দেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা

ভূমিকম্প মোকাবেলায় যথেষ্ট প্রস্তুতি নেই

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভূমিকম্পের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশের অবস্থান ভারত, ইউরেশীয় ও মিয়ানমারের টেকটনিক প্লেটের কাছাকাছি। ঝুঁকিতে থাকার কারণেই মাঝে মধ্যেই হালকা ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে সারাদেশ। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘন ঘন এই হালকা ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পই বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিচ্ছে। এছাড়াও দেশের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাসহ সারাদেশে বহু পুরনো ও অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, নির্মাণ নীতিমালা অনুসরণ না করায় ভূমিকম্প ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়েছে বলেও মনে করেন তারা। এ দিকে এখনো ভূমিকম্পের আগাম পূর্বাভাস পাওয়ার ব্যবস্থা আবিষ্কার হয়নি।

তাই কবে ভূমিকম্প হবে সেই দিন-ক্ষণ সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তবে যে কোনো সময় বড় মাত্রার ভূমিকম্প বাংলাদেশে আঘাত আনবে বলে আশঙ্কা ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানীদের। অন্যদিকে দেশে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও, তা মোকাবেলার জন্য নেই কোনো প্রস্তুতি। এছাড়াও ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রমের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষিত জনবলেরও সংকট রয়েছে বাংলাদেশে। তবে সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, ভূমিকম্প সহনীয় দেশ গড়তে নানা ধরনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সহায়তা পেতে জাপান সরকারের সাথে একটি বড় ধরনের সমঝোতার পথে হাঁটছে সরকার। এছাড়াও স্বেচ্ছাসেবক তৈরি, উন্নত যন্ত্রপাতি কেনার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পাশাপাশি মহড়ার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার কাজও চালিয়ে যাচ্ছে সরকার।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পৃথিবী প্লেট ও সাব-প্লেট দিয়ে গঠিত। এ রকম দুই প্লেটের মধ্যে যে ফাঁকা থাকে তাকে বলা হয় ফল্ট লাইন। প্লেটগুলো গতিশীল থাকে। দুটি চলন্ত প্লেটের ফল্ট লাইনে পরস্পর সংঘর্ষ হলে অথবা হঠাৎ ফল্ট লাইনে শূন্য অবস্থার সৃষ্টি হলে ভূমিকম্প হয়।

ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশ ভারত, ইউরেশীয় ও মিয়ানমারের টেকটনিক প্লেটের কাছাকাছি অবস্থান করছে। এখনো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বড় কোনো ফল্ট চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। তবে বাংলাদেশের বাইরে সীমান্ত সংলগ্ন ফল্ট আছে। ত্রিপুরা, মিজোরাম, ডাউকিতে ফল্ট রয়েছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ভূমিকম্পের বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের উত্তর ও পূর্বাংশের শহরগুলো। রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ এলাকায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি।

২০১৬ সালে নেচার জিওসায়েন্স সাময়িকীকে প্রকাশিত এক গবেষণা মতে, বাংলাদেশসহ ভারত ও মিয়ানমারের কিছু অংশজুড়ে একটি সুবিশাল চ্যুতির (ফল্ট) অবস্থানের কারণে এই এলাকায় রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। এ রকম দুর্যোগে ঢাকাসহ বাংলাদেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও বিপুল প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। ফল্ট এলাকার আশপাশের ১০০ কিলোমিটার এলাকা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রায় ১২ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশের একদল বিজ্ঞানী গবেষণা করে এ তথ্য পেয়েছেন।

তবে ওই সময় এ গবেষণার বিষয়ে কিছুটা দ্বিমত করেছেন বাংলাদেশ ভূমিকম্প সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী। তিনি সে সময় বলেন, এ গবেষণায় যে ফাটলরেখা দেখানো হয়েছে, তার বাইরেও একটা ফাটলরেখা মিয়ানমারের সমান্তরালে চলে গেছে। সেখানে গত কয়েক শতাব্দীতে বড় ধরনের অনেক ভূমিকম্প হয়েছে; কিন্তু এই গবেষণায় যে ফাটলরেখা দেখানো হয়েছে, সেটি বাংলাদেশের প্রায় মাঝ বরাবর চলে গেছে। এই রেখার ওপর অতীতে কোনো বড় ভূমিকম্প হওয়ার তথ্য মেলেনি। 

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে গ্লোবাল আর্থকোয়েক মডেল প্রকাশিত এক গবেষণার বরাত দিয়ে বুয়েটের এই অধ্যাপক আরো বলেন, বাংলাদেশের উত্তরে ভুটান এলাকায় ২৫ কিলোমিটার লম্বা একটি ফাটলরেখা আছে। সেখানে যে কোনো সময় ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে।

নেচার জিওসায়েন্স-এ প্রকাশিত ওই প্রতিবেদন মতে, বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। জলমগ্ন এই নিম্নাঞ্চলে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র এক হয়ে বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ গঠন করে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। এই যৌথ নদীপ্রবাহে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ পলিমাটি জমে। নিরবিচ্ছিন্ন এই পলি-স্তূপের কারণে গাঙ্গেয় বদ্বীপের নিচের ভূপ্রকৃতি ব্যতিক্রমী ধরনের। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, পললভূমির নিচে অবস্থিত টেকটোনিক প্লেটগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ হয়ে থাকে।

ভূত্বকের নিচের অবস্থা জানতে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূপদার্থবিদ মাইকেল স্টেকলারের নেতৃত্বে গবেষক দল বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় অতি-সংবেদনশীল বেশ কিছু জিপিএস যন্ত্র স্থাপন করে। ২০০৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ওই গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকও অংশ নেন। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারেও এ রকম কিছু যন্ত্র বসিয়ে সমগ্র ফল্ট অঞ্চলের একটি মানচিত্র তৈরি করে।

গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমসের (জিপিএস) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, একটি টেকটোনিক প্লেট আরেকটির নিচের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আর সেগুলোর অবস্থান বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও পূর্ব ভারতজুড়ে বিস্তৃত একটি অঞ্চলের নিচে। ফল্টের ওপরের স্তরে দুটি প্লেট পরস্পর লেগে আছে। এতে সৃষ্ট চাপের প্রভাবে প্রচণ্ড শক্তিশালী ভূকম্পন হতে পারে।

এ দিকে ভূমিকম্প মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি অত্যন্ত নাজুক বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকার সাভারের রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৬ জন শ্রমিকের করুণ মৃত্যু হয়। আহত হন আরো কয়েক হাজার শ্রমিক। সরকারের সব সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে পুরো ভবনটি উদ্ধারে সময় লাগে প্রায় এক মাস। এখনো সেই অবস্থা থেকে খুব একটা উন্নতি হয়নি উদ্ধার কার্যক্রমের। তাই ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে শত শত ভবন ধসে পড়লে, তা উদ্ধারে তেমন কিছু করার থাকবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আধুনিক যন্ত্রপাতির সংকট তো রয়েছেই, এর ওপর ঢাকার রাস্তাগুলোর যে অবস্থা, বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে অনেক এলাকায় উদ্ধার কার্যক্রম দূরের কথা, রাস্তার কারণে প্রবেশই করা যাবে না।

ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৫৪৮ সালে সিলেট ও চট্টগ্রামে ভূমিকম্পের ফলে বহু স্থানে মাটি দুই ভাগ হয়ে যায়। ১৬৪২ সালে তীব্র ভূমিকম্পে সিলেট জেলায় মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৬৬৩ সালে আসামে সৃষ্ট আধঘণ্টা স্থায়ী এক ভূমিকম্পে সিলেট জেলা প্রকম্পিত হয়। ১৭৬২ সালের ২ এপ্রিল ভূমিকম্পের ফলে চট্টগ্রামের কাছে ১৫৫ দশমিক ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা স্থায়ীভাবে দেবে যায়। ১৭৭৫ সালের ১০ এপ্রিল ঢাকার আশপাশে তীব্র ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ১৭৮২ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের ফলে গঙ্গা নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে। ১৭৮৭ সালে ভূমিকম্পের ফলে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথেও পরিবর্তন আসে।

১৮১২ সালের ১১ মে সিলেটে প্রচণ্ড এক ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। ১৮৬৯ সালে সিলেটে এক ভূমিকম্পে কয়েকটি ভবনে ফাটল ধরে এবং বহু নদীর তীর দেবে যায়। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ভূমিকম্পে সিলেটের বেশ কিছু দালানকোঠার ব্যাপক ক্ষতি হয়। ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই যে ভূমিকম্প (৭ দশমিক ৬ মাত্রা) হয়, তা শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প নামে পরিচিত। ১৯৯৭ সালের ২২ নভেম্বর চট্টগ্রামে সংঘটিত ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৬। ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে মহেশখালী দ্বীপে সংঘটিত ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ২। তাছাড়া স্মরণকালের মধ্যে বাংলাদেশে যেসব ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল তার মধ্যে ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল ভূমিকম্প, ১৯৩২ সালের উত্তরবঙ্গ ভূমিকম্প, ১৯৩৫ ও ১৯৩৬ সালের মধ্য বাংলার ভূমিকম্প বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশে যে প্রলয়ঙ্করী বন্যা হয়, তা ওই বছরের আগস্টে ভারতের বিহারে সৃষ্ট ভূমিকম্পের জন্য অনেকাংশে দায়ী। সর্বশেষ গত বছরের ২৯ মে দেশের ইতিহাসে প্রথম সিলেটে এক দিনে চার দফা ভূ-কম্পন অনুভূত হয়। আবহাওয়া ও ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তথ্য মতে, ওই দিন সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে রিখটার স্কেলে ৩ মাত্রার, সকাল ১০টা ৫০ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডে ৪ দশমিক ১ মাত্রার, বেলা ১১টা ২৯ মিনিট ৫১ সেকেন্ডে ২ দশমিক ৮ মাত্রার এবং দুপুর ১টা ৫৮ মিনিটে ৪ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এগুলোর উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেটের জৈন্তাপুর ও এর আশপাশে। এর পর দিন ৩০ মে ভোর ৪টা ৩৫ মিনিট ৭ সেকেন্ডে ফের দুই দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন ও ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেন্ট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকিপ্রবণ অঞ্চলে রয়েছে। অতীতে বড় ধরনের ভূমিকম্প বাংলাদেশ ও আশপাশে হয়েছে। তাই ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। বাংলাদেশের আশপাশে ভূমিকম্পের ইপি সেন্টার বা কেন্দ্র আছে। এই কারণে ৭ মাত্রার বেশি ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। তবে এটা কবে হবে, সেটা বলা যাচ্ছে না। আগামীকাল হবে, নাকি ১০০ বছর পরে হবে, না-কি ২০০ বছর পরে হবে- এটা স্টাডির বিষয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //