ঈদযাত্রায় সব পথেই ভোগান্তির শঙ্কা

দরজায় কড়া নাড়ছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। স্বজনদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য বাড়িতে যেতে উদগ্রীব হয়ে বসে আছেন রাজধানীবাসী। ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি। বিগত দুই বছর করোনা মহামারির কারণে অনেকেই বাড়িতে যেতে পারেননি। তাই এবার নাড়ির টানে বাড়িমুখী মানুষের চাপ বেশি থাকবে- তা তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের এক জরিপে। 

গবেষকরা বলছেন, নানা কারণে এবারের ঈদযাত্রা খুব একটা স্বস্তিকর হবে না। ঈদের তিন দিন আগে দেশের পুরো সড়ক ব্যবস্থা ‘কোমায়’ চলে যেতে পারে বলেও শঙ্কা তাদের। কারণ হিসেবে গবেষকরা জানান, আসন্ন ঈদে ঢাকা ছাড়বেন প্রায় ১ কোটি ত্রিশ লাখ মানুষ। ঈদের শেষ চার দিনে সীমিত সড়কে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপের কারণে তৈরি হতে পারে দুর্বিষহ যানজট। এ দিকে এই চার দিনে প্রতিদিন গড়ে ৩০ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়বেন। অথচ দেশের পরিবহন ব্যবস্থায় দিনে ১৬ লাখ যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা রয়েছে। বাকি ১৪ লাখ মানুষকে ঈদযাত্রা করতে হবে ‘বিকল্প উপায়ে’। আর সেই বিকল্প উপায় হলো- বাস, ট্রেন বা লঞ্চের ছাদ বা ট্রাকে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে; অর্থাৎ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এই আনন্দযাত্রা যাতে বেদনাময় না হয় সে জন্য পরিবারের লোকদের আগে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন বুয়েটের দুর্ঘটনা ও গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক হাদিউজ্জামান।

যাত্রীদের অভিযোগ, এসি বাসগুলোর ভাড়া চাওয়া হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ। এছাড়াও ইতিমধ্যেই ঢাকা থেকে বের হওয়ার সব পথগুলোতেই শুরু হয়েছে তীব্র যানজট। সামনের দিনে এটা আরো ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। মহাসড়কে খানাখন্দ, প্রকল্পের নির্মাণকাজ চলমান থাকায় তীব্র যানজটের কারণে যাত্রীসাধারণের ব্যাপক ভোগান্তির আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, করোনা থেকে মুক্তির কারণে এবারের ঈদে প্রায় দ্বিগুণ মানুষ গ্রামের বাড়ি যাবেন। ঈদে ঢাকা থেকে এক কোটির বেশি মানুষ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করবে। এছাড়া এক জেলা থেকে অন্য জেলায় আরো প্রায় ৫ কোটি মানুষ যাতায়াত করতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন বাড়তি নিরাপত্তা, সর্বোচ্চ সতর্কতা, সব পথের প্রতিটি যানবাহনের সর্বোচ্চ ব্যবহার সুনিশ্চিত করা; কিন্তু যানজট ও অব্যবস্থাপনার কারণে গণপরিবহনের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে এবারের ঈদযাত্রায় নারকীয় পরিস্থিতি হতে পারে।

রাজধানী থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াতের প্রবেশদ্বারগুলো বিশেষ করে যাত্রাবাড়ী, সায়দাবাদ, বাবুবাজার ব্রিজ, পোস্তগোলা, টঙ্গী রেলস্টেশন, শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার উড়াল সেতু, মীরের বাজার, উলুখোলা, কাঞ্চন ব্রিজ, গাবতলী মাজার রোড, মীরের বাগ, আশুলিয়া, ইপিজেড, চন্দ্রা, রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতু, জিঞ্জিরা, কেরানীগঞ্জ, হাতিরঝিল, মহাখালী, রামপুরা, আমুলিয়া, ডেমরা, সুলতানা কামাল ব্রিজ, চিটাগাং রোড, কাঁচপুর, মদনপুর, মেঘনা টোল, ভুলতা, গাউছিয়া, বরপাসহ বিভিন্ন স্থানে অসহনীয় যানজটে পড়তে হতে পারে। 

অন্যদিকে বুয়েটের জরিপে বলা হয়েছে, প্রতিদিন ১৬ লাখ যাত্রী স্বাভাবিকভাবেই গণপরিবহনে ঈদযাত্রা করতে পারবেন। এর মধ্যে বাসে ৮ লাখ, ট্রেনে এক লাখ, লঞ্চে ১ লাখ ২৫ হাজার, মোটরসাইকেল ৩ লাখ এবং ব্যক্তিগত গাড়িতে ৩ লাখ মানুষ যেতে পারবে। কিন্তু ১৪ লাখ যাত্রী কোনো যানবাহন পাবেন না। ফলে তারা ‘বিকল্প উপায়ে’ যাবেন।

ঢাকার বাইরে সড়কগুলোতেও পড়তে হবে যানজটের কবলে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ৫টি, ঢাকা-চট্টগ্রাম ৬টি স্থানের যানজটের মুখোমুখি হওয়ার শঙ্কার রয়েছে। আর ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে ঈদে ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তির নাম টঙ্গী সেতু। সেখানে দুই সেতুর একটি নির্মাণাধীন। ফলে যান চলাচল করে বিকল্প সেতু দিয়ে। আর এ কারণে গাজীপুরে প্রবেশ করতেই যানজটে পড়তে হয় বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহ এবং দেশের উত্তরাঞ্চলের যাত্রী সাধারণকে। এ সড়কে দ্বিতীয় বাধা টঙ্গীর স্টেশন রোড। মরকুন, মাজুখান, মীরের বাজার, পুবাইল এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের চেরাগআলী, গাজীপুর ও বোর্ডবাজার এলাকায়ও যানজট তৈরি হয়ে যাত্রী ভোগান্তি চরমে ওঠে।

এ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ঈদের আগে বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ শেষ করা হবে। আগামী ২৫ এপ্রিলের মধ্যে এলেঙ্গার উড়ালসড়ক, নকলা সেতুসহ কয়েকটি প্রকল্পের কাজ শেষ করে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। ঈদ যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে হাইওয়ে পুলিশ, বিআরটিএ বাস মালিক-শ্রমিক নেতাদের সাথে বৈঠক করেছি।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা কার্যালয়ের ডিজিএম শাহ মো. খালেদ নেওয়াজ বলেন, ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা নিশ্চিত করতে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌ রুটে এখন ছোট বড় মিলে ১৯টি ফেরি চলাচল করছে। দ্রুত সময়ে মেরামতে থাকা গোলাম মওলা ও শাপলা যোগ দেবে।

ট্রেনে থাকবে যাত্রীদের চাপ : নিরাপদ যাতায়াতের জন্য অনেকের পছন্দ ট্রেন; কিন্তু এবার সেখানেও যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হতে পারে। সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন করোনার পর ঈদ যাত্রায় এবার ট্রেনে ৫ গুণ বেশি যাত্রী হবে। নির্ধারিত ট্রেন এবং টিকিটের বিপরীতে বিনা টিকিটে যাত্রীর চাপ বেশি থাকবে। অভিযোগ থাকলেও অনলাইন এবং কাউন্টারে টিকিট বিক্রি হবে। আগামী ২৩ এপ্রিল থেকেই শুরু হচ্ছে ঈদ যাত্রার অগ্রিম টিকিট বিক্রি।

রেলওয়ে অপারেশন ও পরিবহন দপ্তর এবং বাণিজ্যিক বিভাগ সূত্রের খবর, বিগত যে কোনো ঈদের চেয়ে এবারের ঈদুল ফিতরে যাত্রীর সংখ্যা হবে ৫ থেকে ৬ গুণ বেশি। বিগত ঈদগুলোতে (২০২০ সালের আগ থেকে) গড়ে ৭ জোড়া ঈদ স্পেশাল ট্রেনসহ ১৫০ থেকে ১৭০টি অতিরিক্ত যাত্রীবাহী কোচ যুক্ত করা হয়েছিল। এবার ৬ জোড়া বিশেষ ট্রেনের সাথে ১০০টি কোচ সংযুক্তের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

বিমানের টিকিট হাওয়া : উচ্চ ও মধ্যবিত্ত অনেকেই এখন আকাশপথে ঈদে বাড়ি ফেরেন; কিন্তু সেখানেও নেই স্বস্তির খবর। ইতিমধ্যে প্রায় সব এয়ারলাইন্সের অগ্রিম টিকিট শেষ। একটি সিন্ডিকেট এসব টিকিট নিজেদের নামে বুকিং করে রাখছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //