পড়তির দিকে ওমিক্রন সংক্রমণ

যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল দ্রুতগতিতে, ঠিক সেভাবেই নেমে যাচ্ছে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন সংক্রমণ। গত বছরের ডিসেম্বরে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টটি বাংলাদেশে শনাক্ত হয়। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রথম শনাক্ত হলেও, শেষ সপ্তাহে বাড়তে শুরু করে। সবশেষে জানুযারির শেষ সপ্তাহে অর্থাৎ ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট শিখরে পৌঁছে। সেদিন একদিনে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ৩৩ জন করোনায় নতুন করে শনাক্ত হয়। এরপর থেকে ওমিক্রন শনাক্ত কমে যাওযার পালা শুরু, এখনো কমছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি একদিনে এক হাজার ৮৯৭ জন শনাক্ত হয়েছে।

নমুনা পরীক্ষার সাপেক্ষে নতুন শনাক্তের হার ছিল ৩.৬৫ শতাংশ। ওমিক্রনের সর্বোচ্চ সংক্রমণের সময় একদিনে শনাক্তের হার ৩২ শতাংশের ওপরে ওঠে। সংক্রমণ কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মনে করা হচ্ছে, বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ আপাতত বাড়ছে না, নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্ট না আসার আগ পর্যন্ত। ফলে করোনার জন্য জারি করা বিধিনিষেধও তুলে নেওয়া হয়েছে। 

সংক্রমণ কমলেও, মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি: করোনা সংক্রমণ কমে যাচ্ছে। তবু আরও অনেক দিন মানতে হবে করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্য বিধি। ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। মুখে মাস্ক পড়তে হবে আরও অনেক দিন। একটি ভাল মাস্ক যে করোনা প্রতিরোধ করে থাকে তাই নয়, মাস্ক আরও অন্যান্য উপকার করে থাকে। বিশেষ করে ধুলোবালির শহরে শ্বাসকষ্টের রোগীদের মাস্ক ভালো সহায়তা করে থাকে। একটি ভালো মাস্ক ধুলোবালি ও অন্যান্য জীবাণুর আণুুবীক্ষণিক কণাকে আটকে মানুষকে সতেজ বায়ু গ্রহণে সহায়তা করে। সে কারণে করোনা না থাকলেও মাস্ক ব্যবহারে মানুষকে অন্যান্য জীবাণু প্রতিরোধেও কার্যকর সহায়তা করতে পারবে। ধুলোবালির রাজধানী ঢাকায় করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আগেও মানুষকে মাস্ক ব্যবহার করতে দেখা গেছে। করোনা সংক্রমণ নিচের দিকে নেমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা গেলেও, সংক্রমণ একেবারেই কমে যাচ্ছে না। করোনা সংক্রমণ কমে যাচ্ছে বলেই, এটা ভাবা উচিত নয় যে, করোনার জীবাণু পরিবেশে নেই। যত দিন দৈনিক করোনা শনাক্ত ১ শতাংশের নিচে নেমে না আসবে, তত দিন করোনাকে বিপদ হিসেবে মেনে নিয়েই স্বাস্থ্য বিধি পালন করে যেতে হবে বলে বলছেন, জনস্বাস্থ্যবিদরা।

ওমিক্রন ছাড়াও বেশ কিছু ভ্যারিয়েন্টের জন্ম হয়েছে: ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ যখন করোনা ভাইরাস প্রথম চিহ্নিত হয় (বাংলাদেশে প্রথম চিহ্নিত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ), তারপর ভাইরাসটির কয়েক হাজার মিউটেশন বা রূপান্তর ঘটেছে। 

মিউটেশনের মাধ্যমে পরিবর্তিত ভাইরাসটিকেই বলা হয় ভ্যারিয়েন্ট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বেশিরভাগ মিউটেশনের ফলে ভাইরাসটির মূল গঠনের ওপর খুব কম বা একেবারে কোনো প্রভাবই পড়ে না। সময়ের সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যায়; কিন্তু কোনো কোনো মিউটেশন এমনভাবে ঘটে, যা ভাইরাসটিকে টিকে থাকতে এবং বংশবৃদ্ধিতে সহায়তা করে। করোনার আদি ভাইরাসের (উহান ভাইরাস) আগে কয়েকটি ভ্যারিয়েন্ট বিশ্বব্যাপী মারাত্মক প্রভাব ফেলে। সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয় এবং মানুষের মৃত্যু ঘটে। ওমিক্রনের আগে করোনার সবচেয়ে মারাত্মক ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নতুন কয়েকটি ভ্যারিয়েন্টের জন্ম হয়েছে। এই ভ্যারিয়েন্টগুলো কয়েকটি দেশে কিছু দিন মানুষকে সংক্রমিত করেছে। এর মধ্যেÑ বিএচ.২ নামে একটি ভ্যারিয়েন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হয়েছে। এর আগে আইএইচইউ বা ইহু নামের করোনার আরেকটি ভ্যারিয়েন্ট কয়েক দিন শনাক্ত হয়েছে, সেই একই ইউরোপ ও আমেরিকায়। নতুন একটি ভ্যারিয়েন্ট ‘নিউকোভ’ চীনে শনাক্ত হয়। ওমিক্রনের পরের এই ভ্যারিয়েন্টগুলো বিস্তার লাভ করতে পারেনি। উল্লেখিত তিনটি ভ্যারিয়েন্টের কোনোটিই ডেল্টার মতো মারাত্মক ছিল না। কিছু দিন জিনোম টেস্টে ভ্যারিয়েন্টগুলোর অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও, পরে আর এসব নতুন ভ্যারিয়েন্টে বিস্তার লাভ করতে পারেনি। আবার ভারতে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের পর ডেল্টা প্লাস নামে আরেকটি ভ্যারিয়েন্টের জন্ম হয়েছিল; কিন্তু এটাও ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। তবে ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, পর্তুগাল, সুইজারল্যান্ড, জাপান, পোল্যান্ড, নেপাল, রাশিয়া ও চীনে; কিন্তু এর আগে প্রথম দিকে যুক্তরাজ্যে আলফা ভ্যারিয়েন্ট, দক্ষিণ আফ্রিকায় বিটা ভ্যারিয়েন্ট এবং ব্রাজিলে গামা ভ্যারিয়েন্ট বেশ কিছুদিন ছড়িয়ে পড়ে। তবে সবচেয়ে বেশি মারাত্মক ছিল ভারতে তৈরি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট।

নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলো কেন ছড়ায়নি: নতুন নতুন অনেকগুলো ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে জিনোম টেস্টে। ডেল্টা ও ওমিক্রন ছাড়া অন্য ভ্যারিয়েন্টগুলো খুব বেশি দেশে এবং বেশি দিন তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেনি। ডেল্টা পৃথিবীকে শাসন করেছে প্রায় এক বছর। অন্যদিকে ওমিক্রন নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছে দুই থেকে তিন মাস। ‘কেন ওমিক্রনসহ অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব স্বল্পকালের জন্য ছিল’ এ প্রশ্নের উত্তরে জনস্বাস্থ্যবিদ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক মোজাহেরুল হক জানিয়েছেন, ‘এটা হয়েছে করোনার বিরুদ্ধে কার্যকর টিকার জন্য। ইতিমধ্যেই পৃথিবীর ১৮৪টি দেশে গত ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক হাজার ৫০ কোটি ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি ৭৫ লাখ (২৭.৫ মিলিয়ন) ডোজ টিকা দেওয়া হচ্ছে। টিকা কোম্পানিগুলো এ পর্যন্ত যে টিকা তৈরি করেছে, সেগুলো ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পর্যন্ত সুরক্ষা দিতে পেরেছে। তবে ওমিক্রনের ব্যাপারে বলা হচ্ছে, এই ভ্যারিয়েন্টটি তার স্পাইক প্রোটিনে ৫০টিরও বেশি পরিবর্তন করেছে বলে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব বেশি নেই; কিন্তু পূর্ণ দুই ডোজ এবং বুস্টার ডোজ নেওয়া হলে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। ফলে দেখা যাচ্ছে, করোনা সংক্রমণ কমে যাওয়া এবং ওমিক্রণ ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব বেশি দিন বজায় না থাকার পেছনে কাজ করেছে করোনার বিরুদ্ধে কার্যকর টিকা।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ১৫ কোটিরও বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ছয় কোটির বেশি মানুষকে দুই ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এসব কারণে বাংলাদেশেও ওমিক্রনের অগ্রগতিকে থামিয়ে দেওয়া গেছে। তবে সরকারকে সামনের দিনগুলোতে সার্ভিলেন্স বা নজরদারীতে রাখতে হবে। করোনার পরীক্ষার কেন্দ্রগুলোকে চালু রাখতে হবে। নিয়মিত জিনোম সিকোয়েন্স করতে হবে নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্ট এসেছে কি-না তা দেখতে এবং যাদের টিকার প্রয়োজন তাদের সবাইকে টিকা দিতে হবে। তাহলেই করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে মনে করেন অধ্যাপক মোজাহেরুল হক। তিনি আরও বলেন, ‘দেখা গেছে, আফ্রিকার দেশগুলো ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশে করোনার টিকা দেওয়ার পরিমাণ সন্তোষজনক। তবে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী মিয়ানমারে টিকা দেওয়ার পরিমাণ খুবই কম। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের কিছুটা যোগাযোগ আছে। আমাদের জন্য মিয়ানমার বিপদের কারণে হতে পারে।’ বাংলাদেশে ব্যাপকহারে টিকাদানের ফলে করোনা আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তি, মৃত্যু এবং জনগোষ্ঠীতে সংক্রমণ কমে যাচ্ছে। এসব কারণে ওমিক্রন বেশি ছড়াতে পারেনি।

ওমিক্রনের পর কী বিপদ সামনে আসছে: লাইভ সায়েন্স জার্নালের তথ্য অনুসারে, ‘ওমিক্রনের পর সামনে আরেকটি ভাইরাস আমাদের জন্য ওৎ পেতে নেই, এমন সম্ভাবনা নাকচ করে দেওয়া যায় না। আসতে পারে তবে এর পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন যে কখন এবং কোথায় নতুন ভ্যারিয়েন্টের জন্ম নেবে।’ ওমিক্রন মানুষের দেহের কোষে থাকা প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ফাঁকি দিয়ে কোষকে আক্রান্ত করে ফেলতে পারার ক্ষমতা অর্জন করেছে; কিন্তু সামনের ভাইরাসটি কি আরও ক্ষমতা নিয়ে আসবে? 

নিউ ইয়র্কের আলবার্ট আইনস্টাইন কলেজ অব মেডিসিনের ভাইরোলজিস্ট প্রফেসর কার্তিক চন্দ্রন লাইভ সায়েন্সকে বলেন, ‘ওমিক্রনের ক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো সংক্রমণ ক্ষমতা এবং একইসঙ্গে কোষে থাকা প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ফাঁকি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার মতো ক্ষমতা সম্পন্ন হতে হবে নতুন কোনো ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্টকে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই যে, করোনা ভাইরাস শেষ হয়ে গেছে। আমি মনে করি, সামনে করোনা ভাইরাসের আরও অনেকগুলো ভ্যারিয়েন্ট মানবজাতিকে দেখতে হতে পারে। সামনে ডেল্টা অথবা ওমিক্রনের মতো এমন নতুন কোনো ঢেউ দেখতে হতে পারে। তবে সামনের ভাইরাসটির সংক্রমণ ক্ষমতা কতটুকু মারাত্মক হতে পারে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //