পদ্মা সেতু দিন বদলের হাওয়া

অনির্বাণ আশা, সাহস ও বিশাল কর্মযজ্ঞ শেষে ২৫ জুন চালু হতে যাচ্ছে দেশের বৃহত্তম পদ্মা সেতু। সেই সুবর্ণ ভোরের অপেক্ষায় বাংলাদেশ। তার আগেই অবশ্য গোটা দক্ষিণাঞ্চলের চেহারা বদলে গেছে অনেকখানি।

পায়রা, মোংলা বন্দর, বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র, সাগরকন্যা কুয়াকাটা- সর্বত্র কর্মচাঞ্চল্য এবং পরিবর্তনের হাওয়া। পদ্মা সেতুর বহুমাত্রিক সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সেতুর চেয়েও বড় আয়োজন চলছে দুই পার ঘিরে। বিদ্যমান দুই লেনের সড়ক হয়েছে চার লেন। নির্মাণ করা হয়েছে অত্যাধুনিক, দৃষ্টিনন্দন উড়ালসড়ক। নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে অত্যাধুনিক সুবিধা সংবলিত দেশের সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর, আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র, জাদুঘর আর ব্যাপক পরিসরের গড়ে তোলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র। আর এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের পরই পদ্মাপার পরিণত হবে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। নান্দনিকতা ও আধুনিকতার নিরিখে যে কোনো নগর ও শহরকে পেছনে ফেলবে ওই এলাকা, দেখে মনে হবে- এ যেন বাংলাদেশের ভেতর এক টুকরো সিঙ্গাপুর! 

বিনিয়োগের পসরা : সরকারি হিসাব মতে, পদ্মা সেতুর ফলে প্রতি মাসেই পরিবর্তন হবে দারিদ্র্যের সূচক। বছর শেষে তা দাঁড়াবে শূন্য দশমিক ৮৪ ভাগে। মোট দেশজ উৎপাদনে জিডিপি বাড়বে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত। আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপির অবদান বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। 

‘পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক প্রভাব প্রাক্কলন’ শীর্ষক এক গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের দুই অধ্যাপক ড. বজলুল হক খন্দকার ও ড. সেলিম রায়হান দেখিয়েছেন, সেতুটির কারণে অবহেলিত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পণ্য ও সেবার চাহিদা বাড়বে। সোশ্যাল অ্যাকাউন্টিং ম্যাট্রিক্স (এসএএম) ব্যবহার করে তারা বিশ্লেষণ করে বলেছেন, পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের শস্য ও মাছের চাহিদা বাড়বে ২০ শতাংশ করে। আর ইউটিলিটি সেবা ১০ শতাংশ ও পরিবহন সেবার চাহিদা বাড়বে ৫০ শতাংশ। এর ফলে দেশের মোট শস্য চাহিদা ১০ শতাংশ, মাছের চাহিদা ১০ শতাংশ, ইউটিলিটি সেবা ৫ শতাংশ ও পরিবহন সেবার চাহিদা ২০ শতাংশ বাড়বে।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘পদ্মা সেতুর ফলে দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ সহজ হবে, মানুষের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার হার বাড়বে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে মানুষের মবিলিটি বাড়ে। এক সময় উত্তরবঙ্গের মানুষ কোথাও যেত না। সেখানে মঙ্গা ছিল, অভাব ছিল। এখন রংপুরের মানুষ কাজের খোঁজে চট্টগ্রাম পর্যন্ত চলে যায়। তাদের বহির্মুখী যোগাযোগ বেড়েছে বঙ্গবন্ধু সেতুর কারণে। এবার পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান হবে আর বাড়বে কর্মসংস্থানও।’ 

পদ্মা সেতু ঘিরে এরই মধ্যে বিনিয়োগের পসরা সাজিয়েছেন উদ্যোক্তারা। নদী পাড়ের বিশদ অঞ্চলে শিল্প-কলকারখানার পাশাপাশি অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্ক হবে অচিরেই। সেতু বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পদ্মা সেতুর বহুমুখী কার্যক্রম নিয়ে একটি গবেষণা করে।

ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেতুটিকে ঘিরে নদীর দুপারে ২৯ শতাংশ বাড়বে নির্মাণকাজ, সাড়ে ৯ শতাংশ কৃষিকাজের প্রবৃদ্ধি এবং ৮ শতাংশ বাড়বে উৎপাদন ও পরিবহন খাতের কাজ।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, ‘সেতুটির কল্যাণে একটা নজিরবিহীন সুফল আমরা পেতে যাচ্ছি। দক্ষিণাঞ্চলে অনেকে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবেন। ব্যবসা-বাণিজ্য নতুন করে চালু হবে, সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থানের। অর্থনৈতিক বিভিন্ন সুবিধাও বাড়বে।’ 

পদ্মা সেতু চালু হলে মোংলা ও পায়রা বন্দর ঘিরে অর্থনীতি ও বাণিজ্যে আরো গতি আসবে। চট্টগ্রাম বন্দরের সাথেও কমে আসবে দূরত্ব। যোগাযোগ সুবিধার কারণে বাড়বে ব্যবহারকারীর সংখ্যা। নতুন নতুন শিল্প-কলকারখানা স্থাপনে উদ্যোগী হবেন বিনিয়োগকারীরা। দক্ষিণাঞ্চল হবে অর্থনীতির নতুন কেন্দ্র। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, ভুটান ও নেপালের সাথে সরকারের বাণিজ্যিক চুক্তির ফলে এ সম্ভাবনা আরো কয়েক গুণ বেড়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোকে মোংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে অঞ্চলটি। 

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, পদ্মা সেতু হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই জাহাজ আশা-যাওয়ার সংখ্যা বাড়বে। তাই বাড়তি চাপ সামাল দিতে এরই মধ্যে নেওয়া হয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ। বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ মুসা বলেন, ‘পদ্মা সেতুকে ঘিরে এরই মধ্যে বন্দরে অনেকগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আরেকটা বড় প্রকল্প সড়ক ফোর-সিক্স লেনে উন্নীত করার কাজ বাস্তবায়নাধীন। ড্রেজিংয়ের কাজও চলমান। আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয়েছে, ইতোমধ্যে যার সুফল পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।’

বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব (বোর্ড ও জনসংযোগ) কমান্ডার মো. ফকর উদ্দিন বলেন, ‘পদ্মা সেতুর মাধ্যমে রাজধানীসহ তার আশপাশের ব্যাবসায়ী অঞ্চলগুলোর সাথে মোংলা বন্দরের দূরত্ব কমে যাবে এবং চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে কমবে প্রায় ৮০ কিলোমিটার। কোনো যানজট ছাড়াই খুব অল্প সময়ের মধ্যে মোংলা বন্দরে আমদানি ও রপ্তানিকৃত মালামাল দ্রুত ঢাকায় পৌঁছে যাবে।’

সূচিত হবে কৃষি বিপ্লব : পদ্মা সেতুকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি আশাবাদী প্রান্তিক কৃষক। তারা মনে করেন, সেতুটির কারণে রাজধানীর সাথে যোগাযোগ সহজ ও দ্রুত হবে। সারাদেশের ব্যবসায়ীদের সাথে বাড়বে যোগাযোগ। তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য সরাসরি বিক্রির নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে, মিলবে ন্যায্যমূল্য।

কৃষিবিদের মতে, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, খুলনা, যশোর, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও বরগুনাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কৃষি, মৎস্য, পোলট্রি ও ডেইরি খাতে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। জিডিপি বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় জোগান দেবে ওই অঞ্চলের কৃষি খাত। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক সমীক্ষা মতে, পদ্মা সেতুর কারণে সবচেয়ে বেশি সুবিধা হবে কৃষিজাত পণ্যের বাজারজাতকরণে। কৃষক পাবেন তার পণ্যের সঠিক মূল্য। 

পদ্মা সেতুর দুপাশের তিন জেলা- মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার ৭৫০ জনের সাক্ষাৎকার নেয় আইএমইডি। যেখানে ৯৫ শতাংশ উত্তরদাতাই বলেছেন- পদ্মা সেতু চালু হলে কৃষিজাত পণ্য বাজারজাত করে সঠিক মূল্য পাওয়া যাবে। আর ৯৭ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, কৃষিজাত পণ্য বাজারজাতকরণে পরিবহন সুবিধা হবে। কৃষকদের ভাষ্য, মাদারীপুরে প্রচুর পেঁয়াজ, মসুর ডাল, সরিষা, ধনিয়াসহ বিভিন্ন কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন হয়। পদ্মা সেতু চালু হলে কম সময়ে পণ্য বাজারজাত করা যাবে। কৃষকরা প্রতিদিন সহজে শস্য, সবজি ও মাছ ঢাকায় পাঠাতে পারবেন।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ‘দক্ষিণাঞ্চলকে শস্য উৎপাদনের ভাণ্ডার বলা হয়। প্রমত্তা পদ্মার কারণেই এতদিন দেশের অন্যান্য অংশ থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন ছিল অঞ্চলটি। সেতু চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলের সাপ্লাই চেইনটা সচল হবে।’

পর্যটনে অপার সম্ভাবনা : দক্ষিণাঞ্চলে অনেক পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে, যা ভ্রমণপ্রেমীদের আকৃষ্ট করে। সুন্দরবন, কুয়াকাটা, ষাটগম্বুজ মসজিদের মতো অনেক পর্যটন কেন্দ্র ওই অঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থার কিছুটা সীমাবদ্ধতার কারণে মানুষের কাছে অনাগ্রহের বিষয় ছিল। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে এখন তা নাগালের মধ্যে চলে আসবে। পাশাপাশি পদ্মার দুই পারেও নতুন নতুন স্পট তৈরি হবে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের স্পটে পরিণত হবে পদ্মা সেতু। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সেতুকেন্দ্রিক পর্যটন শিল্প বিকাশের জন্য অনেক পরিকল্পনা নিয়েছে সেতু বিভাগ। ফরিদপুরের ভাঙ্গার চার রাস্তা মোড়ে গোল চত্বরেও নির্মাণ করা হয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় কয়েকটি স্পট। প্রকল্প এলাকার পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য জাদুঘর ও প্রজাপতি পার্ক স্থাপন করা হচ্ছে। চরাঞ্চলে অলিম্পিক ভিলেজ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিটি, হাইটেক পার্কসহ বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। জাজিরার নাওডোবা এলাকায় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে শেখ হাসিনা তাঁত পল্লী গড়ে তোলা হচ্ছে। এখানে আবাসন, শিক্ষা-চিকিৎসাসহ আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা থাকবে। অনেক আধুনিকমানের হোটেল-মোটেল ও রিসোর্ট গড়ে উঠবে।

আছে পেশা বদলেরও দুশ্চিন্তা : সেতু ঘিরে উচ্ছ্বাস থাকলেও পদ্মাপারের হকার ও ভাসমান ব্যবসায়ীরা আছেন পেশা বদলের দুশ্চিন্তায়। যারা জাজিরা শিমুলিয়া ঘাটে ব্যবসা করেন অনেকটা বিনাপুঁজিতে। লঞ্চ কিংবা ফেরিতে ঘুরে ঘুরে যাত্রীদের কাছে কেউ বিক্রি করেন ঝালমুড়ি, ছোলা, সিদ্ধ ডিম, শিঙাড়া, নারকেল চিড়া, শসা, দইসহ নানা রকম মুখরোচক খাবার; আবার কেউ কৃষিপণ্য নিয়েও হকারি করেন। তাদেরই একজন মানিক মিয়া, ভোর থেকে রাত পর্যন্ত নারকেল চিড়া বিক্রি করেন। পদ্মার দুইপাড়ে তার মতো আরো শ-তিনেক লোক এ কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। খরচ বাদ দিয়ে তাদের দৈনিক গড়ে আটশ থেকে হাজার টাকা আয় হয়। তবে অনেকে দেড় থেকে দুই হাজার টাকাও আয় করেন বলে জানিয়েছেন।

মানিক বলেন, ‘ঘাট দিয়ে যাতায়াতকারী যাত্রীরাই আমাদের ক্রেতা। সেতু চালু হলে ঘাট বন্ধ। যাত্রী না থাকলে ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যাবে। তাই বিকল্প কিছুর ব্যবস্থা করতে হবে।’

তবে শিমুলিয়া ঘাটের চায়ের দোকানি রবিউল মনে করেন, ‘সেতু চালু হলেও ব্যবসা চলবে আগের মতোই। কেননা পদ্মা সেতু দেখতে বিপুল পর্যটক আসবে। এখনো দিনে-রাতে সব সময় মানুষ থাকে, সবাই তো যাত্রী না, পর্যটকের সংখ্যাই বেশি।’

আদি পেশা বদল করে তাই মাওয়া-জাজিরার অনেকেই এখন পর্যটনকেন্দ্রিক নতুন ব্যবসা কিংবা অন্য পেশায় আত্মনিয়োগ করছেন বলে জানান রবি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //