ডেল্টাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে ওমিক্রন

ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী এখনো বুস্টার ডোজ পায়নি

করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট এখন সত্যি সত্যিই একটি আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্রিটেনে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমণ কমে এলেও, বাংলাদেশে হু হু করে বাড়ছে। দেশে গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে মোট নমুনা পরীক্ষার আড়াই শতাংশ করোনা শনাক্ত হলেও, এখন তা ২১ শতাংশে ঠেকেছে। এক মাসেই সংক্রমণের এত উচ্চ গতি, এর আগের দুটি ঢেউয়ে দেখা যায়নি।

ওমিক্রন ঠেকাতে ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে বাংলাদেশ এক থেকে দেড় মাস সময় পেলেও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এর থেকে কোনো সুবিধা নিতে পারেনি। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে বুস্টার ডোজের আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণেই তিন সপ্তাহের ব্যবধানে ২১ শতাংশের ওপরে উঠে গেছে করোনা শনাক্তের হার।

চিকিৎসকরা ধারণা করছেন, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই করোনা শনাক্তের হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে এবং ডেল্টা ধরন শেষ হয়ে শুরু হতে পারে ওমিক্রনের ভীতিকর অবস্থা; কিন্তু এর মধ্যেই একটি আশার খবর হলো করোনার ডেল্টা ধরনের মতো ওমিক্রন বেশি দিন টিকে থাকতে পারছে না এ পরিবেশে। ব্রিটেনে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ কমতে শুরু করায় আশা করা হচ্ছে, বাংলাদেশেও খুব শিগগিরই অমিক্রন সংক্রমণ সর্বোচ্চ শিখরে উঠেই একই গতিতে নেমে যাবে।

ওমিক্রন ঠেকাতে যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি : এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসের ধরনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংক্রামক ভ্যারিয়েন্ট হলো ওমিক্রন। এই ভ্যারিয়েন্টকে সরকার একটু চেষ্টা করলেই বাংলাদেশে আসা ঠেকিয়ে দিতে পারত। আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়েতে ওমিক্রন বাংলাদেশের চেয়ে অনেক আগে ছড়িয়েছে, তা সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অজানা থাকার কথা নয়। তবু বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটারদের সে দেশে পাঠানো হয়েছে। সরকারের উচিত ছিল নারী ক্রিকেটারদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার কাজটি জিম্বাবুয়ে থেকেই করিয়ে আনা; কিন্তু তা করা হয়নি। নারী ক্রিকেটারদের ছাড়াও ওমিক্রন বাংলাদেশে চলে আসত বৈশ্বিক যোগাযোগের কারণে; কিন্তু তা আরও বেশি বিলম্বিত করানো যেত। এর মধ্যেই দেশের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে বুস্টার ডোজের আওতায় নিয়ে আসা যেত। এটা করতে পারলে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী আরও বেশি নিরাপদ থাকত। জনগণের প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক ধরনের অবহেলা ও উদাসীনতা হিসেবে এটা ধরে নেওয়া যায়। তবে বুস্টার ডোজ শুরু হয়েছে; কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় দেওয়া হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত ষাটোর্ধ্ব অনেকেই এসএমএস পাননি। 

যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, যারা করোনাভাইরাসের তিনটি ডোজই নিয়েছেন, তারা ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত হলে হাসপাতালে ভর্তি হবার সম্ভাবনা ৮১ শতাংশ কম থাকে। তাদের বিশ্লেষণে দেখা যায়, তিন ডোজ টিকা নেওয়ার পরে ওমিক্রনের কার্যকারিতা থাকে মাত্র ১২ শতাংশ। তবে এ সুরক্ষা কতদিন স্থায়ী হয় এবং আগামী দিনগুলোতে আরও বুস্টার টিকা নিতে হবে কি-না তা এখনো জানা যাচ্ছে না। ইউরোপ-আমেরিকায় যথেষ্টসংখ্যক মানুষকে বুস্টার ডোজ দেওয়া হলেও, ইসরায়েলে ইতিমধ্যে ওমিক্রনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য জনগণকে দ্বিতীয় বুস্টার ডোজ অর্থাৎ টিকার চতুর্থ ডোজ দেওয়া শুরু হয়েছে। দেশটির সরকার অনেক আগে প্রথম বুস্টার অর্থাৎ তৃতীয় ডোজ শেষ করেছে গত বছরই।

ওমিক্রন ছাড়িয়ে যাচ্ছে ডেল্টাকে : করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ধরন খুব শিগগিরই ডেল্টা ধরনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ১৭ জানুয়ারি নমুনা পরীক্ষার সাপেক্ষে দেশে করোনা শনাক্তের হার ছিল ২০.৮৮ শতাংশ। ১৭ জানুয়ারি সারাদেশে ৩১ হাজার ৯৮০টি নমুনা পরীক্ষা করে ৬ হাজার ৬৭৬ জনকে করোনা শনাক্ত করা হয়। 

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ১৭ জানুয়ারি জানিয়েছেন, বর্তমানে বাংলাদেশে করোনা শনাক্তের ৬৯ শতাংশই ওমিক্রন ধরনে শনাক্ত হচ্ছে। এটা বলা হয়েছে রাজধানী ঢাকার জিনোম সিকোয়েন্সের ওপর ভিত্তি করে। এর ১০ দিন আগে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের ফলে রাজধানীতে ওমিক্রনের হার ছিল মাত্র ১৩ শতাংশ। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই হয়তো ওমিক্রন শনাক্ত ১০০ শতাংশে পৌঁছে যেতে পারে।

তবে ইউরোপ-আমেরিকার বিজ্ঞানীরা বলছেন, ওমিক্রন ডেল্টাকে ছাড়িয়ে গেলেও ওমিক্রনই হতে পারে করোনার শেষ ধরন এবং এটি দিয়েই শেষ হতে পারে করোনার মহামারি। ২০২২ সালই হতে পারে করোনা মহামারির শেষ বছর। এ বছরই করোনা মহামারির বৈশিষ্ট্য দুর্বলতর হয়ে রূপ নিতে পারে সাধারণ রোগে অর্থাৎ এটা চলে আসতে পারে অ্যান্ডেমিক পর্যায়ে। তখন করোনা হলেও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী ছাড়া অন্যদের শুধু সর্দি-কাশি ও জ্বরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকতে পারে রোগটি। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, গত একশ বছরে শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন ভাইরাসের প্যানডেমিক পর্যালোচনা করলে দেখা গেছে, সেসব মহামারি এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। সেই বিবেচনায় হয়তো বলা হচ্ছে যে, এটাই হয়তো করোনার মহামারির শেষ বছর; কিন্তু এখানে অন্য প্রশ্নও রয়েছে। তবে ওমিক্রনের যত মিউটেশন দেখছি তা ততই সংক্রমিত হচ্ছে। যখনই ভাইরাস ব্যাপক সংক্রমণ বেশি থাকে, তখন ভাইরাসের আরও বেশি মিউটেশনের সম্ভাবনা থাকে। তখন হয়তো ভাইরাসটি দুর্বল হয়ে যেতে পারে। আবার শক্তিশালীও হতে পারে। 

টিকার উপকারিতা এবং তার বিরুদ্ধে নানা কথা : কমনওয়েলথ ফান্ডের এক জরিপ অনুযায়ী, শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই করোনাভাইরাসের টিকার কারণে নভেম্বর ২০২১ পর্যন্ত ১ কোটি ৩ লাখ মানুষের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ঠেকানো গেছে এবং মোট ১১ লাখ মানুষের মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল মিলে এরকম আরেকটি হিসাব করেছে। এই দুই সংস্থা দেখিয়েছে, করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া শুরুর পর থেকে ইউরোপের ৩৩টি দেশে ৪ লাখ ৭০ হাজার ষাটোর্ধ্ব মানুষের প্রাণরক্ষা সম্ভব হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই টিকা দেওয়া শুরু করার পর প্রায় এক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা এখন দেখতে পাচ্ছেন যে, টিকা নেওয়ার পরও করোনার বিরুদ্ধে সুরক্ষা চিরস্থায়ী হচ্ছে না। যত সময় যাচ্ছে টিকার সুরক্ষার মাত্রা কমে আসছে। এই মাত্রা কতটা কমবে, তা টিকার ধরন টাইপ এবং টিকা গ্রহণকারীর বয়সের ওপর নির্ভর করছে। এর ফলে তৃতীয় ডোজের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। যারা বয়স্ক এবং যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে গেছে, তাদের জন্য এ কারণেই টিকার তৃতীয় ডোজ বা বুস্টার ডোজ দেওয়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা বা আগেকার সংক্রমণ থেকে পাওয়া সুরক্ষা দৃশ্যত কম কার্যকর। টিকা গ্রহণকারীরা যে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হচ্ছেন, তা আসলে খুবই স্বাভাবিক এবং এ পরিস্থিতি মেনে নিয়েই চলতে হবে।

রাজধানী ঢাকা আবারও করোনার হটস্পট : রাজধানী ঢাকা করোনার হটস্পট হিসেবে পরিচিত আগে থেকেই ছিল। দেশের সর্বোচ্চ মানুষ খুবই ছোট একটি জায়গায় বসবাস করছে বলে এখানে সংক্রমণের হার বেশি; কিন্তু ওমিক্রনে একটু বেশি ভুগছে ঢাকাবাসী। গত ১৭ জানুয়ারি রিপোর্ট অনুসারে, কেবলমাত্র রাজধানীতেই ৪ হাজার ৭৮৯ জন করোনা শনাক্ত হয়েছে, যেখানে সারাদেশে করোনা শনাক্ত ছিল ৬ হাজার ৬৭৬ জন।

গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে করোনা বেড়ে যাওয়ার পর রাজধানীতেই ৮০ থেকে ৮২ শতাংশ করোনা শনাক্ত হচ্ছে। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট খুব বেশি সংক্রামক বলেই এমন হচ্ছে। তা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত ঢাকার কোভিড ঘোষিত হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ, এইচডিইউ বেডগুলো ফাঁকাই রয়েছে। সংক্রমণ বাড়লেও হাসপাতালে আসার সংখ্যা এখনো কম। অর্থাৎ আক্রান্ত হলেও তারা বাড়িতেই থাকতে পারছেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //