কেন বাড়ছে শিশুশ্রম

করোনার কারণে দরিদ্র পরিবারগুলোর আয় কমে যাওয়ায় শিশুশ্রমের ঝুঁকিটা বেড়ে গেছে। পরিবারগুলোর এখন সামর্থ্য নেই তার সন্তানদের ঠিকমতো খাবার দেয়ার, অভিভাবকরা বাধ্য হয়ে সন্তানকে কাজে পাঠাচ্ছে, যাতে পরিবারের বাড়তি কিছু উপার্জন হয়। এতে করে অনেক শিশু লেখাপড়া থেকে ঝরে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, বাল্যবিয়ে বেড়ে যাচ্ছে এই করোনার কারণে।

তবে এ চিত্র শুধু দেশের নয়, গোটা বিশ্বের। জাতিসংঘ বলেছে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে আরো লাখ লাখ শিশু-কিশোর একই ভাগ্য বরণ করার ঝুঁকিতে রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার (১০ জুন) জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ যৌথভাবে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে  বলা হয়, মহামারির বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি পরিস্থিতি আরো গুরুতর করে তুলছে। মানুষকে যদি দারিদ্র্যের ঝুঁকি থেকে মুক্ত করতে দ্রুত পদক্ষেপ না গ্রহণ করা হয়, তবে প্রায় ৫ কোটি শিশু আগামী দুই বছরে শিশুশ্রমে যুক্ত হতে বাধ্য হবে।  

প্রশ্ন উঠতে পারে, শিশুশ্রম কেন ক্ষতিকর? কাজ করবে এর মধ্যে আবার ক্ষতির কী আছে? ক্ষতিটা মানসিক এবং শারীরিক৷ বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিশুরা মূলত কাজ করে এমন সব প্রতিষ্ঠানে যেগুলোর আনুষ্ঠানিক তেমন কোনো ভিত্তি নেই৷ এ সব প্রতিষ্ঠানে কাজের নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই, নিয়মকানুন মানার বিধিনিষেধ নেই, কোনটা শিশুর জন্য ক্ষতিকর তা বিবেচনার ব্যবস্থা নেই৷ এমন পরিবেশে কাজ করে শিশুরা অল্প বয়সেই বিভিন্ন রোগের কবলে পড়ে যায়৷ পরিশ্রমের ক্লান্তির কারণে, পর্যাপ্ত সময় না থাকায় লেখাপড়া থেকে কার্যত ছিটকে পড়ে৷ 

বাংলাদেশে সমগ্র কর্ম শক্তির ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ শিশু শ্রমের দ্বারা অর্জিত হচ্ছে। কোনো কোনো সমীক্ষায় দেখা যায় ৬২ শতাংশ। শিশুশ্রম গ্রামীণ কৃষিতে প্রয়োগ হচ্ছে, ১ লাখ ৪৯ হাজার শিশু শ্রমিক নিকৃষ্ট ধরণের কাজে নিয়োজিত রয়েছে ১ দশমিক ৪ শতাংশ ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত রয়েছে। অনানুষ্ঠানিক খাতের মধ্যে গ্রামীণ কৃষিখাতে বিরাট সংখ্যক শিশুশ্রমিক বিনা বেতনে কাজ করে থাকে।


গ্রাম এবং শহর উভয়স্থানে ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ শিশু দিন মজুর, ১৪ শতাংশ বিক্রয় কর্মী এবং ২৫ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবহনখাতে নিয়োজিত রয়েছে। গ্রামীণ শিশু শ্রমিকের মধ্যে বেশীরভাগ সংখ্যক নিয়োজিত রয়েছে কৃষি খাতে।

শহুরে শিশু শ্রমিকরা যেসব অনানুষ্ঠানিক খাতের সাথে যুক্ত তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে; ছোট পোষাক কারখানা, পরিবহন খাত, সেবা খাত, গৃহ শিশুশ্রম, চামড়া শিল্প ইত্যাদি।

যেখানে রয়েছে চাকুরীর অনিশ্চয়তা, দুর্ব্যবহার, অনিয়মিত মজুরী, অনির্দিষ্ট মজুরি, স্বাস্থ্য ঝুঁকি, এমন কি শারীরিক মানসিক ও যৌন নির্যাতনের ঝুঁকির মধ্যেও শিশুদেরকে জীবিকার তাগিদে কাজ করতে হয়। উল্লেখ্য, এসব শিশু শ্রমিকদের কারোই চাকুরীর সুনির্দিষ্ট কর্মবিধি নেই। যার কারণে বঞ্চনার শিকার হলেও শিশু শ্রমিকেরা তাদের ন্যায্য দাবি আদায় করতে ব্যর্থ হয়।

ঢাকার কামরাঙ্গীর চরে কমপক্ষে দশটি বেলুন তৈরির কারখানা আছে, যেগুলোর সিংহভাগেই শিশু শ্রমিক কাজ করে৷ সড়ক থেকে একটু আড়ালে ভেতরের দিকেই কাজ করানো হয় শিশুদের৷ সপ্তাহে সাত দিনই সকাল-সন্ধ্যা কাজ করতে হয় তাদের৷


রাজধানীর সড়কে বিভিন্ন যানবাহনের হেলপার অপ্রাপ্তবয়স্ক। গ্যারেজ, ওয়ার্কশপ, মিল-কারখানা, সিগারেট বিক্রি, ফুল বিক্রি, ফুটপাতে পানি বিক্রি, বাদাম বিক্রি ও হোটেল-রেস্টুরেন্টের কর্মচারী এবং মহাসড়ক জুড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাড়িতে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে অনেক শিশু। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজধানীতে শিশুরা শ্রমের সাথে জড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি অপরাধমূলক কাজের সাথে জড়াচ্ছে, মাদক বহনের মতো অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করা হয় শিশুদের। শিশুশ্রমিক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে শিশুরা প্রতিনিয়তই নিগ্রহেরও শিকার হচ্ছে৷ গৃহকর্মীদের উপর নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকবার দৃশ্যমান হয়েছে৷    

এ প্রসঙ্গে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সায়মা হক বলেন, শিশুরা এখন বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের চরম শিকার হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা জানতে পারছি যে সার্বিকভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যে ব্যাঘাত ঘটেছে তাতে আমাদের যারা দরিদ্র ও হতদরিদ্র তাদের সংখ্যা বেড়ে যাবে। নতুন অনেক পরিবার দারিদ্র্যের তালিকায় চলে আসবে। পরিবারের সদস্যদের যদি আয় কমে যায় তাহলে ওই উপার্জনক্ষম ব্যক্তির ওপর পরিবারের অন্য যারা নির্ভরশীল তাদের পুষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের ওপর খুব স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রভাব পড়বে। আর এই কারণেই এখন শিশুশ্রম বেড়ে যাচ্ছে। 

এসডিজি অর্জনে সরকার শিশুশ্রম দূর করতে বদ্ধপরিকর। ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম ও ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম বন্ধের পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪৫ লাখেরও বেশি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত, যার প্রায় ১৭ লাখেরও বেশি শিশু শ্রমিক খোদ রাজধানীতেই৷ বাংলাদেশ সরকার ঝুঁকিপূর্ণ ৩৮টি কাজে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করলেও আদতে তা মানা হচ্ছে না৷

শিশুশ্রম নির্মূলের ব্যাপারে সরকারের প্রচেষ্টায় এখন পর্যন্ত যতখানি সফলতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল কভিড-১৯ এর কারণে তা হুমকিতে পড়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) পরিচালক আবদুস সহিদ মাহমুদ। তিনি বলেন, কভিড-১৯ এর মহামারি পরিস্থিতি দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও অনিশ্চয়তা শুধু শিশুদের ঝুঁকি আরো বাড়িয়েই দেয়নি, তার সাথে দেশে শ্রমজিবি শিশুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশংকাও তৈরি করেছে। দেশে কভিড-১৯ এর মত মহামারিতে সুবিধাবঞ্চিত শিশু, পথশিশু এবং শ্রমজিবি শিশুরা কতটা অসহায় এবং নিরাপত্তাহীন তা জাতির কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই সকল শিশুদের কল্যাণের স্বার্থে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মত দেন তিনি।   


সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, শিশুদের শিশুশ্রমে নিয়োগ করে কার্যত তাদের ভবিষ্যতকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে৷ কেননা অল্প বয়সে কাজ করতে গিয়ে তারা লেখাপড়ার সুযোগ হারাচ্ছে, মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে৷ আর শিশুদের বৃদ্ধির যে স্বাভাবিক পন্থা, সেই পন্থা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে৷ তারা এমন সব কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে যেগুলো তাদের বয়সে করার কথা স্বাভাবিক অবস্থায় ভাবা যায় না৷  

দেশের জাতীয় শ্রম আইন-২০১৬ (সংশোধিত ২০১৮) অনুযায়ী ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের কোনো ধরনের কাজে নিযুক্ত করা যাবে না। যদি কেউ শিশু শ্রমিক নিয়োগ করে, তাকে পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড করার বিধান রয়েছে। কিন্তু এ বিধান শুধু কাগজে-কলমেই। বাস্তবে এর কোন প্রয়োগ নেই। সরকারিভাবে নেই নজরদারির ব্যবস্থা৷

এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন  বলেন, শিশুশ্রম বেড়ে যাওয়া এবং বাল্যবিয়ে বেড়ে যাওয়া বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য খুবই ঝুঁকির ব্যাপার। তা ছাড়া এই মহামারি শিশুদের পুষ্টিহীন করে দিচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে তাদের স্বাভাবিক বিকাশ। শিশুকালের আনন্দঘন মুহূর্তটা কেড়ে নিয়েছে করোনাভাইরাস। এসবই শিশুর জন্য খুবই ক্ষতিকর।

শিশু শ্রম বৃদ্ধির ঝুঁকি মোকাবেলায় বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা । সেগুলোর মধ্যে অধিকতর সমন্বিত সামাজিক সুরক্ষা, দরিদ্র পরিবারের জন্য সহজে ঋণ পাওয়ার সুযোগ, বড়দের মানসম্মত কাজের সুযোগ বৃদ্ধি, স্কুলের বেতন বাতিলসহ শিশুদের স্কুলে ফেরা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ, শ্রম পরিদর্শন ও আইন প্রয়োগে সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়গুলো রয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //