গণপরিবহনের নৈরাজ্য চলছেই

বর্ধিত ভাড়া আদায় বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেই

বাংলাদেশে গণপরিবহনে নৈরাজ্য দীর্ঘ দিনের। সম্প্রতি জ্‌বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর যাত্রীদের জিম্মি করে সরকার নির্ধারিত ভাড়া থেকেও, অনেকগুণ বেশি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। চার্ট অনুযায়ী ভাড়া নিচ্ছেন না পরিবহন শ্রমিকরা। যাত্রীদের সঙ্গে এ নিয়ে ঝগড়া-ঝাটি ও বাগবিতন্ডা লেগেই আছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ যাত্রীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তবে তারা মনে করছেন, যাত্রী হয়রানি বন্ধের কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার কেউ নেই। মাঠে যদিও বিভিন্ন সংস্থার ভ্রাম্যমাণ আদালত রয়েছে এবং তারা অনিয়ম পেলেই জরিমানা করছেন; কিন্তু অধিকাংশ বাস বা বাসের রুট থেকে যাচ্ছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের দৃষ্টির আড়ালে। 

এ ছাড়াও বহুল আলোচিত ১৯৬৯ সালের সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবির মধ্যে অন্যতম ছিল বাস-ট্রেন-লঞ্চে শিক্ষার্থীদের ‘হাফ ভাড়া’ নেওয়ার দাবিটি। এরপর দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও, এখনো শিক্ষার্থীদের সেই দাবি বাস্তবে রূপ পায়নি। সামরিক কিংবা গণতান্ত্রিক- কোনো সরকারের আমলেই বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি। গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির পর দাবিটি আবারও সামনে এসেছে। দাবি আদায়ে রাজধানীসহ সারাদেশে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। দিন দিনই বাড়ছে আন্দোলনের পরিধি।

সাধারণ যাত্রী আর শিক্ষার্থীদের দাবি হচ্ছে, ন্যায্য ভাড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তবে বাস শ্রমিকদের ধর্ষণের মতো হুমকির দায় পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা নিতে ইচ্ছুক নন।

সড়ক, সেতু ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘পরিবহন মালিক সমিতি ও শ্রমিক ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। দ্রুত বাস ভাড়া নিয়ে বিতর্কের অবসান হবে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতাদেরকে যাত্রী ভোগান্তি থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান হয়েছে। তা না হলে দায়ী পরিবহনের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ 

মন্ত্রীর এই আহ্বানের মধ্যেও কোনো বাসে ভাড়া কমিয়েছে- এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার জানিয়েছেন, তাদের ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা নিচ্ছে। কাউকে কাউকে জরিমানাও করা হচ্ছে; কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ে এ ধরনের ব্যবস্থা এর আগেও নেওয়া হয়েছে। বাড়তি ভাড়া আদায় ঠেকানো যায়নি।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির একাধিক নেতৃবৃন্দ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা চিন্তা-ভাবনা করছি। 

যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, গণপরিবহনে অনেক নৈরাজ্য চলছে। এ নৈরাজ্য আর চলতে দেওয়া যায় না। অর্ধেক ভাড়া দিতে চাওয়ায় বাস হেলপার কর্তৃক একজন ছাত্রীকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার ঘটনায় আমরা স্তম্ভিত। কতিপয় পরিবহন শ্রমিক কতটা উদ্ধত ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, এটি তারই প্রকাশ। পাশাপাশি দেশের গণপরিবহনে নারীদের নিরাপত্তাহীনতার চিত্রও এর মধ্য দিয়ে পরিস্ফুট হয়েছে, বলা যায়। বস্তুত, গণপরিবহনে নারীরা প্রায়ই ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনসহ নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এ জন্য দায়ী মূলত বিচারহীনতার সংস্কৃতি।

মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, গণপরিবহনে যৌন হয়রানি, ধর্ষণ ও হেনস্তার ঘটনায় অপরাধীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে এ ধরনের হুমকি দেওয়ার ধৃষ্টতা থাকবে না। এতে কোনো সন্দেহ নেই। একইসঙ্গে নারীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরির্বতনও জরুরি। নারী কেন গণপরিবহনে ধর্ষণের শিকার হবে, হুমকির শিকার হবে, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির শিকার হবে? গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। 

নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, গণপরিবহন কোম্পানিগুলো সিটিং সার্ভিস ও গেটলক সার্ভিসের নামে যাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। যাত্রীদের কাছ থেকে নিজেদের ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে। অথচ এই নৈরাজ্য দেখার কেউ নেই। প্রতিবাদ করলে উল্টো হেনস্তার শিকার হতে হয়। সরকার যোগাযোগ ব্যবস্থায় গুরুত্ব দিলেও, নগর পরিবহন ব্যবস্থার ব্যাপারে উদাসীন। এ কারণেই এই সেক্টরে নৈরাজ্য বাড়ছে। 

তিনি আরও বলেন, সরকার সমর্থক লোকজন পরিবহনের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া বাড়ালেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। বরঞ্চ সাধারণ যাত্রীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। যাত্রীদের জন্য সরকারের কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে কি-না আমার জানা নেই। তবে আমি যতটুকু পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, মনোপলি খেলায় যাত্রীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। 

যাত্রী সাহনাজ আক্তার বলেন, তেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। এটি অযৌক্তিক। লিটারে ৫ টাকা করে বাড়ালে সাধারণ মানুষের জন্য ভালো হতো। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর ভয়াবহ চাপ তৈরি হয়েছে।

বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন আরিফুল ইসলাম। ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, উত্তরা থেকে মিরপুর আসতে আগে ভাড়া ছিল ৩০ টাকা। এখন সেখানে নিচ্ছে ৪০ টাকা। আমাদের বেতন তো আগের মতোই আছে। তবে নতুন বাড়তি ভাড়ার টাকা আসবে কোথা থেকে।

তিনি বলেন, চাকরিজীবী মানুষের যে বেতন বাড়ছে না, সেটি নিয়ে কেউ কথা বলে না। এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। তার ওপর আবার যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধি করেছে ২৭ শতাংশ; কিন্তু আদায় করা হচ্ছে ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ। এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। 

বাস ও লঞ্চযাত্রীদের ওপর জুলুম করা হয়েছে। ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে কৌশলে ভাড়া বাড়িয়ে নিলেন মালিকরা। অযৌক্তিক পদ্ধতিতে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। রেওয়াজ অনুযায়ী, তেলের দাম বাড়লে দূরপাল্লার বাস এবং সিএনজির দাম বাড়লে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়। এবার তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে সব বাসের ভাড়া বাড়ানো হলো। ওয়েবিলের নামে ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধ হচ্ছে না। যদিও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এখন সিটিং বা ওয়েবিল থাকার কথা নয়; কিন্তু বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //