বিশেষ সুযোগ-সুবিধার মডেল মসজিদ নির্মাণেও অনিয়মের অভিযোগ

মসজিদ শুধু নামাজের স্থান নয়, ইসলামী গবেষণা, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চারও স্থান। মুজিববর্ষ উপলক্ষে দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় দৃষ্টিনন্দন ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করছে সরকার। এসব মসজিদে থাকছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। নানা সুবিধা সংবলিত সুবিশাল এসব মডেল মসজিদ এরমধ্যে প্রথম পর্যায়ে ৫০টি মডেল মসজিদের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে মডেল মসজিদ নির্মাণেও উঠছে অনিয়মের অভিযোগ। 

আরব বিশ্বের ইসলামিক কালচারাল সেন্টারের আদলে এসব মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত সুবিশাল এসব মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সে নারী ও পুরুষের আলাদা অজু ও নামাজ আদায়ের সুবিধা, লাইব্রেরি, গবেষণাকেন্দ্র, ইসলামিক বই বিক্রয়কেন্দ্র, কোরআন হেফজ বিভাগ, শিশু শিক্ষা, অতিথিশালা, বিদেশি পর্যটকদের আবাসন, মৃতদেহ গোসলের ব্যবস্থা, হজযাত্রীদের নিবন্ধন ও প্রশিক্ষণ, ইমামদের প্রশিক্ষণ, অটিজম কেন্দ্র, গণশিক্ষাকেন্দ্র ও ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থাকবে।

সরকারের দাবি, বিশ্বে কোনো দেশে একসঙ্গে এত বিপুল সংখ্যক মসজিদ নির্মাণ এটাই প্রথম। নান্দনিক নির্মাণশৈলীতে নির্মিত এসব মডেল মসজিদে রয়েছে একটি করে মিনার।  ৪০ শতাংশ জমির ওপর তিন ক্যাটাগরিতে নির্মাণ করা হয়েছে এসব মডেল মসজিদ ও ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ।

জেলা পর্যায়ে চারতলা, উপজেলার জন্য তিনতলা এবং উপকূলীয় এলাকায় চারতলা মডেল মসজিদ ও ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। দুর্যোগের সময় উপকূলীয় এলাকায় মসজিদগুলো আশ্রয়কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহারের জন্য নিচতলা ফাঁকা রাখা হচ্ছে।


জেলা সদর ও সিটি করপোরেশন এলাকায় নির্মাণাধীন প্রতিটি মসজিদে একসাথে ১২০০ মানুষ নামাজ পড়তে পারবেন। এছাড়া উপজেলা ও উপকূলীয় এলাকার মডেল মসজিদে একসঙ্গে ৯০০ মানুষের নামাজের ব্যবস্থা থাকবে। মডেল মসজিদ ও ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে নারী ও পুরুষের জন্য রয়েছে আলাদা অজু করার জায়গা।

নামাজের জন্য নারী ও পুরুষদের জন্য আলাদা জায়গা রয়েছে এসব মডেল মসজিদে। দেশের প্রতিটি উপজেলায় নারীদের মসজিদে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা এটাই প্রথম। সারাদেশে এসব মসজিদে প্রতিদিন ৪ লাখ ৯৪ হাজার ২০০ জন পুরুষ এবং ৩১ হাজার ৪০০ জন নারী একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারবেন।

প্রতি বছর ১ লাখ ৬৮ হাজার শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা এবং ২ হাজার ২৪০ জন দেশি-বিদেশি অতিথির আবাসন সুবিধাও রাখা হচ্ছে এসব মসজিদে। হজযাত্রীদের প্রশিক্ষণসহ হজ পালনের জন্য ডিজিটাল নিবন্ধনের বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে এসব মডেল মসজিদে।

এছাড়া ইমাম-মুয়াজ্জিনের আবাসনসহ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অফিসের ব্যবস্থা এবং গাড়ি রাখার সুবিধা রাখা হয়েছে। নতুন নির্মিত এসব মডেল মসজিদে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবারহের জন্য রয়েছে সাব স্টেশন ও শক্তিশালী জেনারেটর। ফায়ার এক্সটিংগুইশার, বজ্র নিরোধক ব্যবস্থা, সিসি ক্যামেরাসহ নানা রকম নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।

এদিকে সারাদেশের মতো সালথা উপজেলা পরিষদের পাশে সাড়ে ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে মডেল মসজিদের তিনতলা ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। এস রহমান অ্যাসোসিয়েশন নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটি করে। স্থানীয়দের অভিযোগ, এই মডেল মসজিদের নির্মাণকাজের শুরু থেকেই নানা অনিয়ম দেখা যায়। নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। ঢালাই কাজে মোটা দানার বালু ব্যবহারের পরিবর্তে স্থানীয় বালু, নিম্নমানের পাথর ও ইট ব্যবহার করা হয়েছে। মার্বেল পাথরের টাইলস লাগানোর কথা থাকলেও নিম্নমানের চায়না টাইলস লাগানো হয়েছে।

দক্ষ মিস্ত্রি দিয়ে নির্মাণকাজ করা হয়নি বলেও অভিযোগ। তাই উদ্বোধনের আগেই ফ্লোরের বিভিন্ন স্থানে টাইলসগুলো উঠে যাচ্ছে ও ফেটে গেছে। ভবনের কয়েকটি পিলার ও দেয়াল বাঁকা হয়ে আছে। এটি দেখে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আগত অতিথিরা সরেজমিনে দেখে তাৎক্ষণিক ক্ষোভ প্রকাশ করেন।


উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকা সালথা উপজেলা চেয়ারম্যান মো. ওয়াদুদ মাতুব্বর গণমাধ্যমের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মডেল মসজিদ নির্মাণ প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। সেই প্রকল্প নিয়ে অনিয়ম মেনে নেয়া যায় না। প্রধানমন্ত্রীও মেনে নেবেন না। আমরা নির্মাণকাজটি ঘুরে দেখে লক্ষ্য করেছি, নিয়মমাফিক কাজটি করা হয়নি। কাজে ব্যাপক অনিয়ম চোখে পড়েছে। যে কারণে উদ্বোধনের আগেই নিম্নমানের টাইলসগুলো ফেটে গেছে। ফ্লোর ও দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে লাগানাে টাইলস ধরলেই হাতের সাথে উঠে আসছে। পিলার ও দেয়াল বাঁকা হয়ে আছে। সাড়ে ১২ কোটি টাকার কাজে এতো অনিয়ম আসলেই মেনে নেয়া যায় না। বিষয়টি নিয়ে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলব।

এ বিষয়ে উপজেলা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সমন্বয়কারী মামুদুল হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, মডেল মসজিদ নির্মাণকাজে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। ধর্মীয় কাজ হওয়া সত্ত্বেও মসজিদের কাজে ব্যবহার করা সব মালামালই নিম্নমানের। যে কারণে দেয়ালে হাত রাখলেও পলেস্তারা ও চুন হাতের সাথে উঠে আসে। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আসা সবাই মসজিদ নির্মাণকাজের খারাপ দৃশ্য নিজ চোখে দেখে গেছেন।

ফরিদপুর ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সহকারী পরিচালক আশরাফ আলী বলেন, মসজিদ নির্মাণকাজে কিছু অনিয়ম আমরা দেখেছি। তবে ঠিকাদার এসব ঠিক করে দিতে চেয়েছেন।

কাজে অনিয়মের ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে এ কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী আতিকুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, উদ্বোধন করা হবে বলে তাড়াহুড়ো করে দ্রুতগতিতে কাজ শেষ করতে হয়েছে। এ জন্য অনেক কাজই সঠিক বা শিডিউল মতো করা সম্ভব হয়নি। তবে এখনো সময় আছে। আমি সব অসঙ্গতি, অনিয়ম ও যে সমস্যাগুলো আছে সব ঠিক করে দেব।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //