টিকার সংকট কাটলেও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে সংক্রমণ ও মৃত্যু

দেশে টিকা সংকট কাটতে শুরু করলেও সীমান্তের জেলাগুলোতে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। বিশেষ করে খুলনা বিভাগের অবস্থা দিন দিন আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। গত দুইদিনে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ৪০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন ১১ হাজার ৬৫১ জন, যা একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্তের রেকর্ড। 

সীমান্তবর্তী জেলার পাশাপাশি রাজধানী ঢাকাও এখন করোনার ‘হটস্পট’ হয়ে উঠছে। হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে রোগীর চাপ। এদের চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। অনেক হাসপাতালে ইতোমধ্যে খালি নেই আইসিইউ শয্যা। জটিল রোগীকে বাঁচাতে তাদের স্বজনরা আইসিইউর জন্য এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছেন।

দেশে গত এপ্রিলে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার পর থেকে ভারতের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের শনাক্তের হার বৃদ্ধি পেতে থাকে। দেশে  এই ভ্যারিয়েন্ট মে মাসে ৪৫ শতাংশ ও জুন মাসে ৭৮ শতাংশ নমুনায় শনাক্ত হয়। বর্তমান দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সুস্পষ্ট প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। রবিবার (৪ জুলাই) প্রতিষ্ঠানটির প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়।

আইইডিসিআর বলছে, বাংলাদেশে ২০২০ সালের  ডিসেম্বর থেকে এই বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সিকোয়েন্স করা সকল নমুনায় আলফা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া যায়। মার্চ মাসে সিকোয়েন্সকৃত মোট নমুনার ৮২ শতাংশ বিটা ভ্যারিয়েন্ট ও ১৭ শতাংশ আলফা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। এপ্রিল মাসেও বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিতদের মধ্যে বিটা ভ্যারিয়েন্টের প্রাধান্য ছিলো।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষায় প্রাপ্ত ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কিত তথ্য জিনোম সিকোয়েন্সের বৈশ্বিক ডাটাবেজে জিআইএসএ আইডিতে জমা দেয়া হয়ে থাকে। যে ধরনের ভ্যারিয়েন্টই হোক না কেন, তা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণই করাই একমাত্র উপায়। এর সঙ্গে কোডিড-১৯ টিকাপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে ভ্যাকসিন নেয়া প্রয়োজন।

আইইডিসিআর জানায়, সারাবিশ্বে কোভিড-১৯ সংক্রমণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাসটি পরিবর্তিত হয়ে নতুন চেহারা ও বৈশিষ্ট্য ধারণ করছে, যা ভ্যারিয়েন্ট নামে পরিচিত। সংক্রমণের গতি রোগের জটিলতা (মৃত্যু হার ও হাসপাতালে ভর্তির হার), রোগ পরবর্তী ৩ টিকা গ্রহণ পরবর্তী রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা বিবেচনায় কিছু কিছু ভ্যারিয়েন্টকে ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমন আলফা, বিটা, গামা ও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ভাইরাসটি ২০১৯ সালে প্রথম শনাক্তের পর থেকে এখনো পর্যন্ত অনেকগুলো ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। বাংলাদেশে সংক্রমিত মানুষের মধ্যে ভাইরাসটির ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তের জন্য দেশে এ রোগটি শনাক্ত হওয়ার শুরু থেকে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর), আইসিডিডিআর,বি ও আইদেশী যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গত ডিসেম্বর হতে জুন পর্যন্ত মোট ৬৪৬টি সংগৃহীত কোভিড-১৯ নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং সম্পন্ন করা হয়েছে। এ সকল নমুনায় কোভিড -১৯ এর আলফা ভ্যারিযৈন্ট (ইউকে-তে প্রথম শনাক্ত), বিটা ভ্যারিয়েন্ট (সাউথ আফ্রিকায় প্রথম শনাক্ত), ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট (ভারতে প্রথম শনাক্ত), ইটা ভ্যারিয়েন্ট (নাইজেরিয়াতে প্রথম শনাক্ত), বি ১.১.৬১৮ ভ্যারিয়েন্ট (আনআইডেন্টিফাইড) শনাক্ত হয়েছে।

দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়ায় সরকারকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। ভারত থেকে টিকা সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে বিকল্প দেশ থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহে চেষ্টা চালায় সরকার। আর সেই চেষ্টা সফলতার মুখও দেখতে শুরু করেছে। এর মধ্যে চীন থেকে সরকারের কেনা দেড় কোটি টিকার ২০ লাখ ডোজ দেশে এসেছে। এছাড়া কোভ্যাক্স থেকে এসেছে ফাইজারের ১ লাখ ৬২০ ডোজ ও মডার্নার ২৫ লাখ ডোজ। কোভাক্সের আওতায় জাপান ও ইইউ থেকে আরো ৩৫ লাখ ডোজ টিকা এ মাসের শেষ সপ্তাহে পাওয়া যাবে বলে জানা গেছে। 

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, চীন ও মডার্নার টিকা আসার পর গতকাল থেকে পুনরায় শুরু হয়েছে গণটিকার নিবন্ধন। নিবন্ধনের বয়সসীমা কমিয়ে ৩৫ বছর করা হয়েছে। দেশে এ পর্যন্ত টিকা এসেছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে সরকারের কেনা ৭০ লাখ ডোজ এবং ভারত উপহার হিসেবে দিয়েছে ৩২ লাখ ডোজ। চীনের সিনোফার্ম থেকে এসেছে কেনা টিকার ২০ লাখ ডোজ এবং উপহার হিসেবে চীন দিয়েছে ১১ লাখ ডোজ। কোভ্যাক্স থেকে ফাইজারের টিকা এসেছে ১ লাখ ৬২০ ডোজ এবং মডার্নার ২৫ লাখ ডোজ। এর মধ্যেই সিনোফার্মের টিকা দিয়ে সারা দেশের মেডিকেল কলেজ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিকাদান শুরু হয়েছে। ফাইজারের টিকা দেয়া হচ্ছে প্রবাসী শ্রমিকদের।

টিকার বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্সের আওতায় চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে কিংবা আগস্টের শুরুতে বাংলাদেশ ৩৫ লাখ টিকা পেতে যাচ্ছে। এই ৩৫ লাখ ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা বলে জানা গেছে। ফলে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার অভাবে যে ১৫ লাখ লোক দ্বিতীয় ডোজের টিকা পাচ্ছিলেন না, সেই সংকট কেটে যেতে পারে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের চুক্তি অনুযায়ী অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়ায় এই অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। 

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন গতকাল তার বাসায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ সপ্তাহে বা আগামী সপ্তাহে জাপান কোভ্যাক্সের আওতায় টিকার চালান পাঠাবে। কোভ্যাক্সের আওতায় বলে এটা বিনামূল্যে পাব। জাপান থেকে আড়াই মিলিয়ন টিকা পেতে পারি।’ জাপান  কোন টিকা পাঠাবে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘জাপানের কাছ থেকে আমরা অ্যাস্ট্র্যাজেনেকার টিকা পাব। আর কোভ্যাক্সের আওতায় ইউরোপ থেকে বাংলাদেশ ১০ লাখ টিকা পাবে।’

গত মঙ্গলবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, রাশিয়ার উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের টিকা স্পুটনিক-ভি কিনতে চুক্তি সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ। এখন শুধু বাংলাদেশ সরকারের ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদনের অপেক্ষা। টিকা কেনার প্রাথমিক সিদ্ধান্তের পর বেশ কিছু বিষয় নিয়ে রুশ সরকারকে সংশোধন দিয়েছিল বাংলাদেশ। পরে সেসবের সংশোধন এনে দুই দেশের মধ্যে এ চুক্তি হয়। 

তিনি আরো জানিয়েছেন, ‘ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার চালান আসার কথা রয়েছে আগামী মাসে। তবে কত ডোজ করে টিকা দেবে সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেনি।’ 

সিরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কভিশিল্ডের তিন কোটি ডোজ কেনার জন্য গত বছরের শেষ দিকে চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ। সেই টিকার প্রথম চালান পাওয়ার পর ৭ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে গণটিকাদান শুরু হয়। কিন্তু দুই চালানে ৭০ লাখ ডোজ পাঠানোর পর ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দিলে সংকটে পড়ে বাংলাদেশ। এরপর চীন থেকে উপহার হিসেবে আসে সিনোফার্মের ১১ লাখ ডোজ টিকা। পরবর্তীতে চীনের সিনোফার্ম থেকে দেড় কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তি করে বাংলাদেশ। এই চুক্তির প্রথম চালানে ২০ লাখ ডোজ টিকা দেশে এসেছে। এখন যৌথভাবে করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের উপরাষ্ট্রদূত হুয়ালং ইয়ান। 

তিনি তার ফেসবুক পেজে এ তথ্য জানান। হুয়ালং ইয়ান লেখেন, ‘ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যৌথভাবে করোনার টিকা উৎপাদনের জন্য চীনের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের এখানকার অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করছে। অনেক উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণার পাশাপাশি টিকা উৎপাদন করছে চীন। একই সঙ্গে চীন অনেক দেশের টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের দেশে টিকার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা চালাতে সহায়তা করেছে। চীনের তৈরি করোনার টিকার নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। ফলে চীনের টিকা আন্তর্জাতিকভাবে সুনাম অর্জন করেছে।’ 

টিকা দেশে আসতেই নিবন্ধন ও টিকাদান নিয়ে নতুন নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। নির্দেশনায় ৩৫ বছরের বেশি সবাইকে নিবন্ধনের আওতায় আনাসহ কারা এসব টিকা পাবেন সেই তালিকা দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) কভিড-১৯ ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক ডা. মো. শামসুল হক স্বাক্ষরিত এক নির্দেশনায় এ তথ্য জানানো হয়েছে। ১২টি সিটি করপোরেশন এলাকার নির্দিষ্ট টিকা কেন্দ্রে (ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, বরিশাল) মডার্নার টিকা দেয়া হবে। আর সব জেলা ও উপজেলায় সিনোফার্মের টিকা দেয়া হবে। রেজিস্ট্রেশন ছাড়া কেউ টিকা নিতে পারবেন না।

৩৫ বছরের ঊর্ধ্বে সব নাগরিক টিকার জন্য রেজিস্ট্রেশনের করতে পারবেন। পর্যায়ক্রমে এসএমএসের মাধ্যমে তারিখ জানিয়ে টিকাদান করা হবে। সৌদি আরব ও কুয়েতগামী প্রবাসী শ্রমিকদের ফাইজারের টিকাদানের জন্য নির্ধারিত সাতটি কেন্দ্র সংরক্ষিত থাকবে। কেন্দ্রগুলো হলো- ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শেখ রাসেল গাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। অন্যান্য দেশের প্রবাসী শ্রমিকরা এই কেন্দ্র বাদে অন্য কেন্দ্রে নিবন্ধন করে টিকা নিতে পারবেন। বিদেশগামী শিক্ষার্থীরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তালিকাভুক্ত হয়ে সুরক্ষা অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন সম্পন্ন করে টিকার আওতায় আসবেন বলে জানা গেছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //