য আরও দুর্যোগ টেনে এনেছে। আবার যারা বিপন্ন ছিলেন না, তাদের অনেকে এই ধাক্কাতে অসহায়ত্বের পর্যায়ে চলে গেছেন। শুধু ছোট ছোট প্রণোদনা না, এটিকে ২-৩ বছরের জাতীয় সামগ্রিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে 

নিতে হবে। 

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে মানুষ প্রথম সঞ্চয় ভেঙে চলার চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ সম্পদ বিক্রি করেছেন। আবার কেউ কেউ ঋণ করে চলেছেন। ঋণ করার পর প্রথমে খাবার কমিয়েছেন এরপর গৃহস্থালির অন্যান্য ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়েছেন প্রান্তিক আয়ের মানুষ।

নতুন করে সংক্রমণের তীব্রতায় নিম্নআয়ের মানুষেরাই বেশি সংকটে পড়েছে। সরকার নতুন করে লকডাউনের চিন্তা করছে। এতেই দিশেহারা ক্ষুদ্র আয়ের মানুষ। লকডাউনের ঘোষণার আশঙ্কায় ইতিমধ্যে পণ্যমূল্যের দাম বেড়েছে। আর এই পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার জন্য মূলত দায়ী মধ্যবিত্ত শ্রেণি। তারা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পণ্য কিনে ঘরে মজুদ করছেন। হঠাৎ করে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় অনেক সময় বাজারের পণ্যের সংকট তৈরি হচ্ছে ।

আবার এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা এটিকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এতে নতুন করে বিপদ বাড়ছে নিম্নআয়ের মানুষরা। একদিকে তাদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার দুশ্চিন্তা, অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীর পণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়া।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //