‘কাগুজে’ স্বীকৃতিতে আটকে আছে বৃহন্নলাদের জীবন

বৃহন্নলা- মহাকাব্যে উপেক্ষিত তো নয়ই, বরং সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত। নারীর ছদ্মবেশে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন ‘বৃহন্নলা’ নামে বিরাট রাজার রাজকন্যা উত্তরার নৃত্যগীতের শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন। সেই থেকে না পুরুষ না নারী, কিংবা একই দেহে নারী-পুরুষ, ক্লিবলিঙ্গের মানুষকে বলা হয় বৃহন্নলা। চলতি কথায় ‘হিজড়া’।

তাদের এই নামকরণের সঙ্গে পেশার পরিবর্তন, সেটাও সামাজিক বিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে। এক সময় চিরন্তন কোনো প্রথাকে উপলক্ষ্য করে সমাজে তারা কিছু গুরুত্ব পেলেও, পরে নানা কারণে পরিস্থিতি বদলায়। নারীদেহে বাহারি শাড়ি পরে পুরুষালি মুখে সস্তা মেকআপে তাদের এখন প্রায়ই দেখা যায় ট্রেন-বাস-সিগন্যাল কিংবা দোকানে দোকানে হাত পাততে। কখনো আবার বাড়ি বাড়ি চলে যায় সদলবলে। ‘খুশী’র বিনিময়ে আশীর্বাদ করে নবদম্পতি বা সদ্য নবজাতককে। এটা তাদের সামাজিক প্রথা, মূল পেশাও বটে।

তাদের বিরুদ্ধে যদিও রাজ্যের অভিযোগ রয়েছে জোর করে টাকা আদায়ের, না দিলে অশ্রাব্য গালাগাল থেকে শারীরিক নিগ্রহ পর্যন্ত হতে হয়। দাবিকৃত মোটা অঙ্কের চাঁদা না পেলে নবজাতককে নিয়ে টানাহেঁচড়ার মতো ঘটনাও দেখা যায় প্রায়ই। আগে সম্মান পাওয়া বৃহন্নলারা তাই আজ সমাজের চোখে অচ্ছ্যুত, অপাঙ্ক্তেয়।

ত্রিশোর্ধ্ব মানিক শৈশব থেকেই পরিবারের ভালোবাসা পাননি। তৃতীয় লিঙ্গের অধিকারী হওয়ায় স্কুল গেটেও প্রবেশ করতে পারেননি কখনো। অন্য শিশুরা তার সঙ্গে মিশলে ‘নষ্ট’ হয়ে যাবে, তাই তাকে পড়ার সুযোগ দিতে রাজি হননি স্কুলের শিক্ষক ও সমাজপতিরা। অপমান-অবহেলা সহ্য করতে না পেরে ঢাকায় চলে আসেন স্কুলজীবনেই। কোনো এক সময় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অফিস সহকারীর কাজে যোগ দেন। নিজের কথা বলার ঢং, চালচলনের জন্য খুব বেশি দিন অবশ্য চাকরিটা টেকেনি তার। কোনো মেসেও ঠাঁই মিলছিল না। রাতের পর রাত স্টেশনে অভুক্ত কাটানোর পরে হঠাৎই যোগাযোগ হয়ে যায় একটা বৃহন্নলা দলের সঙ্গে। তার পরে তাদের একজন হয়ে যাওয়া তো নেহাত সময়ের অপেক্ষা। মানিক থেকে তিনি এখন মনিকা। 

হিজড়াদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজের নিয়মানুযায়ী, এলাকাভিত্তিক দল পরিচালনা করেন ‘গুরুমা’। তার আখড়ায় থাকেন বাকিরা। নিয়ন্ত্রিত এলাকার বাড়ি বাড়ি কিংবা দোকান ঘুরে তারা চাঁদা তুলে আনার পরে সেই টাকা ভাগ হয় সবার মধ্যেই। ফলে দরিদ্রতা পিছু ছাড়ে না। পেট চালানোই যেখানে দায়; সেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদন, চাকরির স্বপ্ন- সবই মরীচিকা। চাকরি চলে যাওয়ার পর অন্য প্রতিষ্ঠানে যাননি কেন- জবাবে মনিকা বলেন, ‘প্রবাদ আছে- আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী। আমাদের মুখ দেখলেই তো ঢুকতে দেয় না কত জায়গায়, চাকরি দেবে কী! আমি জানি, আমাদের মেনে নিতে এই সমাজের আরও ৫০ বছর লাগবে।’

সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের হিসাবানুযায়ী, দেশে সরকারিভাবে নথিভুক্ত হিজড়ার সংখ্যা ১১ হাজারের মতো। বেসরকারি হিসাবে এর প্রকৃত সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। ঢাকাতেই বাস লাখের ওপর। মূলত সামাজিক মূল্যবোধ, বিধিনিষেধ ও ডাক্তারি নিরীক্ষা জটিলতার কারণে বেশিরভাগই নিজেদের সরকারি নথিভুক্ত করেননি। এ দিকে দলবলে বসবাস করেও পদে পদে সমস্যার সমুখীন হতে হয় হিজড়াদের। হাত পাতলে নানা বঞ্চনা। যৌনবৃত্তিতে পুলিশি হয়রানি। নির্যাতনের শিকার হয়ে থানায় গেলে মামলা দিতে বিড়ম্বনা। এমনকি কোনো সদস্য মারা গেলে তাদের জানাজা বা সৎকার নিয়েও নানা জটিলতা হয়। তাই প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিতসহ

বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করতে সরকার ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর এদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়। ওই নীতিমালা অনুমোদনের পর শিক্ষা, চিকিৎসা ও আবাসন সুবিধা ভোগে আশার বীজ বুনেছিল হিজড়ারা; কিন্তু কাজীর গরু যেন কিতাবেই রয়ে গেছে। ভাগ্য বদল হয়নি সমাজের সুবিধাবঞ্চিত এই মানুষগুলোর। আগের মতোই চলছে দুঃসহ জীবন। 

চলতিপথে একদিন বিকেলে রাজধানীর বাড্ডায় এপেক্স ব্র্যান্ডের জুতার শোরুমের সামনে সাত-আট জন হিজড়ার জটলা চোখে পড়ে। শোরুমের ম্যানেজারের কাছে তাদের মাত্র ১০ টাকার বায়না। হাত পাততেই পেয়ে গেলেন সেই টাকা। এরপর এক এক করে ওই এলাকার প্রায় সবকটি দোকানেই চলে তাদের এই ‘বকশিশ’ আদায়। দেশের প্রায় সব এলাকাতেই এভাবে টাকা তুলে চলে তাদের জীবন। কেউবা রাতের আঁধারে পার্ক কিংবা রাস্তার পাশেই বিক্রি করেন নিজের যৌবন।

বাড্ডার সেই দলে ছিলেন লতা ও দীপালি। কথা প্রসঙ্গে লতা বলেন, ‘আইন আর নীতিমালা কী বুঝি না। আগেও মানুষের কাছে হাত পাততাম, এখনো পাতি; নইলে খামু কী?’ ক্ষোভ নিয়েই তিনি বললেন, ‘পত্রিকায় লেইখা আমাদের লাভ কী? এমন কত নিউজই তো হইল। নেতারা আমাগোর লাগি কোনো কিছুই করে না। এহন পারলে ১০ টাকা দেন, উপকার হইবো।’ লতার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সখী দীপালি বলতে শুরু করলেন, ‘তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। শুনেছি এতে নাকি চাকরি করতে পারব। আপনাদের মতো বেঁচে থাকতে পারব; কিন্তু গার্মেন্টসে গিয়ে হেলপারের চাকরি চেয়েও পাইনি। সেখানকার লোকজন বলে- আইন হয়েছে তাতে কী, আমাদের না-কি স্বভাব বদল হওয়ার না। টু-লেট দেখে বাসাভাড়া চাইতে গেলে বাড়িওয়ালা জানিয়ে দেয়- ভাড়া হয়ে গেছে। সরকারি সাহায্য পাই না। শুধু আইন করে কী লাভ বলেন?’

হিজড়াদের পুনর্বাসন নিয়ে অনেকদিন থেকেই কাজ করছেন মাহিরা আফরোজ। এ সম্প্রদায়ের ওপর চলা নানা নির্যাতনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেও অনেক ক্ষেত্রেই এখনো হিজড়াদের সাংবিধানিক, মৌলিক ও আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রতিনিয়তই তারা নানাভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এ সম্প্রদায়ের যারা স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করেন, তারা নির্যাতনের শিকার হন সবচেয়ে বেশি। আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অনেকেই জোর করে বিকৃত যৌন চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করে, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়; কিন্তু মুখ ফুটে কেউ কিছু বলতে পারে না। কেননা লোকে তাদের কথা বিশ্বাস না করে উল্টো তাদের ঘারেই দোষ চাপায়।’ মাহিরা আরও বলেন, ‘হিজড়া সম্প্রদায়ের বড় অংশই শিক্ষার অধিকার থেকে যেমন বঞ্চিত, তেমনি মানবিক ও মৌলিক অধিকার পেতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। তাদের নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই। বেশিরভাগই বাদাইখাটা বা এক ধরনের ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।’

মৌসুমী নামে বছর ত্রিশের এক হিজড়া বলেন, ‘জীবিকার প্রয়োজনে একসময় মঞ্চে নাচ-গান করতাম; কিন্তু দেখতে সুশ্রী হওয়ায় প্রতিনিয়তই যৌন লালসার শিকার হই। দলের মালিককে বিচার দিয়েও কোনো লাভ হতো না। তিনিও ধরে নিয়েছেন যে, কিছু মানুষের মনোরঞ্জন করব বলেই তো আমাকে দলে রাখা; কিন্তু আমার এসব ভালো লাগতো না। তাই নাচ-গান ছেড়ে সবজির ব্যবসায় নামি; কিন্তু স্বস্তি নেই, যেখানেই যাই কিছু বিকৃত রুচির পুরুষ পিছু নেয়। নানাভাবে বিরক্ত করে, গায়ে হাত দেয়। তাদের বিকৃত যৌনকামনা পূরণ করতে চায়। একা আমাদের এ সমাজে টিকে থাকা দায়।’

হিজড়াদের ওপর যৌন নির্যাতন হলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে তার কোনো প্রতিকার নেই। ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের একাধিক কৌসুলি জানিয়েছেন, এ আইনে কেবল নারী ও শিশুদের ওপর বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন, ধর্ষণ এবং ধর্ষণচেষ্টার মামলা গ্রহণ ও শুনানির বিধান রয়েছে; কিন্তু হিজড়াদের ওপর যৌন নির্যাতনের প্রতিকার কিংবা তাদের অভিযোগের বিষয়ে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে- এ নিয়ে অবশ্য আইনটিতে কিছু বলা নেই। তাদের যৌন নির্যাতন করা হলে, সেটি ধর্ষণ না-কি বলাৎকার সে বিষয়েও কারও কোনো ধারণা নেই।

এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট রাজীব সাহা বলেন, ‘হিজড়া সম্প্রদায় সাংঘাতিকভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও, আমাদের কাছে কেউ কখনো অভিযোগ নিয়ে আসেনি। এটি অন্যান্য অপরাধের মতোই একটি ফৌজদারি অপরাধ। আমরা চাই এ বিষয়টি সামনে আসুক। তারা যেন আইনি প্রতিকার পান। তবে আমরা অবশ্য চাইব হিজড়াদের প্রতি যৌন হয়রানি ও যৌন নির্যাতনের বিষয়টি যেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাদের জীবনাচার তো নারীদের মতোই।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //