বাঁধ সংস্কার নাকি লুটের স্থায়ী খাত!

‘দ্য লিটল হিরো অব হারলেম’ গল্পের হান্স ব্রিংকারকে মনে আছে? নেদারল্যান্ডসের হারলেম শহরের আট বছরের হান্স বাড়ি ফেরার পথে বাঁধের গায়ের ছিদ্র দিয়ে পানি গড়াতে দেখে বুঝতে পেরেছিল কী ঘটতে চলেছে। নিজের শহরকে প্লাবিত হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে উপায়ান্তর না-দেখে সারারাত হাত দিয়ে সেই ছিদ্রের মুখ চেপে বসে থাকে সে। 

হান্সের সেই দৃশ্যেরই যেন চিত্রায়ন করল নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার সোনাদিয়া চরচেঙ্গা গ্রামের মানুষ। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকছে গ্রামে। জমির ফসল, জনবসতি তলিয়ে যেতে পারে। তাই অপেক্ষা করেননি কেউ। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন সবাই। কেউ ঘরের চাল বা উঠোনে খড়ের গাদা থেকে খড়ের আঁটি নিয়ে, কেউ প্লাস্টিক, কেউ ত্রিপল- হাতের কাছে যে যা পেয়েছেন তাই নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েন বাঁধ রক্ষায়। কেউ মাটি ফেলায় হাত লাগালেন। কেউবা ব্যস্ত বাঁশের খুঁটি পোঁতার কাজে। অনেকে আবার পানিতে নেমেই পেতে দিলেন বুক, উত্তাল ঢেউয়ের আঘাত যেন বাঁধে না লাগে! 

সম্মিলিত সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়নি, এ যাত্রায় রক্ষা পায় বাঁধটি। পরে পানি আর ঢেউয়ের শক্তি কমে গেলে স্থানীয়রাই নিজস্ব উদ্যোগে সেটি সংস্কার করেন। সেই ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে দুর্দশার কথা জানতে পারে সারাদেশের মানুষ। কেবল চোখ বন্ধ করে রাখেন দায়িত্বপ্রাপ্তরাই।  

তারা প্রকৃতির অবাধ্য সন্তান 

মানুষের পরীক্ষা নিতেই যেন হানা দেয় এক-একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ঘূর্ণিঝড় ইয়াস মোকাবেলায় অবশ্য যথেষ্ট প্রস্তুতির সময় পেয়েছিল আবহাওয়া বিজ্ঞানের কল্যাণে। সে কারণেই সতর্কতামূলক প্রচার ও বিপদ মোকাবেলার সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে। নদী ও সমুদ্র উপকূলের কয়েক লাখ বাসিন্দাকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়ার প্রস্তুতির পাশাপাশি দুর্ঘটনার সম্ভাবনা এড়াতে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল নৌযান। সরকারি এতসব উদ্যোগ সত্ত্বেও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ; বিশেষ করে খুলনা, সাতক্ষীরা, বরগুনা, নোয়াখালী, ভোলার উপকূল এবং সুন্দরবনের দ্বীপগুলোর লোকজন ভয়ানক ক্ষতি ও দুর্গতির মধ্যে পড়ে। কেননা ঝড়ের পূর্বাভাস থাকলেও যে মাত্রায় জলোচ্ছ্বাস হয়েছে তা ছিল অপ্রত্যাশিতই। ফলে ইয়াসের কোনো ঝাপটা না লাগলেও জোয়ারের লবণপানিতে ভেসে যায় কারও বাড়ি, কারও ক্ষেত; নিরাশ্রয়-নিঃসম্বল গ্রামবাসী গাছে উঠেও কাটিয়েছে রাত। আর সে অভিজ্ঞতা থেকেই শিক্ষা নেওয়া জরুরি- পূর্বাভাস যাই থাকুক না কেন, সংশ্লিষ্ট বিপদগুলোর সম্ভাব্যতার কথাও মাথায় রাখতে হবে। সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় এ অঞ্চলের নিয়মিত চরিত্রলক্ষণ, ক্রমেই তার সংখ্যা ও তীব্রতা বেড়ে চলবে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সংখ্যা ও তীব্রতা বাড়বে। ঘন ঘন নিম্নচাপ আর জোয়ার-ভাটার খেলায় উপকূলে বাড়বে নোনা পানির আগ্রাসন। এতে মুক্তির জন্য উঁচু ও মজবুত বাঁধই একমাত্র ভরসা। যদিও বাস্তবে পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। বাঁধ নির্মাণ কিংবা সংস্কারে দুর্নীতির সঙ্গে রয়েছে চিংড়িচাষিদের বেআইনি ও আত্মঘাতী কা-। ঘেরে নোনা পানি ঢুকাতে ফুটো করা হয় বাঁধের তলা। জোয়ারের পানি চাপ দিলেই সে অংশ ভেঙে প্লাবিত হয় গ্রামের পর গ্রাম।’ 

বাঁধের টাকা জলে গেলেই বেশি লাভ!

সরকারের হিসাবে দেশে প্রায় ১৭ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, অর্ধেকই উপকূল রক্ষায়। তবে ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর ও ২০০৯ সালে আইলার পর উপকূলীয় এলাকার এসব বাঁধের অনেক স্থানেই ভেঙে যায়। বানের তোড়েও ভেসে গিয়েছিল কোনো কোনো পয়েন্ট। এর মধ্যে তা-ব চালায় ঘূর্ণিঝড় ফণী ও বুলবুল। গেল বছরের আম্পানও কম ধাক্কা দেয়নি। কথিত ‘জরুরি কাজ’-এর অজুহাতে চলে জোড়াতালি, নামমাত্র সংস্কার। 

বরাদ্দটা টেকসই হলেও বাঁধে যেন ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’। সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই ছিঁড়ে যায় মায়ার বাঁধন। নতুন প্রকল্পের নামে শুরু হয় আবার নতুন বরাদ্দ।  যুগের পুর যুগ ধরে এভাবেই চলছে ‘বাঁধ ব্যবসা’।

জলবায়ু অর্থায়ন ও প্রকল্পের অধীনে বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের ওপর বছর চারেক আগে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তাতে উঠে আসে স্থানীয় জনগণকে উপেক্ষা করে প্রভাবশালীদের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি; যেখানে প্রভাব খাটান মন্ত্রী, সাংসদ, সচিব, ক্ষমতাসীন দলের নেতা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরা। সবার সঙ্গেই ‘সুসম্পর্ক’ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তাদের। প্রকল্পের ঠিকাদাররা তখন আর বাঁধ টেকসই না করে সেই মাটি ইটভাটায় বিক্রি করে দেন। ভাঙনরোধে জিও ব্যাগে বালুর ‘ব্যবসা’টা তো সেই পুরনো। প্রতিবাদ জানিয়ে কেউ কেউ গলা ভাঙলেও লাভের খাতা বলতে গেলে শূন্য।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উপকূল বাঁচাও আন্দোলনের (উবা) সভাপতি শাহেদ শফিক বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলেই কেবল নতুন করে বেড়িবাঁধ নির্মাণের আশ্বাস মিলে; কিন্তু উপকূলে আর টেকসই বাঁধ হয় না। পানি উন্নয়ন বোর্ড অবশ্য প্রতি অর্থবছরের শেষ মুহূর্তে এসে বাঁধ নির্মাণে তোড়জোড় শুরু করে; কিন্তু ততক্ষণে চলে আসে বর্ষা। ব্যয় করা হয় না বরাদ্দের এক তৃতীয়াংশ অর্থও। সামান্য ঝড় হলেই তা ভেঙে যায়। এটা যেন তাদের নিত্যখেলা। যেহেতু এ কাজে দুর্নীতির সুযোগ বেশি, জবাবদিহি নেহাত কম। তাই কোটি কোটি টাকার বাঁধ সংস্কার এখন পাউবো, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ঠিকাদারদের অর্থ লুটের স্থায়ী খাত। তারা দেশকে ঠকানোর মাধ্যমে নিজেরা সম্পদশালী হয়, সঙ্গে ধ্বংস করে পরিবেশ আর প্রতিবেশ। গরিব ও প্রান্তিক কৃষকের ক্ষতিতে তাদের কী আসে যায়!’

বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ড. আতিক রহমান বলেন, ‘কবে বাঁধ ভাঙবে, এরপর সেটা মেরামতÑ তাদের এমন চিন্তা-ভাবনা ফলদায়ক নয়। বাঁধ মেরামত করতে হবে শুষ্ক সময়ে ও টেকসইভাবে। কোথায় কোথায় ক্র্যাক আছে তা খুঁজে বের করতে হবে। বাঁধ একবার ভাঙলে সেটা অনেক বড় হয়ে যায়। ফলে সেই বাঁধ আর ঠিক হয় না। পানি উন্নয়ন বোর্ড এই কাজগুলো না পারলে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিতে হবে।’

ভাঙা-গড়ার খেলা 

সরাসরি বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত না হানলেও অনেক ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। এর প্রভাবে ১৬ জেলার ৮২ উপজেলা এবং ১৩ পৌরসভায় ঝড়ো হাওয়া ও ভারি বর্ষণ হয়েছে। ঝড় আর পূর্ণিমার কারণে উপকূলীয় এলাকায় দেখা দেয় জলোচ্ছ্বাস। অনেক জায়গায় বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকছে লোকালয়ে। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। নষ্ট হয়েছে জমির ফসল আর চিংড়ির ঘের। প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা। সব মিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ১৪ লাখ ৯৯ হাজার ১১ জন। বিধ্বস্ত হয়েছে ২৫ হাজার ৭৩৩ ঘরবাড়ি এবং মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের। সবচেয়ে বেশি ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে সাতক্ষীরা জেলায়। আশাশুনি, দেবহাটা, কালীগঞ্জ, শ্যামনগর উপজেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের পৌনে ৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ প্রবল জোয়ারে ভেঙে গেছে। আর সেই বেড়িবাঁধ জরুরিভিত্তিতে মেরামত প্রয়োজন বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের প্রাথমিক হিসাবে উঠে এসেছে। 

এ প্রসঙ্গে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম বলেন, ‘উপকূলীয় অঞ্চলের বেড়িবাঁধ সংস্কারের কাজ প্রধানমন্ত্রী নিজেই মনিটরিং করছেন। তিনি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন। এ ছাড়া মেগা প্রকল্পগুলো দ্রুত অনুমোদনেও তিনি নির্দেশ দিয়েছেন।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, ‘বছর উনিশ-কুড়ি আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড স্থানীয় ভূমিহীনদের সঙ্গে নিয়ে ভোলার চরফ্যাশনে বেড়িবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের একটি অসাধারণ উদাহরণ তৈরি করেছিল। বাঁধের এক কিলোমিটার করে জায়গা দেওয়া হয় একেকটি ভূমিহীন পরিবারকে, যেখানে তারা ঘর তুলে থাকে। আর ঢালে সবজি বা ফসল ফলায়, বড় বড় ফলের ও কাঠের গাছ লাগায়। এ ব্যবস্থায় বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় প্রায় নেই বললেই চলে। বরং ভূমিহীনরা মাথাগোঁজার ঠাঁই পায়, তাদের আয়ের সংস্থান হয়। তবে এতে দুর্নীতির সুযোগ না থাকায় পরীক্ষামূলক প্রকল্পটি সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও আর অনুসরণ করা হয় না!’


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //