গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা

বর্তমান বিশ্বের সংকটময় পরিস্থিতিতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করলে বিভিন্ন পণ্য ও দ্রব্যের মূল্যস্ফীতি ব্যাপক বেড়ে যাবে। করোনাকালে আয় কমে যাওয়া, দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়া ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়ালে তা মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ে অনেক চাপ বাড়বে। তাই এ সময় জ্বালানির দাম না বাড়িয়ে সরকারকে এ দুই খাতে ভর্তুকি দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

জানা যায়, বিদ্যুতের দাম পাইকারি পর্যায়ে গড়ে প্রায় ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। এই সুপারিশ ও গণশুনানির ভিত্তিতে কমিশন দাম বাড়ানোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। 

বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানো হয় বিদ্যুতের উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) জন্য। পিডিবি গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। 

কারিগরি কমিটি তাদের সুপারিশে বলেছে, ভোক্তা পর্যায়ে দাম না বাড়ালে পাইকারি মূল্যহার কার্যকর করা সম্ভব হবে না। 

বিইআরসির কারিগরি কমিটি যে ৫৮ শতাংশ দাম বাড়ানোর সুপারিশ করেছে, তা জানানো হয় গত ১৮ মে কমিশন আয়োজিত গণশুনানিতে। এর আগে পিডিবি বিদ্যুতের পাইকারি দাম ৬৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ বাড়াতে বিইআরসির কাছে প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে গণশুনানিতে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব ও সুপারিশ তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়ে। 

গত ১২ বছরে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এ সময় পাইকারি পর্যায়ে ১১৮ শতাংশ ও গ্রাহক পর্যায়ে ৯০ শতাংশ বেড়েছে বিদ্যুতের দাম।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই), ব্যবসায়ীদের প্রভাবশালী সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) এবং রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতা ও প্রতিনিধিরা গণশুনানিতে উপস্থিত হয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে কী কী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তা তুলে ধরেন। 

দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে যারা গ্যাস, বিদ্যুতসহ জ্বালানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন, তারা মূলত সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এ প্রস্তাব দিয়েছেন। বৈশ্বিক মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, উৎপাদন উপকরণসহ সব খাতে ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি, মাত্রাতিরিক্ত পরিবহণ ব্যয় ও ব্যবসা পরিচালনার খরচ বৃদ্ধির কারণে বিশ্বের প্রায় সর্বত্র মূল্যস্ফীতির হার দুই সংখ্যার বেশি হওয়ার প্রকোপে জনজীবন বিপর্যস্ত ও আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। 

তিনি আরো বলেন, একদিকে আমাদের রপ্তানি শিল্পে উৎপাদন খরচ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় এবং অন্যদিকে রপ্তানি খাতে বিশ্বব্যাপী চাহিদা হ্রাসের সাথে সাথে মূল্য বৃদ্ধিজনিত বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা প্রকৃত অর্থে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ও বিদেশি মুদ্রা রিজার্ভের ওপরও পড়ছে। আবার সঞ্চয় কমে যাওয়ার ফলে বিনিয়োগ ও ব্যাংকিং খাতের অর্থ প্রবাহে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ উন্নীত হয়েছে। এমন সময় গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ালে সব পণ্যের দাম আরো বৃদ্ধি পাবে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের পরিচালনা দক্ষতা, ন্যূনতম ব্যয় ও বিতরণে আন্তর্জাতিক মান ও কৌশল অনুসরণ করা হয়নি। এছাড়া সরবরাহ ব্যবস্থা বাণিজ্যিকভিত্তিতে পরিচালনা করা হয়নি। 

করোনা ও ইউক্রেন পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি, শিপিং ও পরিবহন ব্যয় অত্যধিক বেড়ে যাওয়ার প্রভাব আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে পড়ছে। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় আমাদের রফতানি খাতের পক্ষে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে দাম না বাড়িয়ে, কৌশলগত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি বিদ্যুৎ-জ্বালানি নিয়ে সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

ক্যাবের সিনিয়র সহসভাপতি এম শামসুল আলম বলেন, উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো হলেও বিদ্যুৎ খাতে পরিকল্পিত উন্নয়ন হয়নি। ফলে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। বসিয়ে বসিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ভাড়া দিতে হচ্ছে। বন্ধ না করে উচ্চ ব্যয়ের ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের (কুইক রেন্টাল) মেয়াদ বারবার বাড়ানো হয়েছে। বেশি দক্ষতার কেন্দ্রের বদলে কম দক্ষতার কেন্দ্রে চালানোয় উৎপাদন খরচ বাড়ছে।

বিইআরসির চেয়ারম্যান আবদুল জলিল বলেন, সবকিছু বিবেচনা করে সবার জন্য সহনশীল সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে, সেটিও দেখা হবে।

জ্বালানি বিভাগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর দ্রব্যমূল্যের বর্তমান উর্ধ্বগতির মধ্যে আবারো গ্যাসের দাম বাড়ালে, এটি সাধারণ মানুষের ওপর যেন চাপ সৃষ্টি না করে, সে বিষয়টি মাথায় রাখা হচ্ছে। এজন্য কতটা সহনশীল রেখে দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়া যায়, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। 

জানতে চাইলে জ্বালানি বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এখন পর্যন্ত বলা হয়েছে আবাসিকে আপাতত দাম বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ আবাসিক গ্রাহকদের ক্ষেত্রে দাম যা ছিল তাই থাকবে। তবে এই সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে নতুনভাবে বিষয়টি চিন্তা করা হবে। 

বিইআরসি সূত্র বলছে, সরকার কী পরিমাণ ভর্তুকি দিতে পারবে। তা জানতে চাওয়া হয়েছে। এটি চূড়ান্ত হয়ে আসলেই ঘোষণা দেওয়া সম্ভব হবে। চলতি অর্থবছরে গ্যাস খাতে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার মতো ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। এই ভর্তুকির অঙ্ক বাড়লে ভোক্তার উপরও চাপ বাড়বে।

জ্বালানি বিভাগ সূত্র বলছে, গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুতের দামও বাড়ার কথা। এছাড়া বাণিজ্যিক ও পরিবহন ব্যয় বাড়বে। আবার শিল্পে দর বাড়লে পণ্যের দামের উপর এর প্রভাব পড়বে। সার্বিক দিক বিবেচনা করলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। ফলে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আগে বিষয়গুলো বিবেচনা করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধিতে জনমনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। গ্যাসের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে। 

বিইআরসির একজন কর্মকর্তা জানান, আমরা সব কিছু গুছিয়ে রেখেছি। অর্থ বিভাগ ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করা হয়েছে। সেখান থেকে সবুজ সংকেত পেলেই গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়া হবে। তবে কত ভাগ দাম বাড়বে তা এখনই বলার সময় আসেনি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //