বাড়ছে সাইবার বুলিং, টার্গেটে তরুণীরা

করোনাকালে নারীর প্রতি সহিংসতাজনিত নানা ধরনের অপরাধ প্রবণতা বেড়ে চলেছে। নারীর প্রতি সহিংসতার ধারাবাহিকতায় অনলাইনে নারীদের যৌন হয়রানি বা সাইবার বুলিংয়ের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। 

ইউনিসেফের এক জরিপ অনুযায়ী, দেশে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া ৩৮ শতাংশ মানুষের বয়স ১০ থেকে ১৩ বছর; ৩৬ শতাংশের বয়স ১৪ থেকে ১৫ বছর এবং ২৫ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ১৭ বছর। ঢাকায় অনলাইনে হয়রানির শিকার নারীদের ৭০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। 

বাংলাদেশসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশের ওপর চালানো এক জরিপের বরাত দিয়ে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব দেশে সাইবার বুলিংয়ের ঝুঁকি উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে এবং নারী ও অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীরা সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে বুলিংয়ের।  

সাইবার বুলিং বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবাধ বিচরণ। হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক ও রেডিটসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সাইবার বুলিইংয়ের অনেকভাবে প্রকাশ ঘটে থাকে। একজনের ছবি বা ভিডিও অনলাইনে বিকৃত করা, একজন অন্যজনকে হেয় প্রতিপন্ন করার মতো সাইবার বুলিং এখন বড় একটি সমস্যা। সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে অনেকেই হতাশায় ভোগেন। কেউ কেউ আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়।  

সিআইডির সূত্র বলছে, গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত সাইবার পুলিশ সেন্টারের ফেসবুক পেজে ১৭ হাজার ৭০৩টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এছাড়া ফোনে অভিযোগ করেছেন ৩৮ হাজার ৬১০ জন ভুক্তভোগী। এর মধ্যে হয়রানির অভিযোগ ৩৬৫টি। বেশিরভাগ অভিযোগই তরুণীদের। 

আত্মমর্যাদার বিষয়টি বুলিংয়ের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। উত্যক্তকারীরা সাধারণত মানসিকভাবে দুর্বল এমন মানুষকে লক্ষ্য করে থাকে। ইউরোপিয়ান জার্নাল অব ডেভেলপমেন্ট সাইকোলজির একটি গবেষণা মতে, যাদের আত্মমর্যাদার অনুভূতি যতটা দুর্বল, তারা তত বেশি বুলিংয়ের শিকার হয়ে থাকেন। অর্থাৎ মানুষের দুর্বল জায়গায় আঘাত করাটা উত্যক্তকরণের প্রধান উদ্দেশ্য। ব্যক্তির স্পর্শকাতর বিষয়কে কেন্দ্র করে ক্ষতি করতেই মূলত এমনটা করা হয়।

বেসরকারি সংস্থার এক গবেষণায় জানা যায়, দেশের ৬৮ শতাংশ নারী সাইবার স্পেসে হয়রানির শিকার হন। সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া এসব নারীর প্রায় সবাই তরুণী। ১৪ থেকে ২৩ বছর বয়সি এসব নারীর সাথে ঘটে যাওয়া অধিকাংশ ঘটনাই ঘটছে সম্পর্কের টানাপোড়েনের জের ধরে। সাইবার বুলিংয়ের শিকার নারীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অভিযোগের মধ্যে পর্নোগ্রাফি, ব্ল্যাকমেইল, ফেসবুক আইডি হ্যাক, অর্থ আদায় ও হত্যার হুমকি উল্লেখযোগ্য। 

সম্প্রতি মোহাম্মদ ইয়াসিন রাতুল নামের এক তরুণকে গ্রেফতার করে সিআইডি। অন্তত ২০ জন তরুণীর সাথে প্রেমের নামে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে ভিডিও ধারণ করেছে সে। ওইসব ভিডিও দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আত্মসাৎ করে আবার শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে বাধ্যও করেছে সে। সিআইডি জানায়, সর্বশেষ ছয় মাস আগে রাতুলের সাথে রাজধানীর এক তরুণীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একদিন তারা তিন বন্ধু মিলে রাতুলের সাথে লঞ্চে চাঁদপুর ঘুরতেও যান। সেখানে তার অজান্তে আপত্তিকর ভিডিও ধারণ করে রাতুল। লঞ্চ থেকে নামার পর তার মোবাইল ফোনটি কথা বলার জন্য চেয়ে নেয়। এরপর পালিয়ে যায়। ওইদিন থেকেই তাকে ভয় দেখিয়ে টাকা দাবি করতে থাকে রাতুল। 

সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, রাতুলের মতো এমন অনেককেই তারা আইনের আওতায় এনেছেন। অপরাধের গুরুত্ব বুঝে মামলা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। তাদের মতে, সিআইডির কাছে যতগুলো অভিযোগ এসেছে, তার অধিকাংশই প্রেমঘটিত সাইবার ক্রাইম। এসব ক্ষেত্রে তরুণীদের আরো সচেতন হওয়া প্রয়োজন। 

তারা বলেন, সাইবার ক্রাইম যে পর্যায়ে চলে গেছে, এখন লজ্জা আর ভয় পেলে চলবে না। সাইবার স্পেসে হয়রানির শিকার হলে সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগ করতে হবে। 

ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার নাজমুল ইসলাম বলেন, সমস্যা হচ্ছে সাইবার অপরাধের ধরন প্রতিদিনই পাল্টে যাচ্ছে৷ আমরাও সেই অনুযায়ী আমাদের তদন্ত, অনুসন্ধান ও প্রযুক্তি আপডেট করছি৷ ঢাকায় সাইবার অরপরাধ দমনে আমরা সক্ষম। কিন্তু সারা দেশে সেই সক্ষমতা গড়ে ওঠেনি। তবে কাজ চলছে। প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি হচ্ছে।

অনলাইনকেন্দ্রিক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে বিভিন্ন অ্যাপস বন্ধের প্রয়োজন বলে মনে করেন অনেকে। তবে তথ্য প্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা মনে করেন, অ্যাপস বন্ধ করা যেমন কঠিন তেমনি সেগুলো নিষিদ্ধ করেও লাভ নেই। 

তিনি বলেন, নিষিদ্ধ করে ব্যবহার ঠেকানো যায় না। এর জন্য দুইটি বিষয়ে জোর দেয়া প্রয়োজন। সাইবার অপরাধ দমনে পুলিশের সক্ষমতা আরো বাড়ানো এবং দরকার প্যারেন্টাল গাইডেন্স।

তার মতে, সন্তান যে গ্যাজেটটি ব্যবহার করছে তার প্যারেন্টাল কন্ট্রোল অন করে দিতে হবে। ফলে সন্তান যদি কোনো নিষিদ্ধ অ্যাপ ব্যবহার করে, সাইটে ঢোকে বা গ্রুপে তৎপর হয় তাৎক্ষণিকভাবে তিনি তার নোটিফিকেশন পাবেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়টিকে তুলে ধরলে ক্রমান্বয়ে সচেতনতা বাড়বে। এ ব্যাপারে মানুষকে আরো সুস্পষ্টভাবে জানানোর জন্য শিক্ষামূলক কনটেন্ট আপলোড করা বা তুলে ধরা যেতে পারে। কেউ সাইবার বুলিং করলে তাকে আইনের আওতায় এনে বিষয়টির যথার্থ সমাধান করতে হবে এবং এ ঘটনার শিকার ব্যক্তিকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দানের ব্যবস্থা করতে হবে।

জানা গেছে, ইউনিসেফের সহায়তায় শিক্ষার্থী-শিক্ষক ও অভিভাবকদের নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারে করণীয়, শিক্ষার্থীরা বিপদে পড়লে করণীয়- এসব নিয়ে ছোট ছোট ভিডিও তৈরির কাজ করা হচ্ছে। এই ভিডিওগুলো করোনার সময়ে অনলাইন ক্লাসে ও করোনার পরে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের দেখানো হবে। 

হয়রানির শিকার যে কেউ সরাসরি বিটিআরসিতে যোগাযোগ করা যায়। বিটিআরসি ফোনে ও ইমেইলে দুইভাবেই অভিযোগ গ্রহণ করে থাকে। বিটিআরসির কম্পিউটার সিকিউরিটি ইনসিডেন্স রেসপন্স টিম এ ধরণের সমস্যায় সহায়তা করে থাকে। বিটিআরসিতে হয়রানির অভিযোগ জানাতে কল করা যায় (০২)৭১৬২২৭৭ নম্বরে। এছাড়াও মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হটলাইন ১০৯২১ নম্বরে ফোন করলেও গোপনীয়তা রক্ষা করে এ ধরনের সমস্যার সমাধান করা হয়। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //