সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি

সফলতা পায়নি ব্যবস্থাপনা দুর্বলতায়

করোনা-পরবর্তী দরিদ্র মানুষকে সহায়তার সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ অনেকে ভালো চোখে দেখলেও, এর বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিভিন্ন মহলে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বা দরিদ্রদের জন্য নেয়া সহায়তার উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছে; কিন্তু প্রশ্নটি হলো বাস্তবায়ন নিয়ে। 

সহায়তা বণ্টনের ক্ষেত্রে সুশাসনেরও দারুণ অভাব। ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, সঠিক ব্যক্তিদের তালিকা নিয়ে প্রশ্ন, সঠিক নজরদারির অভাবের কারণে অনেক ভালো উদ্যোগও সফলতা পাচ্ছে না। 

করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র পরিবার ও কাজ হারানো শ্রমিকদের সহায়তা দিতে তৈরি করা হয় পৌনে ৩ হাজার কোটি টাকার তহবিল। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সেই সহায়তার অর্থ বিতরণ হয়নি বিরাট একটি অংশই। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রেও দুর্নীতি হওয়ার কারণে প্রকৃত ব্যক্তিরা সুফল পায়নি। দুর্বলতা ও দুর্নীতির কারণে বাস্তবায়নের ১৫ শতাংশের বেশি নয় বলে বিশ্লেষকরা বলছেন। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, আমলাতন্ত্রের দুর্বলতা ও স্থানীয় প্রশাসনে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই তালিকাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি- এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দায়িত্বে থাকা আমলারা- সহায়তা পাওয়ার যোগ্য ও প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে পারেননি। যথাযথ নীতি প্রণয়ন করতেও ব্যর্থ হয়েছেন। বাদ পড়েছেন যোগ্য ব্যক্তিরা। 

এর আগে সিপিডির এক আলোচনায় মাঠ পর্যায়ের দরিদ্র মানুষের অভিযোগ উঠে আসে। তাদের অভিযোগ গ্রাম পর্যায়ে সরকারের এই কর্মসূচির কথা তারা জানেন না। সেখানকার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও তাদেরকে জানাননি। ফলে তারা এই সহায়তার কথা সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলেই অর্থ পাননি।

নেত্রকোনা ও সিরাজগঞ্জের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কয়েকজন নাম প্রকাশ করার শর্তে জানান, সরকারের কাছে সারাদেশের হতদরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের তালিকা না থাকায় দুর্যোগ দেখা দিলে সঠিক মানুষটি সরকারি সহায়তা পায় না। অন্যদিকে সহায়তার যোগ্য না হলেও অন্যরা সহায়তা নিয়ে যাচ্ছে। যখন সহায়তার পরিকল্পনা নেয়া হয়, তখন তা মাঠ পর্যায়ে প্রদান না করলে উপকারভোগীরা সেই অর্থ দিয়ে বাস্তবে উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত সুবিধা পায় না। দেখা গেছে, কোনো গ্রামে ৯৪টি বাড়ি আছে। যারা হতদরিদ্র, অথচ সেখানে সহায়তার অর্থ পেয়েছে মাত্র ১৪টি পরিবার। আবার এই আড়াই হাজার টাকাও পর্যাপ্ত নয়। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সাতটি নতুনসহ চলতি ২০২০-২১ অর্থবছর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১২৩টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নাধীন আছে। আর এতে মোট বরাদ্দ ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। যেখানে ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারের জন্য বরাদ্দ এক হাজার ২৫০ কোটি টাকা ও শ্রমিকদের প্যাকেজের দেড় হাজার কোটি টাকা। যাদের মধ্যে মহামারি করোনার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারকে নগদ সহায়তা দিতে বাজেটে টাকা রাখা হয়েছে। শিল্প-কারখানা থেকে হঠাৎ চাকরি চলে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত বেকার অসহায় মানুষদের সহায়তার জন্য ভালো অঙ্কের বিদেশি অনুদান ও সহায়তা এসেছে। ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারের জন্য বরাদ্দ এক হাজার ২৫০ কোটি টাকার মধ্যে ৯১২ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। 

গত বছরের ১৪ মে প্রধানমন্ত্রী এই সহায়তা কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। যা ৩৬ লাখ ৭ হাজার ৮৭২ পরিবারের কাছে আড়াই হাজার করে টাকা পৌঁছানো গেছে বলে তাদের দাবি। তবে এর মধ্যে ফেরত এসেছে শত কোটি টাকার বেশি। ফলে বিতরণ দাঁড়াল ৮১২ কোটি টাকার মতো। সরকার দিতে পারেনি প্রায় ৪৩৯ কোটি টাকা। আর শ্রমিকদের জন্য যে প্যাকেজ দেড় হাজার কোটি টাকার ঘোষণা করেছিল, সেখান থেকে মাত্র ৫ কোটি টাকা দিতে সমর্থ্য হয়েছে। ফলে দুটি তহবিল মিলে সরকারের কাছে রয়ে গেছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। 

৪ লাখ ২ হাজার ১৬৮টি পরিবারের কাছে কোনো টাকা পৌঁছায়নি বলে বাংলাদেশ ব্যাংক গত ফেব্রুয়ারির শেষে অর্থ বিভাগকে এক চিঠিতে অবহিত করেছে। চার মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা বিকাশ, রকেট, নগদ ও শিউরক্যাশের কাছে পড়ে আছে।

বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ বলছেন, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে প্রায় এক বছরে ৫০ লাখ পরিবারের কাছে সহায়তা পৌঁছানো গেল না। যা প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি। এটি খুবই দুঃখজনক। কভিডের এক বছরে তাহলে আমরা কী শিখলাম? এখন যদি একটি সুনামিতে আবার ৫০ লাখ লোককে সাহায্য দিতে হয়, আমরা কি তা পারব?

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি খুবই দুর্বল, ব্যবস্থাপনায় প্রচুর ঘাটতি ও দুর্নীতিতে আক্রান্ত। আমাদের শহরভিত্তিক যে দরিদ্র মানুষ আছে কর্মখাতে, সামাজিক সুরক্ষা খাতে তাদের জন্য করোনা-পরবর্তী যে কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল, তার বাস্তবায়নের হার একেবারেই কম। যা ১০-১৫ শতাংশের বেশি বাস্তবায়ন হয়নি। এগুলো কেন হয়নি? সরকার কি এসব জানে না? এই খাতে এখন সংশোধন করে সেখানে যাতে যথেষ্ট বরাদ্দ থাকে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। 

তার মতে, দু’বছর যে ক্ষতিগ্রস্ত হলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা, তাদের যে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দেওয়ার কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল, সেটির বাস্তবায়ন হার সব ঋণ প্রদান কর্মসূচির মধ্যে সবচেয়ে কম। কারণ এদের কাছে পৌঁছানো যায়নি। কেন যায়নি, সেটিও সরকার ভালোভাবে জানে। সেটি বিশ্লেষণ করে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন এখন। 

তিনি আরো বলেন, ব্যাংকভিত্তিক সহায়তা কর্মসূচি ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের কাছে পৌঁছাবে না। তাদের কাছে যাতে সহায়তার অর্থ পৌঁছাতে পারে, এমন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ কর্মসূচি তো বর্তমানে চলমান আছে। প্রয়োজন কর্মসূচির আকার ও বাস্তবায়নের সক্ষমতা বাড়ানো। এই বিষয়ের ওপর বেশি নজর দিতে হবে।

অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকার হতদরিদ্রদের জন্য আড়াই হাজার টাকা করে যে নগদ সহায়তা দিয়েছে, তা বণ্টনের সময় প্রান্তিক মানুষ পেলেও অনেক ক্ষেত্রে সুশাসনের ভিত্তিতে হয়নি। তাই এক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য দেশের হতদরিদ্র ও প্রান্তিকদের একটি তালিকা প্রণয়ন খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন সম্প্রতি এক ওয়েবিনারের আলোচনায় বলেন, দরিদ্রদের আড়াই হাজার টাকা করে যে সহায়তা দেয়ার পদক্ষেপ সরকার নিয়েছিল, তা অনেকের কাছেই যায়নি। চলমান এই কার্যক্রমে দরিদ্ররা যাতে সহায়তার টাকা পায়, সেটি নিশ্চিত করা দরকার।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //