বাংলাদেশের কূটনীতি : পাসপোর্ট ও ইসরায়েল ইস্যু

ফিলিস্তিনের নিরীহ মানুষের ওপর হামলা ও ইসরায়েলি সেনাদের আরেক দফা দখলদারিত্ব চলছিল গত মাসে। সে সময়ই কয়েকটি খবর বাংলাদেশের নাগরিকদের সামনে এসেছে। 

জানা গেল, এবার ঈদের পর থেকে বাংলাদেশ সরকার যেসব ই-পাসপোর্ট সরবরাহ করছে তাতে একটি বড় পরিবর্তন করা হয়েছে। দেখা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি সবসময়ই বাংলাদেশের ইস্যুকৃত পাসপোর্টের প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা ছিল ‘দিস পাসপোর্ট ইজ ভ্যালিড ফর অল কান্ট্রিজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড একসেপ্ট ইসরায়েল’ (বিশ্বের যে কোনো দেশের জন্য এ পাসপোর্ট কার্যকর থাকবে, শুধু ইসরায়েল ছাড়া); কিন্তু বর্তমানে নতুন ইস্যু করা ই-পাসপোর্টে ‘একসেপ্ট ইসরায়েল’ শব্দ দুটি বাদ দেওয়া হচ্ছে। শুরুতে সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হলেও পরে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেশি-বিদেশি নানা গণমাধ্যম। 

ওইসব প্রতিবেদনে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্তা ব্যক্তিরা মতামত দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এ প্রসঙ্গে দাবি করেছেন, ‘ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক আগে যেরকম ছিল এখনো তা-ই থাকবে। তবে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে আমরা পাসপোর্টে একসেপ্ট ইসরায়েল শব্দ দুটি তুলে দিচ্ছি।’ 

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বাংলাদেশ যেহেতু ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি, তাই পাসপোর্টে একসেপ্ট ইসরায়েল লেখা হয়ে থাকে। তবে পাসপোর্ট ইস্যু করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরর বিষয়। কাজেই এ শব্দ দুটি কেন তুলে দেওয়া হলো এ বিষয়ে তারাই ভালো বলতে পারবে। তবে বাংলাদেশ এখনো ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি।’ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা সেখানে থামতে পারত; কিন্তু তা হয়নি। 

বাংলাদেশি পাসপোর্টে এই পরিবর্তনের পরই দেখা গেল বাংলাদেশকে স্বাগত জানিয়ে গত ২২ মে টুইটারে মতামত প্রকাশ করেছে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। ইসরায়েলের পররাষ্ট্র দপ্তরের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল গিলাদ কোহেন টুইটারে মন্তব্য করেন, ‘বাংলাদেশ তার নাগরিকদের ইসরায়েল ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে। এটা গ্রেট নিউজ। স্বাগত জানানোর মতো একটা পদক্ষেপ। আমি বাংলাদেশ সরকারকে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য অগ্রসর হতে আহ্বান জানাই।’

এমনকি ইসরায়েলি পররাষ্ট্র দপ্তর থেকেও টুইট করে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ নাগরিকদের ওপর ইসরায়েলে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে, বাংলাদেশি বন্ধুদের ইসরায়েলে স্বাগত জানানোর জন্য আমরা অপেক্ষা করছি।’ এ দিকে ঢাকায় নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত এই বিষয়টির প্রতিক্রিয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এ নিয়ে এক সাংবাদিক প্রশ্ন তোলেন, যে কাউকে খুশি করা বা কাউকে দুঃখিত করা বাংলাদেশের উদ্দেশ্য ছিল কি-না।

পরে অবশ্য, ২৪ মে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ‘বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের ইসরায়েল ভ্রমণে আগের মতোই নিষেধাজ্ঞা আছে। ইসরায়েলের বিষয়ে বাংলাদেশের যে অবস্থান, সেখান থেকে বাংলাদেশ সরে আসেনি এবং বাংলাদেশ এক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের অবস্থানেই অবিচল রয়েছে।’

এছাড়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশের নাগরিকদের কেউ ইসরায়েলে গেলে শাস্তি পেতে হবে। 

এসব তথ্যের ভিত্তিতে সর্বসাধারণের মনে বড় দুটি প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমত, হঠাৎ বাংলাদেশ সরকার কেন পাসপোর্ট থেকে ‘একসেপ্ট ইসরায়েল’ শব্দদ্বয় মুছে দেওয়ার উদ্যোগ নিল? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পাসপোর্টের আন্তর্জাতিক মানের কথা বললেও তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কেননা পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্র তার পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে স্বাধীন, সার্বভৌম ও স্বতন্ত্র। কাজেই ‘আন্তর্জাতিক মানের’ অজুহাতে অন্য কোনো রাষ্ট্রের অনুসরণ করা বাংলাদেশের জন্য বাধ্যতামূলক নয়।

তাছাড়া সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এমন কোনো অভিযোগ বাংলাদেশি পাসপোর্টের বিরুদ্ধে শোনা যায়নি যাতে মনে হয়, বাংলাদেশি পাসপোর্টের ওই দুটি শব্দের কারণে ‘আন্তর্জাতিক মান’ বিঘ্নিত হচ্ছে। বরং ওই দুটি শব্দ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি ‘কোর ভ্যালুকে’ পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করে আসছিল। এই কোর ভ্যালুটি বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে সব সরকারের আমলে সবচেয়ে অপরির্তিত কূটনৈতিক অবস্থান হিসেবে চলে আসছে।

পাসপোর্টে এটি লেখার মাধ্যমে মূলত সব প্রবাসী বাংলাদেশিই দেশের বেসরকারি প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বব্যাপী বার্তা বহন করছিলেন যে, আমরা বাংলাদেশি এবং আমাদের দেশ দখলদার ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং আমরা ফিলিস্তিনিদের পাশে আছি। 

মনে রাখা দরকার, ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে বাংলাদেশের এই অবস্থান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ‘কোর ভ্যালু’ এবং এ বিষয়ে পৃথিবীর অনেক মুসলিম দেশের চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট এবং অপরিবর্তনশীল। স্বাধীনতার পরপরই ইসরায়েল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এবং বিভিন্ন সময়ই দেখা গেছে বাংলাদেশের সঙ্গে খাতির জমাতে খুবই আগ্রহী এই দেশটি; কিন্তু বাংলাদেশ অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে সেই স্বীকৃতি গ্রহণ না করে, ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই বাংলাদেশের নীতি ছিল, ‘ফিলিস্তিনের মুক্তির পক্ষে থাকা’। এছাড়া ‘ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা যোদ্ধাদের স্যালুট’ লেখা ও আল-আকসার ছবি সম্বলিত সরকারি স্ট্যাম্পও প্রকাশ করা হয়েছিল। 

দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হলো, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি; কিন্তু তাহলে কী এমন প্রয়োজন সৃষ্টি হয়েছিল যে, পাসপোর্ট থেকে শব্দ দুটি বাতিল করতে হলো? এই উদ্যোগটি যে বাংলাদেশের একটি সুস্পষ্ট কূটনৈতিক অবস্থানকে অস্পষ্ট এবং সংশয়পূর্ণ করে দিয়েছে তা পরিষ্কার। সেই সঙ্গে এটি সরকারের জন্য বাড়তি একটি সমস্যা সৃষ্টি করছে বলে অনেকে মনে করছেন। কেননা বিভিন্ন সময়ে আমরা লক্ষ্য করেছি রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থে দেশের কোনো কোনো ব্যক্তি ইসরায়েলি সংস্থার সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখছেন। এমনকি বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে, বাণিজ্যিক সম্পর্ক না থাকলেও ইসরায়েলে গত ১০ বছরে প্রায় ৫ লাখ ডলারের পণ্য বাংলাদেশ থেকে ইসরায়েলে রফতানি হয়েছে। রফতানি হলেও কীভাবে রফতানি হয়েছে, কারা রফতানি করেছে তা বাণিজ্য সংক্রান্ত সরকারি ব্যক্তি ও সংস্থাগুলো পরিষ্কার করতে পারছেন না। ইপিবির তথ্য বলছে, বেশ কিছু তৈরি পোশাক গত কয়েক বছরে রফতানি হচ্ছে। তাছাড়া যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া ও কুষ্ঠরোগের ভ্যাকসিনও রফতানি হচ্ছে।

এছাড়া সামান্য কিছু সবজি, আসবাবপত্র ও মোটরসাইকেলও রফতানি করা হয়েছে। এ অবস্থায় পাসপোর্ট থেকে এ দুটি শব্দ তুলে দিয়ে আবার, কেউ ইসরায়েলে গেলে শাস্তি পেতে হবে- এমন বক্তব্য দেশের কূটনৈতিক অবস্থানকে স্ববিরোধী করে দেওয়ার নামান্তর। কেননা পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাস্তি দেওয়ার কথা বললেও বাস্তবে পাসপোর্ট থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়ে ‘শাস্তি প্রদানের’ আইনি কাঠামোকে দুর্বল করা হলো। 

এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। কয়েক মাস আগেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছিল যে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থা ইসরায়েল থেকে গোপনে ‘স্পইওয়্যার’ কিনেছে। সে সময় দেশের সব দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো এ খবরকে মিথ্যা প্রপাগান্ডা বলে উল্লেখ করেছে; কিন্তু এখন হঠাৎ করে পাসপোর্টের এই মৌলিক পরিবর্তনে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করছেন যে, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরের একটি মহল বিশেষ স্বার্থে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে সরকারকে প্রভাবিত করছে। রফতানি আয় বৃদ্ধি, বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে গোপন যোগাযোগের অভিযোগ এসব তথ্যই ইঙ্গিত করে যে, ইসরায়েলের বিষয়ে আগ্রহী একটি পক্ষ এখানে রয়েছে; কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার, যে কোনো কূটনৈতিক উদ্যোগ অল্পকিছু সুযোগ সন্ধানী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে নেওয়া হলে সেটি দেশের ‘জাতীয় স্বার্থ’ পূরণ করবে না। বরং কূটনৈতিক উদ্যোগের পেছনে জনমনের প্রতিফলন হওয়া খুবই জরুরি।

বাংলাদেশের জনমত কোনোভাবে ইসরায়েলের প্রতি ন্যূনতম নমনীয়তা দেওয়ার পক্ষে নয়। বরং জনগণের মধ্যে এমন ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে যে, সরকার কোনো একটি মহলের প্ররোচনায়, জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিনা প্রয়োজনে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের দিকে আগাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে প্রতিবাদী ব্যক্তি বা সংগঠনগুলোকে কোণঠাসা করে হঠাৎই পাসপোর্টে এই পরিবর্তন আনার কারণেও জনগণের মধ্যে এমন ধারণা বদ্ধমূল। 

অবশ্য সম্প্রতি এক টকশোতে জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া আরও কিছু তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, পাসপোর্ট থেকে এই শব্দ দুটি তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে এক বছর আগে এবং সেই সিদ্ধান্তের আলোকে অন্তত এক লাখ পাসপোর্ট এরই মধ্যে ইস্যু করা হয়েছে। তাহলে বোঝা যায়, সরকার এই সিদ্ধান্তটি নেওয়ার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট গোপনীয়তা অবলম্বন করেছে। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করার পরই এটি বাংলাদেশের জনগণ বা গণমাধ্যম জানতে পেরেছে।

উল্লেখ্য, ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের পাসপোর্টে দক্ষিণ আফ্রিকা, তাইওয়ান ও ইসরায়েল এই তিনটি দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। পরে নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে বর্ণবাদ বিলুপ্ত হওয়ার পর বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে। তাইওয়ানও বাংলাদেশের পাসপোর্ট থেকে বাদ দেওয়া হয় বাংলাদেশের বাণিজ্যিক স্বার্থকে বিবেচনায় রেখে, যদিও তাইওয়ানকে বাংলাদেশ এখনো চীনের অংশ বলেই মনে করে; কিন্তু হঠাৎ করে ইসরায়েলের ওপর থেকে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোন কূটনৈতিক স্বার্থ কাজ করেছে, তা স্পষ্ট করা হয়নি।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //