আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস

শ্রমিকরা আজও বঞ্চনার শিকার

‘প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য/ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,/চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মধ্য/কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।/চিমনির মুখে শোনো সাইরেন-শঙ্খ,/গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে,/তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য/জীবনকে চায় ভালোবাসতে।’ বর্তমান এই কঠিন সময়ের সামনে দাঁড়িয়ে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার এই পঙ্‌ক্তিগুলো যেন কানে বেজে ওঠে। 

গতবারের মতো এবারের মে দিবসও এসেছে এক নজিরবিহীন পরিস্থিতির মধ্যে। বিশ্বজোড়া করোনা মহামরির প্রকোপে ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থা, বিপন্ন জীবন। অর্থনীতির চাকা স্তব্ধ হয়ে গেছে দেশে-বিদেশে।  

সেই সঙ্গে উন্মোচিত করে দিয়েছে, পুঁজিবাদী সমাজের বাস্তবতাকে। সংক্রমণের বাইরে মৃত্যুর সঙ্গে ক্ষুধা এসে হানা দিয়েছে শ্রমজীবীর ঘরে। এরই মধ্যে কাজ খুঁইয়েছেন কয়েক কোটি শ্রমিক। 

আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থাগুলো অবশ্য বলছে- এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে খুব শিগগিরই বিশ্বের শহরগুলো হয়ে উঠবে ছিন্নমূল, কর্মহীন, অনিশ্চিত জীবনের মানুষের বসতি। 

বিপন্নতায় ফন্দির সন্ধি

বর্তমান সংকটের মূল কারণ করোনাভাইরাস বা তজ্জনিত অচলবস্থা নয়। কালো ছায়া আগে থেকেই ক্রমেই ঘোরতর হচ্ছিল আমাদের অর্থনীতির ওপর। কয়েক বছর ধরে একে একে বন্ধ হয়ে যাওয়া শিল্প-কারখানা, বেকার হওয়া শ্রমিকের হাহাকার সে চিত্র-ই সামনে আনে। থমকে থমকে চলা অর্থনীতির কঙ্কালসার চেহারাটা কেবল ক্ষুদ্র ভাইরাসের ছোয়ায় উন্মোচিত হয়েছে। আর এ সুযোগে বোবা করোনার ওপর দায় চাপিয়ে এদেশের শাসকশ্রেণি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, পুঁজিপতি ও শিল্পপতি নিষ্কলঙ্ক হতে চায়। 

করোনার কারণে গত বছর রফতানিমুখী শ্রমিকদের এপ্রিল, মে ও জুন- তিন মাসের মজুরি দেওয়ার জন্য পাঁচ হাজার  কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। এই ঋণের বিপরীতে সেবা মাশুল ছিল ২ শতাংশ। পরে পোশাকশিল্পের মালিকরা আরও এক মাসের মজুরি দেওয়ার জন্য ঋণ চান। সরকারও মেনে নেয়। তখন তহবিলের আকার বেড়ে ৯ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা দাঁড়ায়। আর্থিক সংকটের কথা বলে এবারও ঈদের আগে শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন-ভাতা ও বোনাস দিতে ঋণ চেয়েছেন তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ীরা। 

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান, নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি একেএম সেলিম ওসমান এবং বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন গত ২৫ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে চিঠি দিয়ে ঋণ দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। 

বিষয়টি নিশ্চিত করে বিকেএমইএর সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে বিশ্বের অনেক দেশই আগের মতো লকডাউনে রয়েছে। ফলে যেসব ক্রেতা অর্থ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারাও এখন অপারগতা প্রকাশ করছে। তারা ৬০ থেকে ১৮০ দিন পর্যন্ত সময় চাইছে। এ ছাড়া অনেক ক্রেতাকে মূল্যছাড়ও দিতে হচ্ছে, এমন পরিস্থিতির জন্য। অথচ এখন ঈদের সময়। উৎসবের আগেই সচল কারখানাগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও বোনাস দিতে মালিকদের ওপর প্রচণ্ড চাপ রয়েছে। আর্থিক সংকটের কারণে শ্রমিকের বেতন-ভাতা ও বোনাস পরিশোধে অর্থের জোগান দেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। সে কারণেই আমরা সরকারের কাছে সহজ শর্তে ঋণ চেয়েছি।’

ক্ষয় দেখিয়ে জুজুর ভয়  

দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। হু হু করে বাড়তে থাকা সংক্রমণ ঠেকাতে শিল্প-কারখানা খোলা রেখেই কঠোর স্বাস্থ্যবিধির ফ্রেমে লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। এই সুযোগ ও কৌশলে কাজ হাসিলের চেষ্টা করছেন মালিকপক্ষ! লকডাউনের এ সময়ে কম শ্রমিক ব্যবহার করে অধিক উৎপাদনের জন্য বাড়িয়ে দেওয়া হয় কর্মঘণ্টা। শ্রমিকরাও তেমন প্রতিবাদ করছেন না, দেশে কাজের যে বড্ড অভাব। অথচ রক্তঢেলে প্রাণ দিয়ে শোষণ নির্যাতনকে মোকাবেলা করার পথ ধরেই একদিন অর্জন হয়েছিল আট ঘণ্টার বেশি কাজ না করার অধিকার। 

অন্য দেশের মতো বাংলাদেশের শ্রম আইনেও দৈনিক আট ঘণ্টা কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করা হয়। তবে এর মধ্যে এক ঘণ্টা টিফিন বিরতি থাকবে, সপ্তাহে ছুটি থাকবে এক দিন। সে হিসাবে একজন শ্রমিককে সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা কাজ করার কথা থাকলেও বিশেষ প্রয়োজনে তার সম্মতিতে বাড়তি ভাতা দিয়ে আরও দুই ঘণ্টা করানোর বিধান রয়েছে আইনে। তবে পোশাকখাতের শ্রমিকদের জন্য বিশেষ প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে দুই ঘণ্টার পর আরও চার ঘণ্টা ওভারটাইমের সুযোগ দেয় শ্রম মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্য শ্রমিকদের স্বাধীনতার কথা বলা থাকলেও, বেশিরভাগ কারখানার মালিক তা বাধ্যতামূলক হিসেবেই দেখছে। এখন তো ‘বিশেষ পরিস্থিতি’র সুযোগ নিয়ে কম মজুরিতে ১২ ঘণ্টা কাজ করানোর ফন্দি আঁটছেন মালিকরা।

সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ‘শ্রমিকরা অসহায়, কাজ হারানোর ভয়ে আছে। তাই ঝুঁকি জেনেও করোনাকালে জীবিকার তাগিদে কাজে যাচ্ছে। মূলত এটাকে সুযোগ হিসেবে নিয়েছেন কারখানা মালিকরা। শিপমেন্টের অজুহাতে বাড়তি কোনো মজুরি ছাড়াই ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। প্রায় সময়ই মিথ্যা অজুহাতে শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা বাড়িয়ে দিয়ে তাদের শেষ রক্তবিন্দুটুকু নিংড়ে নেওয়ার মতলব আঁটা হয়। শ্রমঘণ্টা বাড়ানো, বোনাস কমানো এবং ঝুঁকি ভাতা না দিয়েই করিয়ে নেওয়া হয় ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো। আসলে সব ক্ষেত্রেই একটা জুজুর ভয় যে- আমাদের মার্কেট শেষ হয়ে যাবে, কারখানাই টিকবে না। ফলে একটা কল্পিত ভয়ে এবং কল্পিত আতঙ্কে শ্রমিকদের আতঙ্কিত করে তাদের দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করিয়ে নেওয়া হয়।’

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এত বছর পরও আট ঘণ্টা কাজ করে বাঁচার মতো মজুরির অধিকার প্রতিষ্ঠা থেকে বাংলাদেশ অনেক দূরে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে কোনো মতে টিকে থাকতেও শুধু আট ঘণ্টার বেশি কাজ করলেই হয় না, শিশুসহ পরিবারের একাধিক সদস্যকে কাজে যোগ দিতে হয়। সাধ্যের অতিরিক্ত করতে হয় ওভারটাইম।’

দু’আনার জীবন 

শ্রমিকের ঘামেই সচল দেশের অর্থনীতি। শ্রমঘন পোশাক শিল্প সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী খাত; কিন্তু সেই শ্রমিক মুনাফার কতটুকু পায়? এ খাতের শ্রমিকদের জন্য প্রথম মজুরি ঘোষণা করা হয় ১৯৮৪ সালে। তখন ন্যূনতম মজুরি ছিল ৬৩০ টাকা। এক দশক পর ৩০০ বাড়িয়ে করা হয় ৯৩০ টাকা। এর পর প্রায় একযুগ এ খাতে নতুন কোনো বেতন কাঠামো ঘোষণা হয়নি। ২০০৬ সালে অবশ্য ন্যূনতম বেতন হাজারের ঘর স্পর্শ করে, ৯৩০ থেকে বেড়ে হয় ১ হাজার ৬৬২ টাকা। এর চার বছর পর ২০১০ সালে মজুরি বাড়িয়ে করা হয় ৩ হাজার টাকা। ২০১৩ সালের জুনে গঠিত মজুরি বোর্ড পোশাক শ্রমিকদের মূল বেতন নির্ধারণ করে ৫ হাজার ৩০০ টাকা। সপ্তম গ্রেডে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে মূল বেতন ৪ হাজার ১০০, বাড়ি ভাড়া ২ হাজার ৫০, চিকিৎসা ভাতা ৬০০, যাতায়াত ভাতা ৩৫০ এবং খাদ্য ভাতা ৯০০ টাকা। যদিও দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে এর বাস্তবতার কোনো মিল নেই। 

পোশাক শ্রমিক শিউলি খাতুন বলেন, ‘মাত্র ৭ হাজার ২০০ টাকা বেতন পাই। দুই ছেলে, এক মেয়ে ও স্বামী নিয়ে আমার পরিবার। স্বামীর রোজগারের টাকা চলে যায় বাসা ভাড়ায়। আর আমার আয় দিয়ে কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাই। ছেলেদেরও লেখাপড়া করাচ্ছি। ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে ঠিকমতো ডাল-ভাতের ব্যবস্থাও হয় না। অসুখ-বিসুখ হলে টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে পারি না। মাছ-মাংস খাওয়া তো আমাদের কাছে দিবাস্বপ্ন।’

রক্তশূন্য নারীদের কাঁধে দেশ  

দেশে প্রায় ৩২ লাখ নারী কাজ করেন তৈরি পোশাক কারখানায়। ৮০ ভাগেরও বেশি রফতানি আয়ে তাদেরই অবদান। মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) অবদান ১৪ ভাগের বেশি। অথচ প্রতি ১০ জনের আটজনই ভোগেন রক্তস্বল্পতায়। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল অ্যাল্যায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশনের (জিএআইএন) গবেষণায় এ ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রক্তস্বল্পতার কারণে নারী শ্রমিকরা শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এতে করে উৎপাদন ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নেও দেখা দেয় ঘাটতি। 

এ বিষয়ে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, ‘এ দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের জীবনে মজুরিবৈষম্যসহ নানা ধরনের বঞ্চনা, দুর্দশার গল্প। তবে নারী শ্রমিকের বৈষম্য ও বঞ্চনা অপেক্ষাকৃত বেশি। মজুরিবৈষম্য ছাড়াও তারা কারখানার ভেতরে ও বাইরে নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হন। আবার অধিকাংশ নারী শ্রমিকই নিয়োগপত্র পান না। ফলে মাতৃত্বকালীন ছুটি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। তবে এদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে ভবিষ্যতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেই।’

করোনাভাইরাস এবং তার গতিপথ রোধ করতে অভূতপূর্ব লকডাউনে দেশের অর্থনীতির অবস্থা শোচনীয়। ইতিমধ্যেই অনেক অর্থনীতিবিদ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, গত শতাব্দীর দুই বিশ্বযুদ্ধ তামাম অর্থনীতিকে যে সংকটের খাদে ফেলেছিল আমরা আবার তার পুনরাবৃত্তি দেখতে পারি। এমনকি দেখা দিতে পারে মহামন্দা। তবে এতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত শ্রমজীবীই তৈরি করবে নতুন পরিসর। ইতিহাস যে তাই-ই বলে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //