অ্যান্টিবায়োটিকের আশীর্বাদ হয়ে উঠছে অভিশাপ

প্রয়োজনীয় ওষুধ মানবজীবনকে টিকিয়ে রেখেছে। এই ওষুধই ঠিকমতো প্রয়োগ করা না হলে, ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে। ওষুধের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক মানুষের জন্য আশীর্বাদ।

অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পর মানুষের মধ্যে রোগ-ব্যাধি কমে গেছে এবং মানুষের গড় আয়ু বেড়ে গেছে। উপকারী এই অ্যান্টিবায়োটিক নির্বিচার ব্যবহারের কারণে এটাই এখন মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে উঠেছে। অনেক জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক এখন কাজ করছে না। ফলে জীবাণু বিনাশ করতে না পারায় মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। তা না হলেও মানুষকে রোগে ভুগতে হচ্ছে অনেক দিন।

সে কারণে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, কোনো ওষুধই বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিক নিজে নিজে না খেয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খেতে হবে। তাহলে নিজে যেমন এর সুফল পাবেন, অন্যরাও উপকৃত হবেন। অনাগত বংশধররাও এখনকার ওষুধ থেকে উপকৃত হবে।  

রেজিস্ট্যান্স হয়ে যাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক

নির্বিচার ব্যবহারের কারণে কিছু ব্যাকটিরিয়ার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক নামক অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও উপকারী ওষুধটি অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। এটাকে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বলে। পৃথিবীতে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে গেলে মানব সভ্যতাই টিকে থাকতে পারবে না বলে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা। অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করছে দীর্ঘ দিন থেকে। অতিদ্রুত পৃথিবী থেকে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক নিঃশেষ হয়ে যাবে। বাজারে নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আসছে না। প্রচলিত সব অ্যান্টিবায়োটিকের বেশিরভাগই এখন প্রায় অকার্যকর। যে হারে জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হচ্ছে, সে হারে নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হচ্ছে না। ফলে অচিরেই সংক্রামক রোগ চিকিৎসায় কার্যকর কোনো অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যাবে না। একটা সময় আসবে যখন শরীরের কাটা অংশ শুকাবে না এই ভয়ে চিকিৎসকরা ছোট সার্জারি করতেও সাহস পাবেন না।

বর্তমান ই-কোলি (কলেরার জীবাণু) ও মাইকো-ব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিসের (যক্ষ্মা) মতো কয়েকটি জীবাণু অত্যন্ত ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। মূত্রনালি সংক্রমণ ও যক্ষ্মার জন্য এ দুটি জীবাণু দায়ী। এসব জীবাণুর বিরুদ্ধে ইদানীং কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বিশ্বব্যাপী আধুনিক ওষুধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বিপন্ন করে তুলছে। 

মহাখালীর রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে অন্তত ১৭টির কার্যকারিতা অনেকাংশে কমে গেছে। এসব অ্যান্টিবায়োটিক মূত্রনালির সংক্রমণ, নিউমোনিয়া এবং জখম সারানোসহ নানা ধরনের সংক্রমণের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হতো। 

গবেষকরা বলছেন, শিশু এবং হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রোগীরা এর ফলে মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকবেন। দেশের ৯টি মেডিকেল কলেজের রোগীদের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, গত কয়েক দশকের মধ্যে অন্তত ১৭টি অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। তার মানে হলো, এই ১৭ অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। 

গবেষণায় দেখা গেছে, জীবাণুর মধ্যে ঘা শুকানোর জীবাণু প্রায় ৫৭ শতাংশ প্রচলিত ওষুধ দিয়ে সারানো সম্ভব হচ্ছিল না। চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির কোনো নীতিমালা নেই। কিছু নির্দেশনা থাকলেও, সেগুলো বিক্রেতারা মানেন না এবং ক্রেতারা জানেন না। অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা কমে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে আইসিইউতে থাকা রোগী ও শিশুরা। 

কয়েকটি কারণে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হয়ে থাকে বলে চিকিৎসকরা বলছেন। বিনা প্রেসক্রিপশনে ঘন ঘন অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করলে, পুরো কোর্স শেষ না করে মাঝপথে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া বন্ধ করলে পরবর্তীতে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না অর্থাৎ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হয়ে যায় জীবাণুর বিরুদ্ধে। এ ছাড়া প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্প ডোজের অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হলেও অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হয়ে থাকে। চিকিৎসকরা বলছেন, যেসব ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময় পরে এমনি সেরে যেত এমন ভাইরাসজনিত কোনো অসুখে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হলেও, তা রেজিস্ট্যান্স হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে শিশুদের অ্যান্টিবায়োটিক দিলে।

চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশে বহু মানুষ চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে ফার্মেসিতে গিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে সেবন করেন। পুরো কোর্স সম্পন্ন করতে না পারলে অথবা ঠিক অ্যান্টিবায়োটিকটি না খেলে ওই নির্দিষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হয়ে যেতে পারে। মানুষের পাশাপাশি প্রাণীর ওপরেও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হয়, যা কখনোই পুরোপুরি বিলীন হয় না, মাটিতে রয়ে যায়। ফলে আমরা সবজি, ফল বা মাছ মাংস যা খাই এর মধ্যে থেকে যাওয়া অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে আমাদের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হয়ে থাকে। মুরগি, গরু, ছাগল অসুস্থ হলে এদেরও অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে সুস্থ করা হচ্ছে। তবে এদের যে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। এই বেশি অ্যান্টিবায়োটিক এদের শরীরে থেকে যাচ্ছে।

আমরা যখন মুরগি, গরু কিংবা ছাগলের মাংস খেলে, সেখান থেকে আমাদের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক চলে আসছে। এসব কারণেও প্রচলিত অনেক অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হচ্ছে। আজকাল মাছেও হরমোন ব্যবহার করা হয়, এর অবশিষ্টাংশ আমাদের শরীরে চলে আসছে। ফলে আমাদের শরীরে নানা ধরনের হরমোনাল সমস্যা হচ্ছে হরমোন ভারসাম্যহীন হয়ে যাওয়ার কারণে। তবে শাক-সবজিতে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া না হলেও দেওয়া হয় কীটনাশক। এই বিষ মানুষের কিডনি নষ্ট করে থাকে।

ব্যথানাশকে নষ্ট হচ্ছে কিডনি

চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে যখন-তখন ও দীর্ঘ দিন ব্যথার ওষুধ খেলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শরীরের অতি প্রয়োজনীয় অঙ্গ কিডনি। ফার্মেসি থেকে ব্যথানাশক ওষুধ কিনতে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন লাগে না। কোনো একদিন একটি ব্যথার জন্য কেউ চিকিৎসকের কাছে গিয়ে ওষুধ কিনে নিয়ে সেই যে ব্যথানাশক খাওয়া শুরু করল, তা আর বন্ধ হয় না। কেউ কেউ বছরের পর বছর চালিয়ে দেয়। এতে করে দেহে হয়তো অসহ্য ব্যথা থাকে না; কিন্তু একটা সময় কিডনিতে দেখা দেয় জটিলতা। এমনকি কিডনি অচল হয়ে ডায়ালাইসিসে যেতে হয় বেঁচে থাকার জন্য; কিন্তু ব্যথা সারাতে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধটি খেলে কিডনি দুটি হয়তো নষ্ট হতো না। শরীরে ব্যথা থাকলে উপশমের জন্য ব্যথানাশক দিতেই হবে। চিকিৎসক দীর্ঘ দিন ব্যথার ওষুধ চালিয়ে গেলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে কিডনির কী অবস্থা তাও পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন। ফলে ব্যথার ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শে নিলে তা নিরাপদ। শুধু যে ব্যথার ওষুধ খেলেই কিডনি নষ্ট হয়, তা নয়, নির্বিচারে অ্যান্টিবায়োটিক খেলেও কিডনি অচল হয়ে যেতে পারে।

একজন চিকিৎসকই বুঝতে পারেন কোন রোগে কোন ওষুধ দিতে হবে। চিকিৎসকের কাছ থেকেই ব্যথার ওষুধ খেতে হবে, নিজে নিজে নয়। ব্যথার ওষুধের সঙ্গে গ্যাসের ওষুধ না খেলে পেটে আলসার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কোন ব্যথানাশকে গ্যাসের কোন ওষুধটি ভালো কাজ করবে এবং কি পরিমাণ সেবন করলে ব্যথানাশকেও শরীরের কোনো ক্ষতি হবে না, তাও চিকিৎসকই জানেন। সব ওষুধ সবার দেহে সমান কাজ করে না। একজন চিকিৎসকই নির্ধারণ করে দিতে পারেন কোন ওষুধটি কোন ধরনের রোগীর জন্য প্রযোজ্য।

ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় দেখা দেয় উচ্চ রক্তচাপ 

উচ্চ রক্তচাপের অল্প কিছু কারণ বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন। অধিকাংশ কারণ অজানা। এ জন্য উচ্চ রক্তচাপের কারণ না জেনে ওষুধ সেবন করা উচিত নয়। উচ্চ রক্তচাপ নিরোধক ওষুধ একবার খেলে সারাজীবন চালিয়ে যেতে হয়। উচ্চ রক্তচাপের কারণ অজানা থাকলে অ্যান্টি হাইপারটেনসিভ ওষুধ সেবন করতে হয় সারা জীবন। অনেক সময় স্থূলতা অথবা ডায়াবেটিস হলে উচ্চ রক্তচাপে ভুগতে পারেন কেউ কেউ। কিডনির অসুখের কারণেও উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে। কিডনির ধমনি সংকুচিত হয়ে গেলে কিডনি ফেইল্যুর, কিডনির নিকটস্থ গ্ল্যান্ডে টিউমার হলেও উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে রোগ আবিষ্কার করা সম্ভব হলে, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ সেবন না করে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

শুধু তাই নয়, কিডনি ধমনি সংকোচনজনিত কারণে সৃষ্ট উচ্চ রক্তচাপের সঠিক চিকিৎসা নেওয়া হলে উচ্চ রক্তচাপ শুধু নিয়ন্ত্রণ নয়, তা থেকে মুক্তিও পাওয়া যায়। গর্ভধারণজনিত কারণেও মায়েরা উচ্চ রক্তচাপের শিকার হতে পারেন। নিয়মিত ওষুধ সেবনের ফলে অনেক সময় রক্ত চাপ কমে আসতে পারে। ডায়রিয়া, অধিক বমি এসব কারণেও রক্তচাপ কমে আসতে পারে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধের ডোজ কমিয়ে এনে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। হাইড্রোক্লোরোথায়াজাইড অথবা বিটা ব্লকারের (এটেনোলল) মতো উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ দীর্ঘ দিন সেবন করলে ইরেকটাইল ডিসফাকশনে ভুগতে পারেন যে কোনো পুরুষ। এসব ওষুধে রক্তচাপ দীর্ঘ সময় কম থাকলেও এমনটা হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্ট ব্লক, হাই কোলেস্টেরল, স্থুলতা থাকলেও এসবের চিকিৎসার জন্য ওষুধ খেতে হয়। ওই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ইরেক্টাইল ডিসফাঙ্কশন হয়ে থাকে।

চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেও অনেকের উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই বিষয়টি সুনিশ্চিত করে উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা নিতে হবে। খাবারে অতিরিক্ত লবণতো বটেই, লবণযুক্ত খাবার যেমন শুঁটকি, লোনা ইলিশ, লবণযুক্ত সালাদসহ লবণ রয়েছে যেসব খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //