উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় প্রবাসীরা

করোনার ছোবল জীবন বদলে দিয়েছে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের। সর্বস্ব বিক্রি করে কিছুটা স্বচ্ছল জীবিকার আশায় প্রবাসের কঠিন জীবনে পাড়ি দেন অনেকেই। সবসময় নানা সংকটের মধ্যে থাকলেও স্বস্তি ছিল অনেকের মধ্যেই; কিন্তু সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে ভয়াবহ করোনাভাইরাস। 

সারাবিশ্বে লকডাউন ঘোষণা করার কারণে অনেক প্রবাসী কাজ হারিয়েছেন। অনেকে সাময়িক ছুটি নিয়ে বাধ্য হয়ে দেশে ফিরেছেন; কিন্তু এখন আর বিদেশে ফিরে যেতে পারছেন না। দেশেও কাজের সংস্থান করতে পারেননি। সবমিলিয়ে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন পার করছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশি কাজ করেন। সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, দুবাই, সিঙ্গাপুর মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশগুলোতে বাংলাদেশিরা বিভিন্ন সেক্টরে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে মঙ্গা, দরিদ্রতা দূর করতে অনেক বড় ভূমিকা পালন করছে রেমিট্যান্স। দেশের মোট জিডিপিতে রেমিট্যান্সের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশ ১২ শতাংশের মতো। দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সংকটকালীন বাংলাদেশের রিজার্ভ হু হু করে বেড়েছে। বর্তমান রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলার। এই রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় নিয়ামক প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। সর্বশেষ হিসাবে গত এপ্রিলে ২০৬ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ৮৯ শতাংশ বেশি। 

এ প্রসঙ্গে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, নতুন কর্মসংস্থান বন্ধ, পুরনোদের চাকরির অনিশ্চয়তা এবং দেশে ফেরা প্রবাসীদের নিয়ে বাংলাদেশ তিনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা জানি না আমাদের কী পরিমাণ লোক কাজ হারাবে। ইতিমধ্যে লাখ লাখ লোক কর্মসংস্থান বঞ্চিত, প্রায় ৫ লাখ লোক ফেরত এসেছে এবং বিদেশে থাকা এক কোটি লোকের মধ্যে অন্ততপক্ষে ৫০ লাখ লোকের এই মুহূর্তে কোনো কাজ নেই। এখন প্রবাসীদের লড়াইটা হচ্ছে টিকে থাকার লড়াই।

কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার ছোবলে ভালো নেই প্রবাসীদের জীবন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসে সারাবিশ্বে এখনো ভয়াল থাবা বিস্তার করছে। জীবনঘাতী এই ভাইরাস স্বাস্থ্য ও মানবজীবনের পাশাপাশি মানুষের আর্থিক নিরাপত্তা ও আয়ে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। 

‘বিদেশফেরতদের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি অন্বেষণ এবং বিশ্লেষণ’ শীর্ষক এক জরিপ পরিচালনা করে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি। বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণ শুরুর পর গত বছরের মার্চে-এপ্রিলে ফেরত আসা প্রবাসী কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে ২২ মে একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে ব্র্যাক। এক বছর পর পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হয়েছে, সেটা জানতেই আবার জরিপ করা হয়। গত বছর যাদের সঙ্গে কথা বলেছিল ব্র্যাক তারাসহ এবার মোট এক হাজার ৩৬০ জন বিদেশ ফেরতদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে। এর মধ্যে ২০৭ জন ইতিমধ্যেই বিদেশে চলে গেছেন। একটা বড় অংশকে ফোনে পাওয়া যায়নি। অনেকেই তথ্য দিতে রাজি হননি। তবে ৪১৭ জন বিদেশফেরত বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন। উত্তরদাতাদের বেশির ভাগই সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যে, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরেছেন। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৯৫.৬৮ শতাংশ পুরুষ এবং ৪.৩২ শতাংশ নারী। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই গ্রামে বাস করছেন (৮৮.০১ শতাংশ) এবং বাকিরা শহর এলাকায় বসবাস করছেন (১১.৯৯ শতাংশ)। 

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বছর পেরিয়ে গেলেও করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে ফেরত আসা প্রবাসী কর্মীদের ৪৭ শতাংশই এখনো আয়ের জন্য কোনো কাজে যুক্ত হতে পারেননি। ফলে দৈনন্দিন খরচ চালাতে তাদের অনেককেই পরিবারের আয় বা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার-দেনা করে চলতে হচ্ছে। অন্য দিকে ৫৩ শতাংশ কৃষিকাজ, ছোটখাটো ব্যবসা বা শ্রমিক হিসেবে নিজেকে যুক্ত করে বর্তমানে পরিবার চালাচ্ছেন। তবে বিদেশ ফেরতদের ৯৮ শতাংশই এখনো তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন।

জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, গত বছর বিদেশফেরতদের ৮৭ শতাংশ বলেছিলেন, তাদের কোনো আয়ের উৎস নেই। এবার দেখা গেছে, উত্তরদাতাদের প্রায় ৫৩ শতাংশ কোনো না কোনো কাজে নিজেকে যুক্ত করতে পেরেছেন। এর মধ্যে ২৪ দশমিক ১৯ শতাংশ কৃষি কাজে যুক্ত হয়েছেন, ২২ দশমিক ৩৩ শতাংশ দিন মজুরি বা এই ধরনের কোনো কাজে যুক্ত হয়েছেন এবং ৩৫.৩৫ শতাংশ ছোট কোনো ব্যবসা শুরু করেছেন। এ ছাড়া ১৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ অন্য কোনো না কোনো কাজ করছেন। তবে উত্তরদাতাদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ বিদেশফেরতই গত এক বছরেও কোনো প্রকার কাজ জোগাড় করতে পারেননি। তারা তাদের দৈনন্দিন খরচ চালাতে তাদের পরিবারের আয় বা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার নিয়ে চলছেন। উত্তরদাতাদের ২৮ শতাংশ বলেছেন, তারা ইতিমধ্যেই ধার-দেনায় জর্জরিত হয়েছেন এবং ৭২ শতাংশ বলেছেন, তারা ফের বিদেশে চলে যেতে চান।

প্রতিবেদনে প্রবাসীদের বর্তমান মানসিক অবস্থাও উঠে এসেছে। গত বছর অংশগ্রহণকারীদের ৭৪ শতাংশ জানিয়েছিলেন, তারা ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রচ- দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও ভীতির মধ্যে রয়েছেন; কিন্তু এবার ৯৮ শতাংশ উত্তরদাতাই বলেছেন, অপর্যাপ্ত আয়, বেকারত্ব, পুনরায় বিদেশ যেতে না পারা, পারিবারিক চাপ ইত্যাদির কারণে চরম উদ্বিগ্নতা এবং মানসিক চাপের মধ্যে আছেন তারা। 

কোভিড শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে এই বছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লাখ প্রবাসী দেশে ফেরত আসতে বাধ্য হয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকে ফিরেছেন আতঙ্কে, অনেক ফিরেছেন চাকরি হারিয়ে, কেউ ফিরেছেন স্থায়ীভাবে আবার কেউ বা কেবল ছুটি নিয়ে দেশে এসেছিলেন। উত্তরদাতাদের মধ্যে ৩৫ শতাংশ ছুটিতে দেশে এসেছিলেন। ১৯ শতাংশ চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। ১৬ শতাংশ ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। ১২ শতাংশ একেবারেই চলে এসেছেন এবং ২ শতাংশ অসুস্থতার কারণে ফিরেছেন।

ইতিমধ্যে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউ তীব্র আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ অনেক দেশেরই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। তবে প্রবাসীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হলেও সংশ্লিষ্ট দেশের নানা শর্তের কারণে অনেকে যেতে পারছেন না। বিমানে টিকিট পেতে প্রতিদিন সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোতে প্রবাসীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা যাচ্ছে। লকডাউনের কারণে সারাদেশে বাস, লঞ্চ, ট্রেন সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও অনেক টাকা খরচ করে রাজধানীতে এসে বিমানের টিকিট কেনার চেষ্টা করছেন প্রবাসীরা। এতে তারা নানা ভোগান্তির মধ্যে পড়ছেন। 

এ দিকে করোনাভাইরাসের কারণে দেশে ফেরত আসা শ্রমিকদের জন্য ৭০০ কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করে সরকার। এর মধ্যে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড তহবিল থেকে ২০০ কোটি টাকা এবং সরকার থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫০০ কোটি টাকা। প্রবাসীদের বিকল্প কর্মসংস্থার তৈরি ও পুনরায় বিদেশে যেতে কম সুদে ও সহজ শর্তে ওই ঋণ বিতরণ করার কথা। এই ঋণের সুদের হার ৪ শতাংশ। ১ থেকে ৯ মাস গ্রেস পিরিয়ড। ২ থেকে ৫ বছর মেয়াদি ঋণ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত কোনোরকম জামানত ছাড়াই দেওয়া হচ্ছে; কিন্তু ঋণ বিতরণে তেমন গতি আসেনি। সরকার তার বরাদ্দের ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে ২৫০ কোটি টাকা ছাড় করেছে। এর মধ্যে সর্বশেষ গত মার্চ পর্যন্ত হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে মাত্র ১৪৮ কোটি টাকা। এটি মোট প্যাকেজের ২১ দশমিক ১৪ শতাংশ। আর ছাড় করা অর্থের ৫৯ দশমিক ২০ শতাংশ। সরকারের বাকি ২৫০ কোটি ও ওয়েজ আর্নার্স তহবিলের ২০০ কোটি টাকা এখনো ছাড় করা হয়নি।

গত বছরের জুলাই থেকে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ৮২টি শাখার মাধ্যমে এ ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, শুধু প্রবাসীদের মধ্যে ঋণ দেওয়ার কারণে বিতরণ কম। শাখার সংখ্যা কম হওয়ায় সব প্রবাসীকে ঋণের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। সব উপজেলায় শাখা নেই। ফলে অনেক দূর থেকে প্রবাসীরা ঋণের জন্য আসছে না। শাখাগুলোতে লোকবল কম। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে ঋণ বিতরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ঋণ বিতরণে বেশ গতি এসেছিল; কিন্তু এখন বিধি-নিষেধের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //