সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৈষম্যের সমাধান কোন পথে

সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে বেতন-ভাতা নিয়ে বৈষম্যের অভিযোগ বহুদিন ধরেই। অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলে ১১-২০ গ্রেডের কর্মচারীরা শতকরা হারে বেতন বৃদ্ধি দ্বিগুণ দেখানো হলেও টাকার অংকে আর্থিক সুবিধা বাড়েনি। বরং বাদ পড়েছে সিলেকশন গ্রেড, মহার্ঘ ভাতাসহ নানা সুবিধা। কমেছে টাইমস্কেল, ইনক্রিমেন্ট। 

এ বৈষম্য দূরীকরণে কর্মচারীদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে বহু আবেদন নিবেদন করা হলেও  সমস্যা নিরসনে তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। 

রাজু আহমেদ নামে এক কর্মচারী সম্প্রতি ফেসবুকে লেখেন, একই দফতরে চাকরি করে কেউ লাখ টাকার পশু কোরবানি করে, আর কেউ স্ত্রী সন্তানের মুখে কোরবানির মাংস তুলে দিতে না পারার যন্ত্রনায় ছটফট করে। 

সুব্রত সাহা লেখেন, ১১ তম গ্রেডের একজন কর্মচারীর প্রতিদিনের বেতন ৪১৭ টাকা। ছয়জনের পরিবারে প্রতিজনের হিসাবে ৭০ টাকারও কম। এর নিচেও আরো ৯টি গ্রেড আছে। 

সরকারি চাকরিজীবীদের সম্মিলিত অধিকার আদায় ফোরামের  সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান ফেসবুকে লেখেন, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এই কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেও ১১ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা বাড়ালো! অথচ আমাদের সরকার সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে কথাই বলছেন না,আমরা যতই আবেদন নিবেদন করছি তারা কোনো ভ্রুক্ষেপ করছে না। ১১থেকে ২০গ্রেডের কর্মচারীদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, আর কতদিন এই অবস্থার মধ্যে আমরা থাকবো? 

সরকারি কর্মচারীদের পক্ষ থেকে গত ৩১ মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে সচিবকে লিখিত আবেদন করা হয়। চিঠিতে বলা হয়, মন্ত্রণালয়ের সচিব থেকে শুরু করে একজন অফিস সহায়ক পর্যন্ত সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, যারা ২০টি গ্রেডে বিভক্ত। এর মধ্যে ১১-২০তম গ্রেডভুক্ত কর্মচারীরা বরাবরই বৈষম্যের শিকার। হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে অল্প কিছু সাফল্য এসেছে, যা ন্যায়সঙ্গত প্রত্যাশার চেয়ে কম। বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ঐতিহাসিক বিজয় অর্জনের পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার জাতীয় বেতন স্কেলে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জন্য ১০টি গ্রেডের একটি সুষম বেতন কাঠামো উপহার দেন। ১৯৭৭ সালের বেতন স্কেলে ১০টি গ্রেডের পরিবর্তে ২০টি গ্রেডে বেতন স্কেল বাস্তবায়ন করে বৈষম্যের সূত্রপাত করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৫ সালে সচিবালয়ের সঙ্গে সচিবালয়ের বাইরের কর্মচারীদের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করে বৈষম্যকে আরেক দফা বৃদ্ধি করা হয়। 

কর্মচারীদের অনেকে বলেন, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকার দিনবদলের কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে রূপকল্প ২০২০-২১ বাস্তবায়নে ব্যাপক জনমত নিয়ে যাত্রা করলে আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম বঙ্গবন্ধুকন্যার হাত দিয়ে এ বৈষম্যের অবসান হবে, কিন্তু আমাদের সে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। সর্বশেষ অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল ঘোষণার প্রাক্কালে আবারো পুনরায় বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। বেতন দ্বিগুণ করার ষোষণা দিয়ে বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করা হলো একদিকে, অন্যদিকে এ ষোষণার আড়ালে টাইম স্কেল সিলেকশন গ্রেড বাতিল করে বঞ্চিত করা হলো কর্মচারীদের। শুধু তাই নয়, অতীতের নিয়মিত তিনটি টাইম স্কেল পেয়ে ১৬তম বছরে আমাদের বেতন বৃদ্ধির তুলনায় বর্তমান নিয়মে ১৬তম বছরে আমাদের উল্টো আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। 

১১-২০ গ্রেডের সরকারি চাকরিজীবীদের সম্মিলিত অধিকার আদায় ফোরামের নেতারা বলেন, বর্তমানে অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সীমিত আয়ের কর্মচারীরা সংসারের ন্যূনতম ব্যয় বহনে দিশেহারা। এ অবস্থা হতে উত্তরণের কোনো পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ১৯৭৩ সালে প্রণীত ১০ ধাপের বেতন কাঠামো ৭৫ পরবর্তীতে ২০টি ধাপে পরিণত করে বৈষম্যের সৃষ্টি করা হয়েছে।

 ৭৫ পরবর্তীতে প্রতিটি জাতীয় বেতন স্কেল প্রণয়নের ক্ষেত্রে ০১-১০তম গ্রেডের অভ্যন্তরীণ ধাপগুলোর আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি করে ১১-২০তম গ্রেডগুলোর সুবিধা ক্রমাগত সঙ্কুচিত করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলে ০১-১০ গ্রেডের মোট ব্যবধান দাঁড়ায়-১,৫৫,৬২০/- টাকা যা মোট টাকার ৯৪ শতাংশ, অপরদিকে ১১-২০ গ্রেডের ব্যবধান মাত্র ৬,৩৭৫/- টাকা যা মোট টাকার ৬ শতাংশ।

বেতন দ্বিগুণ ঘোষণার আড়ালে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত করা হয় ২০১৫ সালের বেতন স্কেল- ১৪তম গ্রেডভুক্ত একজন সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক ২০০৯ সালের সপ্তম জাতীয় বেতন স্কেলের নিয়মে ১০,২০০/- টাকা স্কেলে সিলেকশন গ্রেড এবং ৮,১২ ও ১৫তম বছরে টাইম স্কেল সুবিধা পেয়ে ১৬তম বছরে মূল বেতন পেত মোট ২৮,৮১০/- টাকা। একই পদধারী একই স্কেলে ২০১৫ সালের পে-স্কেলের নিয়মে ১৬তম বছরে দুইবার উচ্চতর স্কেল পেয়ে মূল বেতন পাবে ২২,৪৫০/- টাকা যা পূর্বের নিয়মের চেয়ে ৬,৩৬০/- টাকা কম। প্রথমোক্ত নিয়মে ৫ বছর পরপর সরকারিভাবে জাতীয় বেতন বৃদ্ধির সুবিধা পেত, দ্বিতীয় নিয়মে সে সুযোগপ্রাপ্তি বন্ধ হয়ে গেল।

কমচারী নেতারা বলেন, বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে যে স্বীকৃতি অর্জন করেছে এ অবদান কোনো গোষ্ঠীর একার নয়, বরং যারা রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে দেশের তৃণমূল পর্যায়ে সরকারি কর্মসূচির সাফল্য আনয়ণে প্রাণপন লড়াই করেছেন তারাই এর বড় অংশীদার, সুতরাং প্রাপ্তি তাদের হওয়ার কথা, কিন্তু তাদের বঞ্চিত করে একটি বিশেষ গোষ্ঠী একাই সকল সুবিধা ভোগ করবে তা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

এ বিষয়ে কর্মচারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মো. আকতার হোসেন বলেন, মন্ত্রণালয়ের সচিব থেকে শুরু করে একজন অফিস সহায়ক পর্যন্ত সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, যারা ২০টি গ্রেডে বিভক্ত। এর মধ্যে ১১ থেকে ২০তম গ্রেডভুক্ত কর্মচারীরা বরাবরই বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এ বৈষম্য দূর করা দরকার। 

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য সম্প্রতি একটি প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছে বলে জানিয়েছেন কর্মচারী সংগঠনের নেতারা। গত ২০ জন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব মো. সাজ্জাদুল হাসান স্বাক্ষরিত চিঠি অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিবকে পাঠানো হয়। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //