আট লাখ মানুষের কিডনি বিকল

প্রতিস্থাপনে বিদেশে চলে যাচ্ছে বছরে ৫০০ কোটি টাকা

আট লাখ বিকল কিডনির রোগী রয়েছে দেশে। অপরদিকে দেশের দুই কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে কিডনির জটিলতায় ভুগছেন। শরীরের বিষাক্ত পদার্থ মূত্রের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দেওয়া কিডনির অন্যতম কাজ। রক্ত শুধু পুষ্টিকর পদার্থই নয়, বিষাক্ত পদার্থও পরিবহন করে। কিডনি দিনে ১৭০ লিটার রক্ত পরিশোধন করে।

এ ছাড়া শরীরে পানি ও লবণের ভারসাম্য রক্ষা করে কিডনি। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই অঙ্গটি অচল হয়ে পড়লে, ডায়ালাইসিস ছাড়া জীবন রক্ষার আর কোনো উপায় থাকে না। ডায়ালাইসিস অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি পদ্ধতি। কিডনি নষ্ট হয়ে গেলে প্রতিস্থাপন না করে ডায়ালাইসিস করে সারাজীবন চালানো যায়; কিন্তু ডায়ালাইসিস করতে করতেই একটি পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। 

কেন কিডনি সমস্যা হয় : সাধারণত যাদের দীর্ঘ দিন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, এলার্জিজনিত সমস্যা (চুলকানি) রয়েছে, তারা কিডনি রোগে আক্রান্ত হন। এমনকি কখন কিডনি বিকল হয়ে যায়, তারা জানেন না। কিডনি এমন একটি অঙ্গ, যা ৭০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগে লক্ষ্মণ অথবা উপসর্গ প্রকাশ পায় না। সে কারণে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, বছরে কমপক্ষে একবার করে কিডনি পরীক্ষা করানো উচিত। এ ছাড়া প্রতি মাসে কমপক্ষে একবার করে ডায়াবেটিস ও যাদের নেই সেই বয়স্ক মানুষকে প্রতি মাসে একবার করে উচ্চ রক্তচাপ পরিমাপ করা উচিত। এখন নানা দিবস উপলক্ষে স্বেচ্ছাসেবি সংগঠনগুলো বিনামূল্যেই এই সেবাগুলো দিয়ে থাকে। যাদের সামর্থ্য কম তারা এই সুযোগটি গ্রহণ করতে পারেন। বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। কিডনি সমস্যার সঙ্গে ডায়াবেটিসের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে, কিডনিসহ অন্যান্য রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। বাংলাদেশে দুই কোটির বেশি মানুষ কিডনির নানা জটিলতায় ভুগছেন। এত মানুষ এ সমস্যায় ভুগলেও, চিকিৎসার জন্য নেফ্রলজিস্ট (কিডনি চিকিৎসক) আছেন মাত্র ২৬৩ জন। কিডনি সার্জনের সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা কয়েকজন। 

বছরে ৫০০ কোটি টাকা বিদেশ চলে যাচ্ছে : কিডনি প্রতিস্থাপন অথবা ডায়ালাইসিস কোনোটাই সহজ ও সুলভ না। ফলে বাংলাদেশে বছরে ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে কিডনি সংক্রান্ত রোগে। অপরদিকে প্রতি বছর নতুন করে ৩০ হাজার মানুষের কিডনি বিকল হয়। দেশে কিডনি চিকিৎসা ও প্রতিস্থাপনের জন্য কিছু অভিজ্ঞ সার্জন থাকলেও, আইনি জটিলতায় এত দিন খুবই সীমিতসংখ্যক প্রতিস্থাপন হয়েছে। এ সুযোগে বিদেশি হাসপাতালগুলোর এজেন্টরা বাংলাদেশ থেকে রোগী নিয়ে গেছে অথবা অনেক রোগী স্বেচ্ছায় চলে গেছেন বিদেশে কিডনি প্রতিস্থাপন করতে। অধিকাংশ রোগী পাশের দেশে চলে যান অপেক্ষাকৃত কম দামে প্রতিস্থাপন করা যায় বলে। প্রতি কিডনি প্রতিস্থাপনে সেখানে ব্যয় হয় মাত্র ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা। এ বাবদ আমাদের দেশ থেকে বছরে ৫০০ কোটি টাকার মূল্যমানের বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশে উন্নতমানের চিকিৎসার ব্যবস্থা হলে, খরচ ৫০০ কোটি টাকা থেকে ১০০ কোটি টাকায় নেমে আসবে। 

বিশিষ্ট কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ বলেন, ‘বাংলাদেশে কিডনি সংক্রান্ত একটি আইন হয়েছে। এর আগে আইনি জটিলতায় আমাদের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও, আমরা কিডনি প্রতিস্থাপনে পিছিয়ে ছিলাম। এখন হয়তো এ সমস্যা কেটে যাবে। এখন থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন বাড়বে। 

তিনি আরও বলেন, উন্নত দেশে ৯০ শতাংশের বেশি কিডনি প্রতিস্থাপিত হয় মৃত ব্যক্তির দেহ থেকে কিডনি নিয়ে। নেদারল্যান্ডসের (হল্যান্ড) আইন অনুসারে, মৃত ব্যক্তি রাষ্ট্রের সম্পদ। এমনকি সৌদি আরব ও ইরানের মতো দেশগুলোতে মৃত ব্যক্তির দেহ থেকে কিডনি নিয়ে প্রতিস্থাপন করে মানুষকে বাঁচানো হয়। আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়লে কিডনি দান বাড়বে। এটা হলে কিডনি বিকল রোগীরা বেঁচে থাকতে পারবেন। কিডনি চিকিৎসা বিদেশে করাতে গেলে শুধু যে এ বাবদ সেখানে খরচ হয় তা নয়, সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য কেনা-কাটা করতেও, এখান থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে।’

কিডনি প্রতিস্থাপনে আইন : মানব দেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন করা হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। সে আইনে অল্প কয়েকজন নিকট আত্মীয় ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে কিডনি নেওয়া যেত না। দু’বছর হয়েছে আইনটি সংশোধন করে নতুন একটি আইন হয়েছে। ফলে সামনের দিনগুলোতে কিডনি প্রতিস্থাপন বাড়বে। নতুন আইনে পুত্র, কন্যা, স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা, ভাই-বোন এবং রক্ত সম্পর্কিত আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা ও তাদের স্ত্রী বা স্বামী, চাচাতো ভাই-বোন, ফুফাতো ভাই-বেন, মামাতো ভাই-বোন, খালাতো ভাই-বোন এবং তাদের স্ত্রী বা স্বামী এবং সন্তানাদি কিডনি দান করতে পারবেন। এর বাইরে ব্রেইন ডেথ (আইসিইউ-এ অবস্থানরত এমন রোগী তার পুরো শরীর জীবিত; কিন্তু মস্তিষ্ক কাজ করছে না এমন। এ ধরনের রোগীদের শরীর থেকে মেশিন সরিয়ে ফেললেই রোগী মারা যায়) ঘোষিত ব্যক্তির দেহ থেকে তার আইনানুগ উত্তরাধিকারীদের ইচ্ছানুসাওে কিডনি নেওয়া যাবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোনো মৃত ব্যক্তির দেহ যদি কেউ দাবি না করে থাকে, তাহলেও ওই মৃত ব্যক্তির দেহ থেকে প্রয়োজনীয় অঙ্গ নেওয়া যাবে- এসবই আছে কিডনি সংক্রান্ত নতুন আইনে। বাংলাদেশ থেকে সাধারণত ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর এমনকি পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা গিয়েও কিডনি প্রতিস্থাপন করে আসেন রোগীরা। এ বাবদ প্রতিটি প্রতিস্থাপনের পেছনে ১০ থেকে ৫০ লাখ টাকা ব্যয় হয়। ক্ষেত্র বিশেষে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য দুই কোটি টাকাও ব্যয় হয় যুক্তরাষ্ট অথবা ব্রিটেন গেলে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কিডনি প্রতিস্থাপনে ব্যয় হয় মাত্র আড়াই লাখ টাকা বলে জানিয়েছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ডা. মো: শারফুদ্দিন আহমেদ। কিছু বেসরকারি হাসপাতালও কিডনি প্রতিস্থাপন করে থাকে। সেখানে ব্যয় হয় আড়াই থেকে চার লাখ টাকা। এর মধ্যে শ্যামলীর সিকেডি হাসপাতাল অন্যতম। এই হাসপাতালের কিডনি সার্জন কামরুল ইসলাম কিডনি প্রতিস্থাপনে কোনো চার্জ নেন না। বিনা পারিশ্রমিকেই তিনি কাজটি করেন তাঁর মানবিক দায়বদ্ধতা থেকে।

বিকল কিডনির ডায়ালাইসিস : প্রতিস্থাপন করতে না পারলে প্রতি সপ্তাহে কিডনি ডায়ালাইসিস করেও বেঁচে থাকা যায়; কিন্তু বাংলাদেশে ডায়ালাইসিসও সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নেই। বেঁচে থাকতে হলে সপ্তাহে তিনটি ডায়ালাইসিস করতেই হয়। একটি ডায়ালাইসিসে খরচ হয়ে থাকে কমপক্ষে প্রায় চার হাজার টাকা। তবে অল্প খরচে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, পুরনো সব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট এবং গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করা যায়। নগরীতে সবচেয়ে কম মূল্যে ডায়ালাইসিস করছে মিরপুর রোডের গণস্বাস্থ্য ডায়ালাইসিস সেন্টার। এখানে ১০০টি ডায়ালাইসিস মেশিন আছে। 

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জানান, এখান থেকে অতি দরিদ্র মানুষ বিনা পয়সায় ডায়ালাইসিস করতে পারছেন। দরিদ্র মানুষ এক হাজার একশ’ টাকায় করতে পারেন। এখানে উচ্চ বিত্ত শ্রেণির মানুষ তিন হাজার টাকায় (অথবা তাদের ইচ্ছা মতো এর বেশিও দিতে পারেন, তা দান হিসেবে গ্রহণ করা হবে) ডায়ালাইসিস করতে পারেন। 

তিনি আরও বলেন, আমরা সামনের দিনগুলোতে এখানে কিডনি প্রতিস্থাপন করব সুলভমূল্যে। অতি দরিদ্রদের বিনামূল্যে প্রতিস্থাপন করা হবে। 

মৃত্যুর পর কিডনি দানে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে : মৃত্যুর পর কিডনি দানে উদ্বুদ্ধ করতে আহ্বান জানিয়েছেন অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ। 

তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে আইসিইউ-এ ব্রেইন ডেথ বা ক্লিনিক্যালি ডেথ রোগীদের আত্মীয়-স্বজন। এ জন্য রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের বুঝিয়ে রাজি করতে হবে। বাংলাদেশে এটা অবশ্য সহজ কাজ নয়, অনেক সময় আত্মীয়স্বজন ভেবে বসেন, তার আত্মীয়ের কিডনি নেবার জন্যই সুচিকিৎসা হয়নি, ফলে রোগী মারা গেছেন; কিন্তু মুসলিম বিশ্বের মধ্যে সৌদি আরব, ইরানে সাধারণ মানুষ নিজের ভবিষ্যৎ চিকিৎসা সহজ করতে নিজেরাই স্বেচ্ছায় কিডনি দান করে থাকেন। আবার ব্রেইন ডেথ রোগীদের কিডনি রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানেই সংরক্ষণ করা হয়। সে সব দেশে মৃত মানুষের দেহ রাষ্ট্রের সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশে ক্লিনিক্যালি ডেথ রোগীদের অঙ্গ সংগ্রহ করার আইন রয়েছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই। এটা প্রয়োগে সরকারসহ সচেতন নাগরিককে এগিয়ে আসতে হবে। মৃত্যুর পর কিডনিসহ অন্যান্য অঙ্গ প্রদানের বিষয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //