কাজ করছে না একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক

গুরুত্বপূর্ণ বেশিরভাগ জীবাণুর বিরুদ্ধেই বাংলাদেশে অকার্যকর হয়ে পড়েছে একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক। ফলে জীবাণুর বিরুদ্ধে এরা আর কাজ করতে পারছে না বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। বাংলাদেশে পাওয়া যায় এমন জীবাণুর ৩১ থেকে ৬৭ শতাংশের বিরুদ্ধে একাধিক অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বা অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারিয়েছে। 

গবেষণা বলছে, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত ক্ষতিকর; কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা (রেজিস্ট্যান্ট) অর্জন করেছে এমন জীবাণুসমূহের উপস্থিতি বেশ কিছু নমুনায় পাওয়া গেছে। জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি স্বরূপ এসব জীবাণু খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। তাই জরুরিভিত্তিতে নজরদারি বাড়ানোর মাধ্যমে প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করা খুবই জরুরি বলে গবেষকরা সুপারিশ করেছেন। ৩২টি ল্যাব থেকে ১০ লাখের বেশি কালচার সেনসিটিভিটি রিপোর্ট নিয়ে গবেষণাটি করেছে যৌথভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ক্যাপচুরা নামক আরেকটি প্রতিষ্ঠান। এ অবস্থায় গবেষকরা বলছেন, নির্বিচারে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার বন্ধ না হলে, সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের মানুষকে ভুগতে হবে। তখন জীবাণু সংক্রমণ ঘটলে হাতের কাছেই অ্যান্টিবায়োটিক থাকবে; কিন্তু সেগুলো অকার্যকর বলে সুস্থ না হয়ে অনেকের মৃত্যু হবে।

‘বাংলাদেশে চলমান অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) পরিস্থিতি ও এএমইউ ট্রেন্ডস’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে এই গবেষণা ফলাফলটি গত ১৮ মে প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (ডিজিডিএ), রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ (আইইডিসিআর) কয়েকটি সংস্থার বিভিন্ন গবেষণা তুলে ধরা হয়। ১১টি সরকারি ও ২৩টি বেসরকারিসহ মোট ৩৪টি ল্যাবরেটরি এবং ৫টি বেসরকারি মডেল ফার্মেসি থেকে গত ৪ বছরের অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট এবং ব্যবহারবিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করা হয়। অ্যান্টিবায়োটিক সাসেপ্টবিলিটি টেস্টটিং (এএসটি) ড্যাটাবিষয়ক ১০ লাখের বেশি রোগীর রিপোর্ট চিহ্নিত করা হয়, ডিজিটাল তথ্যে পরিবর্তন, সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে গবেষণায়।

গবেষণা ফলাফলে বলা হয়েছে, ই-কোলাইর মতো ব্যাকটেরিয়া এবং স্ট্যাফাইলোকক্কাস অরিয়াসের সেন্সিটিভিটি প্রবণতা বিগত চার বছরে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত ক্ষতিকর রেজিস্ট্যান্ট জীবাণুসমূহের উপস্থিতি অনেক নমুনায় পাওয়া গেছে। এ সব জীবাণু জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ ও খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আর তাই এগুলো জরুরিভিত্তিতে মনিটরিং জোরদারের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা খুবই জরুরি।

গবেষকেরা জানান, যেসব অ্যান্টিবায়োটিক সতর্কতার সাথে ব্যবহার করা উচিত, সেসবের ব্যবহার বাংলাদেশে প্রায় ৭০ শতাংশ থেকে ৮৮ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, এসব অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার ৪০ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখা উচিত। গবেষণায় অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স কমিয়ে আনতে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ব্যতীত কোনো প্রকার অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রয় ও গ্রহণ বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে। 

অ্যান্টিবায়োটিক বিষয়ক এ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসনের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ জানান, প্রস্তাবিত ওষুধ আইনে, প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করা হলে, বিক্রেতাকে ২০ হাজার টাকা জরিমানাসহ দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করার বিধান রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।

কেন বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে? মূলত চিকিৎসক ও রোগী- উভয়ের অসচেতনতা, অবহেলা ও অজ্ঞতার কারণে বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারাচ্ছে। প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি শিশুদের শরীরেও অকার্যকারিতার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। দুটি পৃথক গবেষণায় দেখা গেছে, ৯ শতাংশ শিশুর মধ্যে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। ৭০ শতাংশ নিউমোনিয়া রোগীর শরীরে কার্যকারিতা হারিয়েছে চার ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক। কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না, এমন রোগীর সংখ্যা ৭ শতাংশ। বাংলাদেশের অ্যান্টিবায়োটিক পরিস্থিতি নিয়ে ‘প্লাস ওয়ান’ নামের একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে এ গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষকরা বলছেন, অপ্রয়োজনীয় সেবনে কার্যকারিতা হারাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক। করোনাকালে এই সমস্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) এক গবেষণায় দেখিয়েছে, করোনার রোগীদের ৮০ শতাংশকেই প্রয়োজন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে। ওষুধের দোকানিরা চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই ওষুধ বিক্রি করছে। শহরের দরিদ্র বস্তি অঞ্চল, নিম্ন আয়ের মানুষ এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে রোগ ভালো করার চেষ্টা করেন।

সাধারণ জ্বর, সর্দি, কাশি, শরীরব্যথা, আমাশয় আক্রান্তরা ওষুধের দোকানের অপ্রশিক্ষিত ব্যক্তির পরামর্শে অথবা নিজের ইচ্ছায় অ্যান্টিবায়োটিক কিনে সেবন করেন। অল্প কয়েকটি ট্যাবলেট খেলেই অসুখের প্রাথমিক লক্ষণ থাকে না বলে তারা অ্যান্টিবায়োটিকের পুরো কোর্স সম্পন্ন করেন না। অনেক সময় ওষুধের দোকানিরা পুরো কোর্স ওষুধ খেতে বললেও রোগীরা আগ্রহী হয় না অর্থাভাব থাকায়। এভাবে অনিরাপদ ব্যবহারে অ্যান্টিবায়োটিককে অকার্যকর করে তোলা হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে   থাকলে ভবিষ্যতে হয়তো দেখা যাবে হাতের কাছে অ্যান্টিবায়োটিক থাকবে কিন্তু তাতে রোগীরা সুস্থ হবে না।

আইইডিসিআরের এক গবেষণায় দেখা যায়, অ্যামোক্সাসিলিন নামের একটি অ্যান্টিবায়োটিক ২০১৭ সালে ২৬ শতাংশ ক্ষেত্রে অকার্যকর ছিল। ২০২১ সালে তা বেড়ে ৩৩ শতাংশ হয়েছে। অ্যাম্পিসিলিন ২০১৭ সালে ৭৩ শতাংশ ক্ষেত্রে অকার্যকর ছিল, এখন তা ৮৬ শতাংশ। এই দুইটি অ্যান্টিবায়োটিক দামে সস্তা বলে যথেচ্ছ ব্যবহার হয়েছে। ফলে এগুলো এখন আর কাজ করছে না। ঢাকার তিনটি হাসপাতালে কোভিডকাল একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে আইইডিসিআর। এতে দেখা যায়, কোনো ধরনের প্রয়োজন ছাড়াই ৮০ শতাংশ রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে আইসিইউতে ভর্তি রোগীর ৮০ থেকে ১০০ শতাংশকে বাধ্যতামূলকভাবে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে। 

একই গবেষণায় বলা হয়েছে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগেই ৩৩ শতাংশ রোগী নিজেই অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করে হাসপাতালে এসেছেন। মহামারিকালে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ে বৈশ্বিক গবেষণার তথ্য তুলে ধরে আইইডিসিআরের গবেষকরা বলেন, মাত্র ৬.৯ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন ছিল।

চট্টগ্রামের একদল গবেষক সম্প্রতি ২০ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা যাচাই করেন। এতে দেখা গেছে, সেফুরোক্সিম, সেফিক্সিম, সেফোট্যাক্সিম ও সেফটাজিডাইম জেনেরিক অ্যান্টিবায়োটিক রোগীর শরীরে কাজ করেছে খুবই কম। সেফুরোক্সিম ৭৮.৯৬ শতাংশ, সেফিক্সিম ৭৬.৯৮ শতাংশ, সেফোট্যাক্সিম ৭৪.৬৯ শতাংশ, সেফটাজিডাইম ৭৪.২৫ শতাংশ, সেফেপাইম ৬৮.২৪ শতাংশ ও সেফট্রিয়াক্সোন ৬৫.৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে অকার্যকর হয়ে গেছে। ওই গবেষণায় আর দেখা যায়, বেশির ভাগ রোগীই অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী বিভিন্ন সংক্রমণে আক্রান্ত হচ্ছেন হাসপাতালের বেসিন, অপরিচ্ছন্ন খাবার, নালার পানি, হাসপাতালের চাদর কিংবা অপরিচ্ছন্ন দেয়াল থেকে। 

আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই কিছু মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করছেন। কেউ কেউ ফুল কোর্স সেবন না করে মাঝপথে বন্ধ করে দিচ্ছেন। আবার কেউবা অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করছেন মাত্রাতিরিক্ত। ওষুধের দোকানদার এ জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী। তবে চিকিৎসকরাও কম দায়ী নন। এসব কারণে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারাচ্ছে।

চট্টগ্রামের ৪০ শতাংশ শিশু অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট। ২০১৮ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের মা ও শিশু হাসপাতাল ও সেভরন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মোট এক হাজার রোগীর উপর একটি গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, চট্টগ্রামের ৪০ শতাংশ নবজাতক ও শিশু অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়ে গেছে। 

অপরদিকে কয়েক বছর আগে আইইডিসিআরের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান ডা. জাকির হোসাইন হাবিব দেশের ৯ মেডিকেল কলেজের রোগীদের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন, দেশে গত কয়েক দশকের মধ্যে অন্তত ১৭টি অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। জীবাণুর মধ্যে ক্ষত সংক্রমণ জীবাণু প্রায় ৫৭ শতাংশকে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে সুস্থ করে তোলা সম্ভব হয়নি। এছাড়া মানুষের মধ্যে ছাড়াও প্রাণীদের অসুস্থতায় উচ্চ ক্ষমতার অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হয়। প্রাণীদের রোগে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক কখনোই পুরোপুরি বিলীন হয় না, মাটিতে মলমুত্র ত্যাগের সাথে মাটিতে মিশে যায়। পরে এগুলো সবজি, ফল বা মাছ-মাংসের মাধ্যমে আমাদের শরীরে চলে যায় এবং অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যায়।

ওষুধ বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, সচেতনতার বিকল্প নেই। এই সচেতনতা দরকার নীতিনির্ধারকদের, স্বাস্থ্য ও ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের, হাসপাতাল ব্যবস্থাপকদের, ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের, চিকিৎসকদের, ওষুধের দোকানদারদের, সর্বোপরি সাধারণ মানুষের।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //