শাটডাউনে কী হতে পারে

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু প্রায় সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার কারণে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি সারাদেশে ১৪ দিনের পূর্ণাঙ্গ শাটডাউনের পরামর্শ  দিয়েছে। এ ‍খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা চলছে। লকডাউন আর শাটডাউনের মধ্যে পার্থক্য কী জানতে চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও নানা লেখালেখি হচ্ছে।

শাটডাউন বলতে কী বোঝানো হয়েছে জানতে চাইলে জাতীয় কারিগরি পরার্মশক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেন, ‘শাটডাউন মানে হচ্ছে সবকিছু বন্ধ থাকবে, শুধু জরুরি সেবা ছাড়া। অফিস-আদালত, বাজারঘাট, গণপরিবহনসহ সব বন্ধ থাকবে। সবাই বাসায় থাকবে।’

অধ্যাপক সহিদুল্লাহ বলেন, ‘দিল্লি এবং মুম্বাইতে শাটডাউন দিয়ে ফলাফল পেয়েছে। সেখানে ছয় সপ্তাহ গণপরিবহন বন্ধ ‍ছিলো, এছাড়াও দিল্লিতে আরো ছিলো তিন সপ্তাহ। দিল্লিতে প্রতিদিন একসময় ২৮ হাজার শনাক্ত হতেন, কিন্তু এখন সেখানে ১৫০ শনাক্ত হচ্ছেন। মৃত্যুও কমে এসেছে।’

‘জরুরি সেবা বলতে, ওষুধ, ফায়ার সার্ভিস, গণমাধ্যম ছাড়া সবকিছু দুই সপ্তাহ বন্ধ করে মানুষ যদি এই কষ্টটুকু মেনে নেয়, তাহলে আগামীতে ভালো হবে। নইলে এখন যেভাবে শনাক্ত প্রতিদিন বাড়ছে, সেটা কোথায় যাবে তা সহজেই অনুমেয়’-বলেন অধ্যাপক সহিদুল্লাহ।

একাধিক রোগতত্ত্ববিদ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণ ও মৃত্যু ক্রমশ বাড়ছে। যে কোনো দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে শনাক্তের হার পাঁচ শতাংশের নিচে এবং ধারাবাহিক তিন থেকে চার সপ্তাহ একই হারে শনাক্তের হার ধরে রাখতে হয়। বর্তমানে দেশে করোনা শনাক্ত রোগীর হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছয় হাজার ছাড়িয়েছে। গত ২৩ ও ২৪ জুন দুই দিনে ১৬৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনায় সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা এভাবে ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকলে হাসপাতালে রোগীর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা দুরূহ হয়ে পড়বে।

তারা বলেন, ‘এখনো দেশে লকডাউন চলছে। চলমান বিধিনিষেধ আগামী ১৫ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত বাড়িয়ে এ বিষয়ে গত ১৬ জুন প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্বশাসিত ও বেসরকারি অফিস, ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করে খোলা থাকবে।’

সারা দেশে কমপক্ষে ১৪ দিন সম্পূর্ণ ‘শাটডাউন’ করতে করোনাসংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সুপারিশকে যৌক্তিক বলে মনে করেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন।

তিনি বলেন, যেহেতু করোনার সংক্রমণ বাড়ছে, সে জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয়ভাবেও কঠোর বিধিনিষেধ দেয়া হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় সেটি চলছে। সেখানে তা কার্যকরও হচ্ছে। এখন ঢাকার চারপাশের সাত জেলাতেও কঠোর বিধিনিষেধ দেয়া হয়েছে। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি সরকার কিছুদিন ধরেই গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এখন জাতীয় পরামর্শক কমিটি যে সুপারিশ করেছে, সেটি যৌক্তিক। সরকারেরও ইতিমধ্যে এই ধরনের প্রস্তুতি আছে। সরকারও কঠোর বিধিনিষেধের চিন্তাভাবনা করছে। যেকোনো সময় সরকার তা ঘোষণা দেবে।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, শাটডাউনে জরুরি সেবা ছাড়া যানবাহন, অফিস-আদালতসহ সবকিছু বন্ধ রাখা প্রয়োজন। এ ব্যবস্থা কঠোরভাবে পালন করতে না পারলে আমাদের যত প্রস্তুতিই থাকুক না কেন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অপ্রতুল হয়ে পড়বে।

চলতি বছর করোনা সংক্রমণ বাড়ায় গত ৫ এপ্রিল থেকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। গত ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত ঢিলেঢালা লকডাউন হলেও সংক্রমণ আরো বেড়ে যাওয়ায় ১৪ এপ্রিল থেকে ‘কঠোর লকডাউন’ ঘোষণা করে সরকার। পরে সিটি করপোরেশন এলাকায় গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়। তবে দূরপাল্লার বাস, লঞ্চ ও ট্রেন চলাচল ঈদ পর্যন্ত বন্ধ ছিলো। পরে ২৪ মে থেকে গণপরিবহন চলার অনুমতি দেয়া হয়।

কিন্তু পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় সাত জেলায় পূর্ণাঙ্গ লকডাউন ও ঢাকার সাথে যান ও জনচলাচল বন্ধ করার নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু তারপরও মানুষ নানা উপায়ে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় ছুটছে। এমতাবস্থায় পরিস্থিতি আরো খারাপের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ প্রসঙ্গে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য প্রফেসর ডা. তরিকুল ইসলাম বলেন, লকডাউন শব্দটা জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে এর কার্যকারিতা নষ্ট করেছে। মিটিংএ আমরা শাটডাউনের পাশাপাশি আরেকটি শব্দ জুড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেটা চূড়ান্ত বিবেচনায় গৃহীত হয় নি। আমরা বলেছিলাম, শাটডাউন হবে অনেকটা কারফিউএর মত। অর্থাৎ সব বন্ধ। কোনকিছুই খোলা থাকবে না। এক্ষেত্রে আমরা সামরিক, আধা-সামরিক বাহিনীকে নামানোর ব্যাপারেও অনুরোধ করতে চাই। কারণ আমরা আর যেন গা’ছাড়া ভাব না দেখাই। সারা দেশ আগামী দু’সপ্তাহের জন্য যদি বন্ধ করে দেয়া না হয় তাহলে অনেক বড় বিপর্যয় আসতে পারে। এবং সেই বিপদ কাটিয়ে ওঠা আমাদের জন্য কঠিন হবে।  

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //