বজ্রপাতজনিত মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না কেন

দেশে বজ্রপাতে মৃত্যু ও আহতের ঘটনা বাড়ছে। গত এপ্রিল থেকে প্রায় প্রতিদিনই বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। দুর্যোগ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত দেড় মাসে বজ্রপাতে ১৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত রবিবার (৬ জুন) একদিনেই দেশের বিভিন্ন জেলায় মারা গেছেন ২৭ জন।

কালবৈশাখীর কারণে বজ্রপাতের ঘটনা বেশি ঘটে এপ্রিল ও মে মাসে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপমাত্রা ও বাতাসে সিসার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া, জনজীবনে ধাতব পদার্থের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া, প্রচুর মোবাইল ফোন ব্যবহার ও এর রেডিয়েশন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, বনভূমি বা গ্রামাঞ্চলে উঁচু গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, জলাভূমি ভরাট ও নদী দখলসহ নানা কারণে বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়ছে।      

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতে মোট মৃতের সংখ্যা ২ হাজার ৩৭৯ জন। ২০২০ সালে মারা বজ্রপাতে মারা গেছেন ২৯৮ জন। তবে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতে প্রাণহানি ঘটেছে ২০১৮ সালে, ৩৫৯ জন। ২০১৭ সালে মারা গেছেন ৩০১ জন।  ২০১৬ সালে ২০৫ জন, ২০১৫ সালে ১৬০ জন, ২০১৪ সালে ১৭০ জন, ২০১৩ সালে ১৮৫ জন, ২০১২ সালে ২০১ জন, ২০১১ সালে ১৭৯ জন ও ২০১০ সালে ১২৩ জন বজ্রপাতে মারা যান।   

ঝড়-বৃষ্টির সময় খোলা মাঠে যারা কাজ করেন, নৌকায় বা পথঘাটে চলাচল করেন, তারাই বজ্রপাতের শিকার হন বেশি। এর কারণ- বজ্রপাতের সময় তারা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়ার সময় পান না। দেশের বেশির ভাগ ফসলি জমিতে বড় কোনো গাছ নেই। বজ্রপাতের ধর্ম হচ্ছে তা মাটিতে আঘাত হানার আগে সবচেয়ে উঁচু যে জায়গাটি পায় সেখানে গিয়ে পড়ে। কৃষিজমিতে কাজ করার সময় কৃষকের শরীরই মাটির চেয়ে উঁচুতে থাকে। ফলে বজ্রপাত থেকে তারা কোনোভাবেই রক্ষা পান না। 

বাস্তবতা হলো, কৃষককে ধান কাটতে মাঠে যেতেই হবে। বজ্রপাতের ভয়ে তার পক্ষে ঘরে বসে থাকা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় সব ধরনের বিকল্প ব্যবস্থার কথা মাথায় নেয়া দরকার। অনেকে বলছেন, অন্তর্বতীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে মোবাইল টাওয়ারে লাইটেনিং এরস্টোর লাগিয়ে ঝুঁকি কমানো যায়। এছাড়া হাওর ও বাঁওড় এলাকার ফসলের মাঠে নির্দিষ্ট দূরত্বের পরপর এই যন্ত্র বসালে বজ্রপাতজনিত মৃত্যুহার অনেক কমে আসবে।  

বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া ও এর প্রতিকার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, বিশ্বে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় বাংলাদেশে। এ ব্যাপারে আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম (প্রাক-সতর্কীকরণ ব্যবস্থা) ও লাইটেনিং এরেস্টর (বজ্রপাত নিরোধক) স্থাপনের মাধ্যমে মানুষকে রক্ষার পদক্ষেপ নেয়া যায়। পাশাপাশি মানুষকে আরো বেশি সচেতন ও সাবধান হতে হবে।  কালবৈশাখীর এই সময়ে আকাশে কালো মেঘ দেখা দিলে, খোলা মাঠে-ঘাটে কাজ করা যাবে না। বাসাবাড়িতে আর্থিংয়ের ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে হবে।  তাছাড়া মাঠে-ঘাটে প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগালে তা এই ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারবে। 

পৃথিবীর অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও বজ্রপাত প্রতিরোধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই বাংলাদেশে। আধুনিক সতর্কীকরণ ব্যবস্থার বিষয়টি এখনো পরিকল্পনাতে সীমাবদ্ধ। বজ্রপাতপ্রবণ এলাকায় ১০ লাখ তালগাছ লাগিয়ে ঠেকানোর পরিকল্পনা নেয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। কোথাও কোথাও তালগাছের চারা ও বীজ রোপণ করা হলেও তা রক্ষণাবেক্ষণ না করায় গরু-ছাগলে খেয়েছে। রাস্তা সম্প্রসারণের নামে তালগাছসহ বড় বড় গাছ কাটা হচ্ছে। তদারকির অভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে হাট-বাজার ও রাস্তায় লাগানো তালগাছ উধাও হচ্ছে। রাস্তার পাশের বড় বড় গাছ কাটা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বজ্রপাতের আগাম সতর্কবার্তা দিতে প্রায় ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের আটটি স্থানে লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর স্থাপন করার কথা থাকলেও দক্ষ জনবলের অভাবে তা কোনো কাজে আসেনি। 

এ প্রসঙ্গে দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, ‘আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম ৪০ সেকেন্ড আগে ওয়ার্নিং দিতে পারে। এটি বসানোর জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।  দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য যন্ত্রপাতি কেনার প্রক্রিয়া চলছে। এক কোটি তালগাছ রোপণ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। লাইটেনিং এরেস্টার বা বজ্রপাত প্রতিরোধক দণ্ড স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।’ 

তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, টাওয়ারে লাইটেনিং এরস্টোর লাগানোর বিষয়ে সরকারিভাবে বিবেচনা করা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এটি লাগানোর পরে একটি টাওয়ার মাত্র ৯০ মিটার এলাকা কাভার করবে। এর একেকটি যন্ত্রের দাম প্রায় সাত লাখ টাকা। কাভারেজ এলাকার তুলনায় এটা যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ। তাই পরবর্তী সময়ে মন্ত্রণালয় এই পরিকল্পনা থেকে সরে আসে। বর্তমানে বজ্রপাত এলাকা বিশেষ করে হাওর অঞ্চলের কৃষকদের সচেতন করার পাশাপাশি সেসব এলাকায় নতুন গাছ লাগানো ও বড় গাছ সংরক্ষণকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। 

বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, তালগাছ রোপণ ও এরেস্টার স্থাপন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অকার্যকর পদ্ধতি। আবহাওয়া ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, ‘এরেস্টার স্থাপন করে কখনোই দেশের মানুষকে বজ্রপাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব না। এ পদ্ধতি ব্যবহার করে ট্রান্সফর্মা রক্ষা করা যায়। আর বজ্রপাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে হলে লাখ লাখ এরেস্টার স্থাপন করতে হবে।’ 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিমানবাহিনীর রাডার ব্যবহার করে সফটওয়ারের মাধ্যমে দুই থেকে তিন ঘণ্টা আগে বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব। বিমানবাহিনীর রাডারের সফটওয়ার ব্যবহার করে প্রথম যে বজ্রপাতটা হবে তার লক্ষ্য জানা যাবে ও সরাসরি ওই এলাকায় মোবাইলে এর তথ্য চলে যাবে। প্রতি ৫ মিনিট পর পর একটি চিত্র দেয়া যাবে কোথায় বজ্রপাত হচ্ছে। ২ থেকে ৩ ঘণ্টা পূর্বে বাতাসের গতিবেগ দেখে বোঝা যাবে বজ্রপাতটা কোনদিকে যাবে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //