যন্ত্রপাতির সংকটে করোনা চিকিৎসা ব্যাহত

নিয়ন্ত্রণহীনতার দিকে যাচ্ছে করোনা সংক্রমণ। হাসপাতালে সাধারণ ও আইসিইউ বেডের হাহাকার চলছে। হাসপাতালে একটি আইসিইউ বেড যেন সোনার হরিণ।

রোগীর স্বজনদের কান্নায় হাসপাতালের বাতাস ভারি হয়ে উঠছে। অপরদিকে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে গাড়িতেই রোগী মারা যাচ্ছেন। সংকট দেখা দিয়েছে অক্সিজেনের। অন্যদিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও আইসিইউ না পেয়ে অধিকাংশ রোগীর অবস্থা খারাপ থেকে অতি খারাপ হচ্ছে। মৃত্যুও হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। এখন করোনা আক্রান্ত যাদের মৃত্যু হচ্ছে, তাদের প্রায় সবাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাচ্ছেন।

হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা বেশ অসহায়। কারণ চিকিৎসা পদ্ধতি জানা থাকা সত্ত্বেও যথেষ্ট যন্ত্রপাতি না থাকায় সঠিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এখনকার অধিকাংশ করোনা আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে আসছেন ফুসফুসের ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থা নিয়ে। ফলে রোগী ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার আইসিইউ দরকার হলেও, সীমিত সংখ্যক আইসিইউ বেড সব সময় পূর্ণই থাকছে।

এ দিকে গত ৫ এপ্রিল একদিনে শনাক্ত ৭ হাজারের ঘর অতিক্রম করায় নতুন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে মানুষের মধ্যে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে করোনা যুদ্ধে প্রথম কাতারে থাকা চিকিৎসক, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। দেশের জন্য এটি একটি নতুন উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ১১ এপ্রিল বাংলাদশ সোসাইটি অব সার্জনসের ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, সে দিন বিভিন্ন বয়সী ১৭ জন সার্জন করোনা পজিটিভ হয়েছেন। নার্সদের সংগঠন তেমন শক্তিশালী না হওয়ায় দৈনিক তাদের করোনা আক্রান্তের সঠিক তথ্যটি পাওয়া না গেলেও একটি বড় সংখ্যায় নার্সরাও করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নার্স।

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক সৈয়দা নাজিয়া জানান, এই হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত যারা ভর্তি হচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগের ফুসফুস ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ ড্যামেজ অবস্থায় আসছেন। তাদের চিকিৎসার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন আইসিইউ সাপোর্ট; কিন্তু সীমিতসংখ্যক আইসিইউ বেডে ইতিমধ্যে মুমূর্ষুূ রোগীরা ভর্তি হয়ে আছেন। ফলে আইসিইউ সাপোর্ট না পেয়ে সাধারণ বেডেই তাদের রাখতে হচ্ছে এবং সেখানেই কিছু রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সাধারণ বেডে মিনিটে ১৫ লিটার চাপের বেশি অক্সিজেন দেওয়া যায় না; কিন্তু এ ধরনের রোগীদের প্রতি মিনিটে প্রয়োজন ৭০ থেকে ৮০ লিটার চাপের অক্সিজেন। হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা প্রয়োজন থাকলেও সাপ্লাই নেই। সে কারণে এসব রোগীকে বাঁচানো যাচ্ছে না।

অপরদিকে আইসিইউতে স্থানান্তর করতে না পারায় রোগীর প্রচ- শ্বাসকষ্ট চিকিৎসক এবং তাদের স্বজনদের চেয়ে চেয়ে দেখতে হয়। স্বজনদের কান্নায় হাসপাতালের পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে; কিন্তু কেউই কিছু করতে পারেন না। চিকিৎসার জন্য ডাক্তাররা উপস্থিত থাকলেও সঠিক মাত্রার অক্সিজেন দিতে না পারায় তাদের সামনেই রোগীদের মৃত্যু হচ্ছে। চিকিৎসা আছে; কিন্তু সুযোগ নেই কিছু করার। সৈয়দা নাজিয়া আরও বলেন, ‘নিজেরা আগে থেকে সাবধান হলে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে হঠাৎ করে এত মানুষ করোনায় সংক্রমিত হতো না। প্লিজ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, নিজেরা বাঁচুন-অপরকে বাঁচতে দিন।’

বাস্তব অবস্থা হলো- করোনা পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ থেকে খারাপ অবস্থায় গেলেও কিছু মানুষ এখনো স্বাস্থ্য বিধি পালন না করেই বাইরে বেরুচ্ছেন। পুলিশের ভয়ে মুখে মাস্ক একটা রাখলেও, তা অধিকাংশ সময় থাকছে নাকের নিচে। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাইফুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্যবিধি পালনে কিছু মানুষের অনীহা দেখলে খুব খারাপ লাগে। করোনা আক্রান্ত হলে হাসপাতালে যেতে হলে সে নিজেই যে ভুগবে তা নয়, সঙ্গে তার প্রিয়জনদের ভোগান্তির শেষ থাকবে না। মুহূর্তেই কয়েক হাজার টাকা খরচ হয়ে যাবে দামি দামি ওষুধ কিনতে। আবার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালেই এখন ভর্তির সুযোগ নেই। প্রায় সব সিটই ভর্তি হয়ে আছে করোনা আক্রান্ত রোগীতে। ডা. সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, সাবধান না হলে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে না চাইলে করোনা সংক্রমণের জন্য তৈরি থাকতে হবে। একবার করোনা হয়ে গেলে অনেক সময় নিজের শেষ সম্বলটুকুও খরচ হয়ে যাবে; কিন্তু তা করেও অনেকে সুস্থ হতে পারছে না। 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন সাংবাদিক শেখ এনামুল হক। তাকে গত ১০ দিন ধরে সেখানে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ভর্তি হওয়ার সময় তার অক্সিজেন স্যাচুরেশন (রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ) ৮৫ তে নেমে যায়। সিটি স্ক্যান রিপোর্টে দেখা যায়, তার ফুসফুসের ৪৫ শতাংশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। তার ছেলে শেখ এহতেশামুল হক জানান, নানা ধরনের পরীক্ষা এবং দামি দামি ইনজেকশন কিনতে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। চিকিৎসক আরও কমপক্ষে এক সপ্তাহ থাকতে বলেছেন। এ দিকে সঞ্চয়ের টাকা প্রায় শেষ হয়ে আসছে। বয়স্ক পিতাকে এই অবস্থায় বাসায় নিয়ে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। এহতেশামুল হক বলেন, মানুষের উচিত স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে পালন করা। হাসপাতালে যেন না আসতে হয়, সে চিন্তাটি সবার মাথায় থাকা উচিত। কারণ একবার নিজে অথবা স্বজনকে নিয়ে হাসপাতালে আসলেই ফতুর হয়ে যেতে হবে। হাসপাতাল সরকারি হলেও শুধু বেডটা ও ডাক্তার ফি ছাড়া এখানে আর কোনো কিছুই ফ্রি না। সব কিছুই কিনে আনতে হবে বাইরে থেকে। অতএব, সাবধান থাকুন। প্রয়োজন না হলে কখনোই বাইরে বেরুবেন না। 

করোনা দূর করতে হলে টিকা নেওয়ার বিকল্প নেই। টিকার ব্যাপারে ইতিমধ্যে কিছু বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছে শিক্ষিত মানুষের মধ্যে। ইউরোপে কয়েকটি দেশে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিয়ে রক্ত জমাট বাধার কিছু কেস পাওয়া যায়। এ খবর বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ে শিক্ষিত মানুষের মধ্যে। ফলে শেখ এনামুল হকের মতো সাংবাদিকও টিকা নেননি অগ্রাধিকার তালিকায় থাকার পরেও। বাংলাদেশের আইইডিসিআরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার প্রতি ১০ লাখে একজনের রক্ত জমাটের তথ্য পাওয়া যায়। এটি খুবই নেগলিজিবল অ্যামাউন্ট (এড়িয়ে যাওয়ার মতো একটি সংখ্যা)। এ কারণে নিরাপদ এবং কার্যকর এই টিকাটি না দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।’  

এ দিকে ২৯ মার্চ থেকে করোনা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার পর থেকে করোনা নিয়ন্ত্রণে লকডাউন ঘোষণা দিয়েও সরকার তা শিথিল করে ফেলে; কিন্তু ৪ এপ্রিল থেকে সাত হাজারের ঘর অতিক্রম করার পর সরকার ১৪ এপ্রিল থেকে সর্বাত্মক লকডাউনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এখানেও সরকার তার সিদ্ধান্তে ঠিক থাকতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। এবার আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিলেও খোলা রাখছে তৈরি পোশাক শিল্প এবং একই সঙ্গে আমদানি-রফতানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কিছুই খোলা থাকবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাটি ঠিক গতিতে ঘুরছে এই তৈরি পোশাক শিল্পের কারণেই। প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দেয় এই শিল্পটি; কিন্তু এই শিল্পে যারা কাজ করবেন তাদের কি করোনা হবে না? বাংলাদেশে প্রায় অর্ধকোটি গার্মেন্টস শ্রমিক একসঙ্গে কাজ করলে করোনা ছড়াবেই। করোনা প্রতিরোধে এদের জন্য কী করা হচ্ছে অথবা কী করতে হবে, তা নিয়ে খুব বেশি উচ্চবাচ্য নেই।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //