পুলিশ এত বেপরোয়া কেন

অন্যায়ের প্রতিকার পাওয়ার জন্যই পুলিশ বাহিনী। মানুষ যখন নাগরিক অসুবিধায় পড়বে, জীবনের ঝুঁকি সৃষ্টি হবে তখন পুলিশের কাছে ছুটে যাবে। কিন্ত দেশে হচ্ছে উল্টোটা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশের পক্ষ থেকেই মানুষের ওপর জুলুম এমনকি জীবনহানির ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে। পুলিশের কিছু সদস্য বিচারবহির্ভূত হত্যার হুমকি দিয়ে মানুষের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। থানায় গিয়ে এর প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। নালিশ করারও সাহস পাচ্ছেন না অনেকে। এমন বেআইনি কর্মকাণ্ড চলছে বছরের পর বছর।

গত রবিবার (১৩ জুন) কুষ্টিয়ায় প্রকাশ্যে সড়কের পাশে নারী, পুরুষ ও শিশুকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশের এএসআই সৌমেন রায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

গত বছরের ৩১ জুলাই কক্সবাজারের টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর পুলিশ তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান (৩৬)। এতে টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশসহ পুলিশের ৯ সদস্যকে আসামি করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পুলিশ অর্ডিনেন্স অনুযায়ী কারো বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ মিললে এই অপরাধের জন্য তাকে ৭-৩০ দিনের মধ্যে চাকরিচ্যুত করা যাবে। আর ক্রিমিনাল অফেন্সের সঙ্গে যদি কোনো পুলিশ সদস্য জড়িয়ে পড়েন, তাহলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই মামলা হওয়া উচিত। সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো জরুরি। এক্ষেত্রে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।

কিন্তু পুলিশের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ উঠলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার সঠিক তদন্ত হয় না। দেশে পুলিশের বিরুদ্ধে থানায় মামলা নেয়ার নজির বিরল। আর আদালতে মামলা হলেও তার তদন্ত করে ওই পুলিশই। ফলে অপরাধের কারণে পুলিশের প্রচলিত আইনে শাস্তির সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যায়।

পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, পুলিশের তত্ত্বাবধায়ক কর্মকর্তাদের শৈথিল্য মনোভাব, নিয়োগ পদ্ধতির অস্বচ্ছতা, যথাযথ প্রশিক্ষণ ও নিয়মিত মোটিভেশন না হওয়া রবং পুলিশের অপরাধের তদন্ত নিজেরা করায় উপযুক্ত শাস্তি হচ্ছে না। এ কারণে অপরাধে জড়াচ্ছে পুলিশ।  

পুলিশের সাবেক এআইজি সৈয়দ বজলুল করিম বলেন, এখন পুলিশে কেউ কেউ মনে করেন তার গডফাদার আছে। কারো কারো পলিটিক্যাল ব্যাকিং আছে। ফলে সবার ক্ষেত্রে একই ট্রিটমেন্ট হয়না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি অংশ সন্ধ্যার পর তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে বসে থাকেন। তারা তো নিজেদের পলিটিক্যাল ভাবেন। তাই তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে ব্যবস্থা নেয়া সহজ নয়।

পুলিশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার একমাত্র নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার হয়ে উঠছে আগ্নেয়াস্ত্র । ফলে কখনো রাবার বুলেট, কখনো তাজা বুলেট, কখনো ফাঁকা গুলি, কখনো নিশানা করে গুলি, কখনো ক্রসফায়ার এবং কখনো জনতার ওপর নির্বিচার (মাসফায়ার) গুলিবর্ষণের ঘটনাও ঘটছে। কিছুদিন আগে বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের নির্মাণাধীন কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে পরপর দুদিন গুলি করা এবং দ্বিতীয় দিনে প্রথম দিনের মতো ফাঁকা গুলি না করে সরাসরি বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর ঘটনা ঘটেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের ধারণা করা কখনোই ভালো নয়। বরং এতে উল্টো ফল হতে পারে এবং বৃহত্তর সমাজের মধ্যে তা ক্ষোভ ও অসন্তোষ বাড়িয়ে দিতে পারে।

প্রতিবছর গড়ে প্রায় এক লাখ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে পুলিশ সদর দপ্তরে। ২০১৮ সালে অভিযোগের ভিত্তিতে ১২ হাজার ৭৩৩ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। তবে এই শাস্তি যারা পেয়েছেন তারা কনেস্টবল থেকে ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেয়া হয়েছে লঘুদণ্ড-বদলি, প্রত্যাহার। চাকরি থেকে বরখাস্ত বা অবসরে পাঠানোর শাস্তি খুব কম সদস্যকেই দেয়া হয়েছে।

২০১৭ সালের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ওই বছর ১৪ হাজার ৩৯৫ জনকে লঘুদণ্ড দেয়া হয়েছে। চাকরিচ্যুত হয়েছেন মাত্র ২৫ জন। যারা শাস্তি পেয়েছেন তাদের অপরাধের মধ্যে আছে হত্যা, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, অপহরণ, ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, জমি দখল, ছিনতাই, ঘুষ ও মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার মতো অপরাধ। তবে আদালত বা থানায় পুলিশের বিরুদ্ধে মামলার তথ্য জানাতে পারেনি পুলিশ সদর দপ্তর।

এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, এই যেটুকু শাস্তি দেয়া হয় তাতেও পক্ষপাতিত্ব আছে। পুলিশ কর্মকর্তা মোল্লা নজরুলের ঘুষ নেয়ার ঘটনা সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ার পরও তার শাস্তি হয়নি। এসপি হারুনকে নিয়ে বিতর্ক থাকার পরও তিনি বারবার পুরস্কৃত হন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের জন্যই পুলিশ সদস্যদের অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যায় না। আদালতে মামলা হলেও সাক্ষী পাওয়া যায় না। কারণ পুলিশের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিলে প্রতিহিংসার শিকার হতে হয়।

পুলিশের সাবেক আইজি মোহাম্মদ নূরুল হুদা বলেন, পুলিশ ফোর্সের শতকরা ৮০ ভাগই কনেস্টবল থেকে ইন্সপেক্টর পদ মর্যাদার। তাই শাস্তিও তারাই বেশি পান। ইন্সপেক্টরের ওপরের পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের শান্তি দিতে পারে মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দপ্তর নয়। তারা শাস্তি পেলে তার তালিকাও পুলিশ সদর দপ্তরের প্রকাশ করা উচিত।

তার মতে, একই ধরনের অপরাধে তদন্ত ও শাস্তি দুই রকম হওয়া উচিত না। তবে তদন্ত ও শাস্তির দায়িত্ব একই ব্যক্তি বা কমিটির ওপর থাকে না। ফলে কখনো তদন্ত ঠিক হলেও শাস্তির ক্ষেত্রে সন্দেহ থাকতে পারে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

বিষয় : পুলিশ অপরাধ

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //