ঈদে স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন

করোনা পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা

দেশে বেড়েই চলেছে করোনাভাইরাসে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার। এর পরেও বিধিনিষেধ শিথিলের পর ঈদযাত্রায় হারিয়েছিল স্বাস্থ্যবিধি। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসটির ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে প্রায় কোটি মানুষ ঢাকা ছাড়েন। এতে যাত্রাপথে দেখা দেয় চরম বিশৃঙ্খলা। স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই লঞ্চ ও ফেরিতে গাদাগাদি করে ওঠেন যাত্রীরা। বাসেও মানা হয়নি স্বাস্থ্যবিধি। এরপর গ্রামেও হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন। এর ফলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদকে কেন্দ্র করে মানুষ যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করেছে, তাতে সংক্রমণ ও মৃত্যু আরো বাড়বে। করোনার সংক্রমণ এখন ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সংক্রমণ পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে।

অতীতের প্রবণতা বিশ্লেষণ করে ধারণা করা যায় যে, চলতি সংক্রমণের সর্বোচ্চ চূড়ার দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

এদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আগস্টের শেষে করোনাভাইরাস সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা করছে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর), যেটির সংক্রমণ ছড়াতে পারে ডিসেম্বর পর্যন্ত বলে আশঙ্কা গবেষকদের। ভারতে তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে।

অন্যদিকে শুক্রবার (২৩ জুলাই) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, সামনে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারব কি-না, তা এখন বুঝতে পারছি না। তবে সরকারের ব্যবস্থাপনা যথেষ্ট ভালো আছে।

গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপর ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালতসহ গণপরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ রাখা হয়েছিল। ক্রমেই সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকে।

প্রথমে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী ও মাদারীপুর থেকে ধাপে ধাপে বিস্তার ঘটিয়ে সারাদেশে রোগটি ছড়িয়ে পড়ে। গত বছরের মে মাসের শেষ সপ্তাহে ঈদ কেন্দ্র করে হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করে। এরপর জুন-জুলাই মাসে সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এজন্য ঈদযাত্রাকে দায়ী করা হয়।

কারণ, দূরপাল্লার পরিবহন, লঞ্চ ও ট্রেন বন্ধ থাকার পরও মানুষের ঈদযাত্রা ঠেকানো যায়নি। অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেটকার, পিকআপ ভ্যানে বিকল্প পথে গাদাগাদি করে গ্রামে ছুটেছিলেন হাজার হাজার মানুষ।

এরপর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে গ্রামেও। চলতি বছর মে মাসে রোজার ঈদকে কেন্দ্র করে সংক্রমণ ও মৃত্যু বৃদ্ধির আশঙ্কা করে বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, জুন মাসে সংক্রমণ ও মৃত্যু আবারো বাড়বে। ওই ঈদযাত্রা ঠেকাতে দূরপাল্লার পরিবহন বন্ধ রাখা হয়েছিল। তবে চালু রাখা হয়েছিল আন্তঃজেলা পরিবহন ব্যবস্থা। এ সময় হাজার হাজার মানুষ গ্রামে আসা-যাওয়া করেন। এর মধ্যেই মে মাসের মধ্যভাগ থেকে সংক্রমণপ্রবণ ভারতীয় ধরন ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করে মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই সংক্রমণ ও মৃত্যু আবারো বাড়তে থাকে। জুন মাসে দেড় লাখের ওপরে শনাক্ত হয়। মৃত্যুবরণ করেন প্রায় দুই হাজারের মতো মানুষ। জুলাই মাসের ২৩ দিনে গড়ে প্রতিদিন ১৮৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঊর্ধ্বমুখী এ সংক্রমণের মধ্যে উদযাপন হয়ে গেলে পবিত্র ঈদুল আজহা।

ঈদ উপলক্ষে গত ১৫ জুলাই থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ শিথিলের ঘোষণা দেয় সরকার। এরপরই অবাধে চলাচল শুরু হয়। এ অবস্থায় ঈদ-পরবর্তী সময়ে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।


বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের শুরু থেকেই সরকারের নানা অব্যবস্থাপনা দেখা গেছে। অনেক ক্ষেত্রে কথা ও কাজের মিল থাকেনি, কী সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে সেটি বোঝাও দুরূহ হয়েছে অনেক সময়। এর মধ্যে ১ জুলাই থেকে কঠোর বিধিনিষেধের লকডাউন আট দিনের জন্য শিথিল করে সরকার।

শুক্রবার (২৩ জুলাই) থেকে ফের শুরু দেশব্যাপী ১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধ। সকাল ৬টায় শুরু হওয়া এ বিধিনিষেধ চলবে ৫ আগস্ট রাত ১২টা পর্যন্ত।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা কমিটির অন্যতম সদস্য আবু জামিল ফয়সাল বলেন, যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।

চলমান বিধিনিষেধ শুরু হওয়ার আগে সপ্তাহখানেক ধরে লাখ লাখ মানুষ যেভাবে গাদাগাদি করে শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে গেছে, তার প্রভাব কী হতে পারে সেটি দেখার জন্য আরো তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। আগামী কিছুদিনের মধ্যে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। এখন সংক্রমণ এবং মৃত্যুর যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, সেটি আসলে তিন সপ্তাহ আগের অবস্থার বর্তমান পরিণতি।

তিনি বলেন, মানুষের কাছ থেকে মানুষের মাঝে সংক্রমণ বন্ধ করাই এখন আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ। আমাদের এটি রোধ করতেই হবে। কারণ সংক্রমণের পিক এখন খুব দূরে আছে তা বলা যাবে না।

সংক্রমণ রোগ বিষয়ক সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীরও বলেন, বাংলাদেশে এখন করোনাভাইরাসের পিক বা চূড়া।

গ্রামাঞ্চলে তো স্বাস্থ্যবিধি বলতে কিছু নেই, এটাই বাস্তবতা। বর্তমানে জাতীয়ভাবে শনাক্তের হার বাড়তে বাড়তে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে এবং এই হার বেড়ে হয়তো ৩০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।

এটাই স্বাভাবিক যে, আক্রান্তের সংখ্যা যত বেশি হবে মৃত্যুর সংখ্যা ততই বাড়তে থাকবে। আমরা খুব সৌভাগ্যবান হবো যদি দেখি যে সংক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। তবে সংক্রমণ কতটা কমবে সেটি নির্ভর করবে বিধিনিষেধের সফলতার ওপর।

বেশিরভাগ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. রোবেদ আমিন বলেন- আমরা লক্ষ করেছি, জরুরি প্রয়োজন ছাড়াও অনেকে বাইরে বের হচ্ছেন। এতে আমরাই নিজেদের ক্ষতি নিজেরা করছি।

আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে যদি আমরা করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, পরিস্থিতি অত্যন্ত করুণ হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, কভিড-১৯ এর যে অ্যারিয়েল অব কনসার্ন আছে তার মাধ্যমে মৃত্যু শুধু বয়স্ক মানুষের হচ্ছে না, তরুণদেরও হচ্ছে। বিভাগ ওয়ারি বিভিন্ন স্থানে আমরা দেখেছি, সব জেলাতেই কভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়েছে এবং সংক্রমণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে যাচ্ছে। সাথে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে পারব কি-না, তা এখনো বুঝতে পারছি না। অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তবে সরকারের ব্যবস্থাপনা যথেষ্ট ভালো আছে।

শুক্রবার (২৩ জুলাই) রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।

আগের বিধিনিষেধ খুব একটা কাজে আসেনি জানিয়ে অধ্যাপক খুরশীদ আলম বলেন, আগের দুই সপ্তাহের বিধিনিষেধে তেমন প্রভাব দেখা যায়নি। তবে সীমান্তবর্তী জেলায় সংক্রমণ কমেছে এবং আরো কিছুদিন পরে বিধিনিষেধের প্রভাব বোঝা যাবে।

দেশে করোনার সংক্রমণের এ অবস্থায় অক্সিজেনের অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, স্বাভাবিক সময়ে অক্সিজেনের চাহিদা ৭০ থেকে ৯০ টনের মতো থাকে; কিন্তু এখন তা ২০০ টনে চলে গেছে। তবে এখনো দেশে অক্সিজেনের জোগান আছে এবং ভারত থেকেও আমদানি হচ্ছে। এছাড়াও, ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণে সক্ষমতা থাকার পরেও ঢাকার বাইরে থেকে রোগীরা ঢাকায় আসছেন।

করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা সম্পর্কে তিনি বলেন, দেশে অন্যান্য টিকা যেভাবে দেয়া হয়, সেভাবেই করোনার টিকা দেয়া যায় কি-না এবং আরো সহজ কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে ভাবছে সরকার।

এদিকে দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১৯৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৪৬ জনে। এ সময় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৬ হাজার ৭৮০ জন। এতে মোট শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৪৪ জনে।

শনিবার (২৪ জুলাই) স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো করোনাবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। এর আগে, শুক্রবার ১৬৬, বৃহস্পতিবার ১৮৭, বুধবার ১৭৩, মঙ্গলবার ২০০ ও সোমবার সর্বোচ্চ ২৩১ জনের মৃত্যু হয়। রবিবার ২২৫ ও শনিবার ২০৪ জন মারা যান। গত ৭ জুলাই প্রথমবারের মতো দেশে মৃতের সংখ্যা ২০০ ছাড়ায়। এদিন মৃত্যু হয় ২০১ জনের।

এদিকে করোনাভাইরাসের রূপ বদল নিয়ে ভয়াবহভাবে উদ্বিগ্ন গোটা বিশ্ব। প্রথম ঢেউ আছড়ে পড়ার পর একাধিকবার ভোল বদলেছে করোনাভাইরাস। আলফা, বিটা, ডেল্টা, গামা ভ্যারিয়্যান্টগুলোর দাপটে গোটা বিশ্ব। বর্তমানে ডেল্টা ভ্যারিয়্যান্ট দাপট দেখাচ্ছে গোটা বিশ্বে। এবার শীতকালে করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়্যান্ট থাবা বসাতে পারে, গোটা বিশ্বকে এমনই সতর্কবার্তা দিলেন ফ্রান্সের এক গবেষক। 

ফ্রান্স সরকারের সায়েন্টিফিক কাউন্সিলের প্রধান জ্যঁ-ফসোয়াঁ দেলফেসি জানিয়েছেন, শীতকালে করোনার একটি নতুন ভ্যারিয়্যান্ট তৈরি হতে পারে, এমন আশঙ্কা দেখতে পাচ্ছি।  

দেলফেসি বলেন, শীতকালে নতুন একটি ভ্যারিয়্যান্ট তৈরি হতে পারে বলে মনে করছি। কিন্তু এই ভ্যারিয়্যান্ট কতটা ভয়াবহ হতে পারে বা সংক্রামক হতে পারে, সেই বিষয়ে এখনও কিছু ধারণা করা যাচ্ছে না। 

করোনা পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে, ওই বিষয়েও আশার কথা বলেন তিনি। এই বিশেষজ্ঞের কথায়, '২০২২ বা ২০২৩ সালে খুব সম্ভবত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে।'

করোনা সংক্রমণের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপের কথা জানান তিনি। জ্যঁ-ফসোয়াঁ দেলফেসির কথায়, আগামী কয়েক বছরে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে সামাজিক সহাবস্থান। করোনাভাইরাসের হাত থেকে মুক্তির জন্য টিকাদানে বিশেষ জোর দিয়েছেন তিনি। যারা টিকা পেয়েছেন এবং যারা টিকা পাননি তাদের সমন্বয় বজায় রেখে চলা বড় চ্যালেঞ্জ, জানান তিনি। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //