৮০ শতাংশ সংক্রমিত এখন ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে

উচ্চ হারে করোনা সংক্রমিত এলাকার শনাক্ত রোগীদের ৮০ শতাংশই এখন ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা আক্রান্ত। এছাড়া ১৬ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টযুক্ত করোনাভাইরাস বর্তমানে জনবহুল রাজধানী ঢাকায় চলে এসেছে। 

আগে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সীমাবদ্ধ থাকলেও, বর্তমানে এই ভ্যারিয়েন্টের করোনার কমিউনিটি সংক্রমণ হচ্ছে বলে সরকারি পর্যায় থেকেই বলা হচ্ছে। ফলে এখন থেকে আগের চেয়ে আরও বেশি সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে। আগের চেয়ে আরও বেশি মেনে চলতে হবে সামাজিক দূরত্ব। বাইরে বেরোনোর প্রয়োজন হলে মুখে মাস্ক ব্যবহার করে যেতে হবে এবং ঘন ঘন হাত ধুতে হবে সাবান দিয়ে। 

এক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। মাস্ক ব্যবহারের বিষয়টি পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের সহায়তায় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে নিশ্চিত করা সম্ভব। তবে বাস্তবতা হলো মাস্ক ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি হলেও, বাংলাদেশের একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাস্ক ব্যবহারে যথেষ্ট অনীহা রয়েছে। কিছু মানুষকে দেখা গেছে, তারা কখনোই মাস্ক ব্যবহার করেন না। 

করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং পরীক্ষায় ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টেরপক অস্তিত্বের কথা জানা গেছে সরকারি দপ্তরের তথ্য থেকেই। গত ১৬ মের পর থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নির্ণয় ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘আইদেশি’ এই পরীক্ষাগুলো করেছে। দেশের সব উচ্চ সংক্রমিত করোনা আক্রান্ত এলাকা থেকে আইইডিসিআর ও আইদেশি আরটি পিসিআর পরীক্ষায় নিশ্চিত (কনফার্মড) কোভিড-১৯ ভাইরাসের ৫০টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করে তারা বিপজ্জনক এই ভ্যারিয়েন্টের তথ্য জানিয়েছে। 

আইইডিসিআরের তথ্য মতে, করোনাভাইরাসের এই ৫০টি নমুনার ৪০টি নমুনাতেই (৮০ শতাংশ) ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট (ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট) পাওয়া গেছে। অবশিষ্ট ১০টি নমুনার ৮ টির (১৬ শতাংশ) জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। এই দুটি ভ্যারিয়েন্টই খুবই বিপজ্জনক এবং খুব দ্রুত ছড়াতে পারে। 

আইইডিসিআর আরও বলেছে, যেসব নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা থেকে সংগ্রহ করা হয় ১৬ নমুনা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সংগ্রহ করা ১৬ নমুনার ১৫টিতেই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। অপরদিকে গোপালগঞ্জ থেকে সংগৃহীত ৭টি নমুনার সবগুলোতেই এই জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। 

পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ অথবা গোপালগঞ্জেই সীমাবদ্ধ নেই, রাজধানী ঢাকাতেও পৌঁছে গেছে। রাজধানী থেকে সংগৃহীত ৪টি নুমনার ২টিতেই পাওয়া গেছে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। অপরদিকে রাজধানীর পাশেই নবাবগঞ্জ থানায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা এমন ৭ জনের নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং করে ৭টিতেই পাওয়া গেছে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। রাজধানীর নমুনা মাত্র ৪টি জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়েছে। ঢাকায় প্রায় ২ কোটি মানুষ বাস করে। এখানে করোনা আক্রান্তের সংখ্যাও বেশি। এখান থেকে মাত্র ৪টি নমুনা জিনোম সিকোয়েন্স এটা মোট জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করে না। এখান আরও অনেক বেশি জিনোম সিকোয়েন্স করা উচিত ছিল। 

এছাড়া খুলনা শহর থেকে সংগৃহীত ৩ নমুনার ৩টিতেই উল্লিখিত ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। এর বাইরে ভারত থেকে সরাসরি চিকিৎসা নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন এমন ৩ জনের নমুনায় ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে বলে আইইডিসিআর উল্লেখ করেছে। এই ৩ জন চুয়াডাঙ্গা ও খুলনায় চিকিৎসাধীন আছেন। 

ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে জনস্বাস্থ্যবিদসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল কেন এত চিন্তিত? কারণ এই ভ্যারিয়েন্টটি করোনাভাইরাসের পরিবর্তিত ধরন। এই ধরনটি অনেক বেশি ট্রান্সমিশন (একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে দ্রুত ছড়ায়) ক্ষমতাসম্পন্ন। এ ধরনের আক্রান্তরা ভারতে ও ব্রিটেনে বেশি। ভারতের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট এতই দ্রুত ছড়ায় এবং এত শক্তিশালী যে, এটা কোষের মধ্যে থাকা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে (অ্যান্টিবডি) ফাঁকি দিয়ে কোষে ঢুকে যেতে পারে। ফলে এই ধরনের ভাইরাসটিকে নিয়ে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এই ভাইরাসের সংক্রমণের কারণেই ভারতে এক দিনে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা পূর্বের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। তবে সেখানে বর্তমানে সংক্রমণ কিছুটা কমতির দিকে। 

অন্যদিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত এলাকা ছিল এক সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জ। সেখানকার ৫৫ শতাংশের বেশি নমুনায় করোনা পাওয়া গেছে। সে কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কয়েক সপ্তাহের জন্য ছিল লকডাউনে। ৮ জুন থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে লকডাউন কিছুটা শিথিল করা হয়েছে; কিন্তু অন্যান্য জেলাতে সংক্রমণের উর্ধ্বগতির কারণে লকডাউন চলছে। 

ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট টিকার কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে। এমনকি সবচেয়ে বেশি কার্যকর টিকা নামে পরিচিত ফাইজার ও মডার্নার টিকাও ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে পুরোপুরি কার্যকর নয়। ফাইজার এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের টিকার প্রথম ডোজ নেওয়ার তিন সপ্তাহ পর ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে ৩৩ শতাংশ সক্ষম। তবে ইউকে বা কেন্ট ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে এটি ৫০ শতাংশ সক্ষম বলে দেখা গেছে। পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের তথ্য অনুসারে, হাসপাতালে ভর্তি এবং মৃত্যু এড়াতে এসব টিকা আরও বেশি কার্যকর। ফাইজারের টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার পর তা ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের লক্ষ্মণ ঠেকাতে ৮৮ শতাংশ কার্যকর বলে দেখা গেছে। আর ইউকে ভ্যারিয়েন্ট ঠেকাতে সেটা ৯৩ শতাংশ কার্যকর। অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাটি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ঠেকাতে ৬০ শতাংশ কার্যকর বলে দেখা গেছে। আর কেন্ট ভ্যারিয়েন্ট ঠেকাতে সেটি ৬৬ শতাংশ কার্যকর। দেখা গেছে, সর্বোচ্চ সক্ষমতা পেতে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার বেশি সময় লাগে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হওয়া করোনার বি ১.১৭ ধরন এবং ভারতীয় ধরন বি ১.৬১৭ সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে কমতে শুরু করলেও, উদ্বেগজনকভাবে ভারতীয় ধরনের আরও বিপজ্জনক রূপান্তর ঘটেছে। ১৩ মে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশে শনাক্তকৃত ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে শিশুরাও আক্রান্ত হয়েছে। এতেই বোঝা যায়, এই ভ্যারিয়েন্টটি কতটা বিপজ্জনক। সাধারণত করোনাভাইরাসে শিশুরা কমই আক্রান্ত হয়ে থাকে। আবার সংক্রমিত হলেও এদের মধ্যে লক্ষ্মণ প্রকাশ পায় না। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে উল্লেখযোগ্য সংক্রমক শিশুরা আক্রান্ত হয়েছে। আইইডিসিআর বলেছে, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত ৩ জনের বয়স (৭ শতাংশ) ১০ বছরের নিচে। ৭ জনের বয়স (১৮ শতাংশ) ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ জিনোম সিকোয়েন্সের করা ১৭ জনই শিশু; এ ছাড়া জিনোম সিকোয়েন্সের ১০ জনের বয়স (২৫ শতাংশ) ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। ৮ জনের বয়স (২০ শতাংশ) ৪১ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে, ৪ জনের বয়স (১০ শতাংশ) ৫০ বছরের উর্ধ্বে। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তদের মধ্যে ২৪ জন (৬০ শতাংশ) পুরুষ।

এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তদের মধ্যে ৮ জন ভারত ভ্রমণ করেছেন। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত ১৮ জন বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসেছিলেন। ১৪ জন (৩৫ শতাংশ) রোগী বাংলাদেশের বাইরে কোথাও ভ্রমণ করেননি অথবা বিদেশ থেকে এসেছেন এমন কারও সংস্পর্শে আসার ইতিহাস পাওয়া যায়নি। আইইডিসিআর বলছে, কোভিড-১৯-এর ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের বাংলাদেশে কমিউনিটি সংক্রমণ ঘটেছে। 

আইইডিসিআর বলেছে, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার সীমান্তবর্তী এলাকাসহ অন্যান্য জেলায় বেড়ে যাচ্ছে। সংক্রমণের হার হ্রাস করার লক্ষ্যে এবং দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টসহ করোনার অন্যান্য ভ্যারিয়েন্ট বিস্তার রোধে আইইডিসিআর সবাইকে মাস্ক ব্যবহারের পাশাপাশি অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে। স্বাস্থ্যবিধির মধ্যে জনসমাগম এড়িয়ে চলা, অন্যদের থেকে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং নিয়মিত সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়ার কথা বলেছে।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //