বাঁধ সংস্কারে স্বচ্ছতার অভাব

‘আমরা টেকসই বেড়িবাঁধ চাই, সাহায্য আমাদের দরকার নাই, সাহায্য আমরা চাই না। আমরা চাই এদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বসবাসের জন্য টেকসই বেড়িবাঁধ।’ গণমাধ্যমে এভাবেই আকুতি জানিয়েছিলেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বাসিন্দা কৃষ্ণপদ মণ্ডল। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বেড়িবাঁধ ভেঙে তিনি আয় রোজগারের একমাত্র সম্বল চিংড়ি ঘের, ফসলি জমি সবই হারিয়েছেন। বসতভিটাতেও পানি উঠে গেছে। গত ৩০ বছর ধরে চিংড়ি ঘের করে আসছেন তিনি। কিন্তু প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসে নিঃশেষ হয়েছেন বারবার।

সাতক্ষীরা থেকে টেকনাফ পর্যন্ত উপকূল ঘেঁষে নির্মিত এ বাঁধের দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার। ষাট বছর আগের এ বাঁধের অবস্থা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এখন জরাজীর্ণ। ভাঙাচোরা বাঁধ যে প্রবল জলোচ্ছ্বাস ঠেকাতে অক্ষম তা আবার প্রমাণিত হলো ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে। ইয়াসের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধ ভেঙে সাতক্ষীরা, খুলনা, বরিশালসহ উপকূলীয় এলাকার লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।   

ঘূর্ণিঝড়ের সাথে আসা জলোচ্ছ্বাস প্রথমেই আঘাত করে বেড়িবাঁধকে। প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাঁধ ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে, পানির ধাক্কায় অনেক জায়গা ভেঙে যায়। লোনা পানি গ্রাম, লোকালয়, জনপদ প্লাবিত করে, ফসলের ক্ষতি করে।

উপকূলবাসী জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ মেরামতের কথা বলেছে বহুদিন ধরে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জোয়ারের পানির উচ্চতা বাড়ছে। একারণে বাঁধ মজবুত করার সাথে সাথে বাঁধের উচ্চতা বাড়ানোরও দাবি জানানো হয়েছে। কিন্তু উপকূলবাসীর এসব আবেদন-নিবেদনে সংশ্লিষ্টদের মনোযোগ নেই। জনপ্রতিনিধিরাও তাদের সমস্যা এড়িয়ে গেছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নামকাওয়াস্তে মেরামতের কাজ হয়েছে। কিন্তু সেখানেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সাধারণ মানুষ যখন বুঝতে পেরেছে বিপদ আসন্ন, তখনই তারা কোদাল হাতে, মাটির ঝুড়ি মাথায় নিয়ে বাঁধ রক্ষায় নেমেছে। স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে বেড়িবাঁধ মেরামত করেছেন। 

সম্প্রতি খুলনার কয়রায় খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য মো. আক্তারুজ্জামানকে দেখেই বাঁধে কাজ করা স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। কাঁদা ছুড়ে মারতে থাকেন তাঁর ট্রলারের দিকে।  স্থানীয়রা জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে সংসদ সদস্যের সমর্থক-অনুসারীদের ঠিকাদারি সিন্ডিকেটের কারণে বাঁধে কাজের মান ভালো হয় না। ফলে জোয়ারের পানিতে বাঁধ ভাঙলে দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ মানুষ।    

বেড়িবাঁধ সংস্কারের নামে শুধুই সরকারি অর্থের হরিলুট হচ্ছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা। প্রভাবশালীরা ইচ্ছেমতো বাঁধ কেটে নিজেদের কাজে লাগিয়েছে। নাজুক বাঁধ ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কায় অসংখ্য জায়গায় ধসে পড়েছে। নীতি-নির্ধারকরা ছুটে গেছেন পরিদর্শনে। ফিরে আসার পর প্রকল্প নেয়া হয়েছে বিপুল টাকার। কিন্তু সেখানে বিস্ময়করভাবে উপেক্ষিত থেকেছে মূল সমস্যার সমাধান- শক্তপোক্ত, উঁচু ও টেকসই বেড়িবাঁধ। বাঁধ সংস্কারের নামে বরাদ্দ মিলেছে সামান্য। সেখান থেকেও বাকিটা চলে গেছে অন্য প্রকল্পে। আবার বাঁধ সংস্কার কাজেও চলেছে অবাধ দুর্নীতি-অনিয়ম। জোড়াতালির বাঁধ আর ঠিক হয়নি। 

অতীতে বিপুল অংকের অর্থ বরাদ্দ দিয়ে চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, সন্দ্বীপ, পতেঙ্গা, কক্সবাজার, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া,  টেকনাফ, নোয়াখালীর হাতিয়া, ভোলা জেলাসহ সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চলে বেড়িবাঁধ নির্মাণ, সংস্কার বা মেরামতের কাজ চলেছে। এর পেছনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) একশ্রেণীর অসৎ কর্মকর্তা ও দলবাজ ঠিকাদারদের যোগসাজশের কথা আলোচনায় এসেছে। কিন্তু মানসম্মত কাজ হয়নি কোথাও। অধিকাংশ জায়গায় বেড়িবাঁধ টেকেনি। এতে করে উপকূলবাসীর ভাগ্য ফেরেনি। 

উপকূলীয় এলাকায় টেকসই বাঁধ নির্মাণের প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করেননি সরকারের নীতিনির্ধারকরা। সম্প্রতি ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেছেন, ‘ডেল্টা প্রকল্পের আওতায় টেকসই বাঁধ করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। সেটার জন্য বাজেট বরাদ্দও দেয়া হয়েছে। ২০৩১ সালের মধ্যে সব উপকূলীয় অঞ্চল টেকসই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার আওতায় আনার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।’

উপকূল এলাকার মানুষ কৃষিজীবী অথবা মৎস্যজীবী। এ পেশার মাধ্যমে তারা নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করেন এবং দেশের মানুষের অন্নের সংস্থান করেন। জাতীয় অর্থনীতিতে তাদের অবদান অনেক। অথচ বঙ্গোপসাগরে এখন ঝড়-জলোচ্ছ্বাস মানেই বাঁধ ভেঙে জীবন-জীবিকার সর্বনাশ। ঘূর্ণিঝড় ইয়াস সেটাই  চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেলো। উপকূলবাসীর জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করতে টেকসই বাঁধের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।  তবে তারা এও বলছেন যে, ডেল্টা মহাপরিকল্পনার অধীনে টেকসই বাঁধ নির্মাণ হতে আরো এক দশক লাগতে পারে। ততদিন ঘূর্ণিঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূলবাসীকে বাঁচাতে অস্থায়ী ভিত্তিতে মজবুত ও টেকসই বাঁধ নির্মাণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিত হবে।  এবং বাঁধ সংস্কারে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।        

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //