মুল্লুকে চলো আন্দোলন ও চা শ্রমিক গণহত্যার ১০১ বছর পূর্ণ হয়েছে গতকাল ২০ মে (শুক্রবার)। ঐতিহাসিক বীরত্বগাথা রক্তাক্ত সংগ্রামের এক মহাউপাখ্যান সৃষ্টি করেছিল চা শ্রমিকরা।
সমগীতের আয়োজনে গতকাল বিকেলে রাজধানীর শাহবাগের সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে মুল্লুক চলো আন্দোলনের ১০১ বছর উপলক্ষ্যে এক আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
‘মুল্লুকে চলো আন্দোলনের ১০১ বছর - চা শ্রমিকদের বঞ্চনা ও সংগ্রামের ইতিহাস’ শিরোনামে আলোচনায় বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, শিল্পী কফিল আহমেদ, শিল্পী সংগঠক অমল আকাশ।
ব্রিটিশ চা মালিকেরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ভালো জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে নিজেদের ভূমি ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছিল আসাম-বাংলা অঞ্চলের চা বাগানগুলোতে। কিন্তু বিনিময়ে তারা পেয়েছেন সীমাহীন নির্যাতন নিপীড়ন। এই দুঃসহ জীবন থেকে মুক্তির আশায় আজ থেকে ১০১ বছর আগে অবিভক্ত আসাম-বাংলা অঞ্চলের চা শ্রমিকেরা যখন নিজের ভূমিতে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন, তখন মালিকেরা ফেরার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাদের কাছে রেলের টিকেট বিক্রি করা হয়নি এমনকি রেলে উঠতে ও দেয়া হয়নি।
এরপর তারা রেলপথ ধরে প্রায় ১৭ দিন পায়ে হেঁটে চাঁদপুর জাহাজঘাটায় পৌঁছালে ১৯২১ সালের ২০ মে গভীর রাতে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী শত শত ঘুমন্ত চা শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করে বেয়নেট দিয়ে পেট চিরে মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল। শ্রমিকের রক্তে লাল হয়েছিল মেঘনার ঘোলা জল। এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে অনেকেই ফিরে যেতে পেরেছিলেন নিজের ভূমিতে। কিন্তু যারা থেকে গেছেন এ দেশের জল হাওয়া মাটি আজ তাদেরও।
কিন্তু নানার বৈষম্যের বেড়াজালে ফেলে তাদের বেঁচে থাকার অধিকারকে নানা ভাবে ক্ষুন্ন করা হচ্ছে। এই বঞ্চনার ইতিহাস চলমান।
আলোচনা সভায় অমল আকাশ মুল্লুকে চলো আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। সেইসাথে বর্তমানে চা শ্রমিকদের অবস্থাও তার আলোচনায় উঠে আসে।
তিনি বলেন, এই এতগুলো বছর এখানে জীবন কাটিয়েও তারা এদেশের ভূমিকে নিজের ভূমি ভাবতে পারছে না, কারণ তারা জানে আজকে তার কাজ চলে গেলে কাল সে এই ভূমি থেকে বিতাড়িত হবে। এই ভীতি তার মাঝে সবসময় থাকে। সেখানে কোনো ট্রেড ইউনিয়ন নেই, মজুরি এখনো যেকোনো শ্রমখাতের চেয়ে সর্বনিম্ন।
তিনি আরো বলেন, চা চাষের পদ্ধতি মোটেও প্রকৃতির জন্য, মানুষের জন্য মঙ্গলকর নয়, সেখানে অনেক বেশি কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। এখন সময় এসেছে আমাদের এইগুলো নিয়ে পুনরায় ভাবনার। আর চা শ্রমিকদের ভূমির অধিকার অবশ্যই দিতে হবে। কারণ যেখানে সে শতবছর ধরে কর্ম করে জীবন কাটিয়েছে সেখানে অধিকার তারই। এটাই এখন তার মুল্লুক। আমাদের সবাইকে তাদের এই বঞ্চিত জীবনের দায় নিতে হবে এবং তার ন্যায্য অধিকার দিতে হবে।
আনু মুহাম্মদ এই ঐতিহাসিক আন্দোলনকে নিয়ে আলোচনা আয়োজনের জন্য ও তরুণদের যুক্ত করার জন্য সমগীতকে ধন্যবাদ দিয়ে আলোচনা শুরু করেন।
তিনি বলেন, পুঁজির বিকাশের পেছনে সবসময় ভীষণ নিপীড়ন নির্যাতনের ভয়ংকর ইতিহাস থাকে। যাকে আমাদের সামনে থেকে হারিয়ে ফেলা হয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বিদ্যায়তনেও এগুলোকে ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা থাকে। তিনি সারা পৃথিবীর মাইগ্রেটেড শ্রমিকদের নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেন এবং সর্বপ্রাণের অধিকার আদায়ের গুরুত্ব তুলে ধরেন।
তিনি আরো বলেন, রাষ্টীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যে সব প্রতিষ্ঠান রয়েছে তারা কেবল পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষায় নানা প্রজেক্ট জনগণের সামনে আনে। জনজীবন উন্নয়নের সাথে জড়িত কোনো গবেষণা বা প্রকল্প তারা জনসম্মুখে আনে না। দেশীয় সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে কেমন করে অর্থনৈতিক মানোন্নয়ন সম্ভব বা প্রযুক্তিকে সেই কাজে কীভাবে ব্যবহার করা যায় সেই দিকে নীতিনির্ধারকদের কোনো আগ্রহ নেই।
তিনি চা শ্রমিকদের জীবন মান উন্নয়নে অধিকার আদায়ের চলমান লড়াইয়ের সাথে সংহতি প্রকাশ করেন।
আলোচনা পর্বের শেষে গান পরিবেশন করেন গানের দল সমগীত, লীলা ব্যান্ড ও শিল্পী কফিল আহমেদ।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh