জন কেরির ঢাকা সফর

ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কে নতুন মোড়

করোনা মহামারির মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিশেষ দূত জন কেরির বাংলাদেশ সফর সবার নজর কেড়েছে। জলবায়ু সংকট নিয়ে ট্রাম্পের থেকে ঠিক বিপরীত অবস্থান নিয়েছেন বাইডেন। ক্ষমতায় গিয়ে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে যোগ দিয়েছেন।

ট্রাম্প চুক্তিটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। বাইডেন জলবায়ু সংকট নিয়ে বিশ্ব সম্মেলনের ডাক দিয়েছেন। আগামী ২২ ও ২৩ এপ্রিল ভার্চুয়াল এই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানাতে জন কেরি ঢাকায় এসেছিলেন মাত্র চার ঘণ্টার জন্য। তার আগে তিনি আবুধাবি ও দিল্লি সফর করেছেন।

জন কেরি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তার এই সফর শুধু জলবায়ু কূটনীতির অংশ নয়; বরং বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনেরও ইংগিত।

বিগত কয়েক বছর যাবত বাংলাদেশে একতরফা নির্বাচন হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্র খুব হতাশ ছিল। যুক্তরাষ্ট্র হতাশ থাকায় ইউরোপসহ তার পশ্চিমা মিত্ররাও এক সুরে অসন্তোষ জানায়। শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি অনেকটা অনাস্থা ব্যক্ত করে পশ্চিমা বিশ^। পশ্চিম বিযুক্ত সরকার মূলত প্রতিবেশী ভারত, কিছুটা দূরের প্রতিবেশী চীন, জাপানের মতো দেশগুলোর সমর্থন নিয়ে দেশে স্থিতিশীলতা অর্জন করতে সমর্থ হয়। শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি রাশিয়াও মৌন সমর্থন দেয়। ভূ-রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যে পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে ধীরে পাল্টাতে শুরু করে। বিশেষ করে উগ্রপন্থী জঙ্গি দমনে শেখ হাসিনার কঠোর হস্তক্ষেপের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে কিছুটা নমনীয় হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের চীন ঠেকাও নীতির ফলে ঢাকাকে কাছে টানছে ওয়াশিংটন। জন কেরির ঢাকায় আগমন তার সর্বশেষ প্রমাণ। 

বাইডেন ক্ষমতায় যাওয়ার পর অনেকে ভেবেছিলেন শেখ হাসিনার সরকারকে চাপে রাখবে ওয়াশিংটন। ডেমোক্রেটদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এরা গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার এসব বিষয়ে হইচই করে। হিলারি ক্লিনটন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের রাজনৈতিক সক্রিয়তা সবার চোখে পড়েছিল। তাই আওয়ামী লীগের সরকারের পছন্দের তালিকায় থাকে রিপাবলিকান সরকার। বাইডেন ক্ষমতায় যাওয়ার পর শেখ হাসিনা সরকার বাইডেনের প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। বাইডেনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতাদের পাশাপাশি বাইডেন প্রশাসনের কেউ একজন শুভেচ্ছা বার্তা পাঠাবেন বলে আশা করা হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেনের শুভেচ্ছা পেলেই ঢাকা সন্তুষ্ট থাকবে বলে মনে হচ্ছিল; কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে জো বাইডেন নিজেই শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান। বাইডেনের আসন্ন জলবায়ু সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে শুধু আমন্ত্রণই জানাননি; বরং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষ সম্মান জানাবে যুক্তরাষ্ট্র। জন কেরি একথা জানিয়ে গিয়েছেন।

বাইডেনের আরেক বৈশিষ্ট্য হলো- বহুপক্ষীয় বিশ্ব ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা। এভাবে আমেরিকার বিশ্ব নেতৃত্ব টিকে থাকে। তাই জলবায়ু সংকটের মতো বিষয় যুক্ত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুর সঙ্গে জ্বালানি ব্যবহারের একটি সম্পর্ক আছে। আগামী দিনে জ্বালানির ওপর নিয়ন্ত্রণ একতরফাভাবে জার্মানিসহ জলবায়ু পরিবর্তনে নেতৃত্বদানকারী দেশগুলোর হাতে চলে যাচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির বাণিজ্যও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বাংলাদেশ। তাই প্যারিস চুক্তি মোতাবেক, বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো বছরের পর বছর ধরে যে ক্ষতির শিকার হয়েছে; তার জন্য দূষণকারী দেশগুলো ক্ষতিপূরণ দেবে। শিল্পোন্নত দেশগুলো বেশি দূষণ ছড়িয়ে দিয়ে এমন ক্ষতি করেছে। বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অভিযোজনের জন্য একশ’ বিলিয়ন ডলারের তহবিল সংগ্রহ করার আহ্বান জাতিসংঘ মহাসচিবের রয়েছে। এসব বিষয় আগামী জলবায়ু সম্মেলনে উঠে আসবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে প্রধান অংশীদার হলো ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির কারণে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে যুক্ত করতে চাইছে। চীন থেকে দূরে সরাতে চাইছে। রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান প্রায় অভিন্ন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাই ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক অনেকটা ইতিবাচক ধারায় মোড় নিচ্ছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামত করা বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র ঠিক থাকলে গোটা পশ্চিমা দুনিয়া ঠিক। এতে করে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপের সঙ্গেও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ও প্রযুক্তিগত সম্পর্ক জোরালো হবে। এতে করে করোনা মহামারি পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে বাংলাদেশের বিজয়ী হওয়া সহজ হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি করে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশ, ইউরোপের দেশসমূহ অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধন করেছে। এখন ভারত সেই পথে হাঁটছে। বাংলাদেশের উচিত হবে অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত থাকা। তবে সামরিক উত্তেজনা ও যুদ্ধের মতো বিষয়ে আমাদের অবশ্যই দূরে থাকতে হবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতার বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

জন কেরি আগেও বাংলাদেশ সফর করেছেন। ওবামার আমলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তিনি বাংলাদেশে আসেন। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কথা বলার জন্য তিনি মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদো সফর করেছেন। সেখানে সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র কোভিড-১৯ মোকাবেলায় বেশ কিছু টিকা আবিষ্কার করেছে। তাদের দেশে ২০ কোটি মানুষকে টিকাদান সম্পন্ন করার পর বিদেশে তাদের বন্ধু দেশগুলোকে টিকাদান করবে। ফলে এসব বিষয়ে সহযোগিতা পেতে হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সদ্ভাব রাখতে হবে। বাইডেন প্রশাসনের ভালো দিক হলো, বহুপক্ষীয় বিশ্ব ব্যবস্থার প্রতি অঙ্গীকার। ট্রাম্প যেখানে ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। বাংলাদেশও বহুপক্ষীয় নীতিতে বিশ্বাসী দেশ। বহুপক্ষীয় ব্যবস্থাতেই বিশ্বের জন্য কল্যাণ নিহিত।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //