কবে হবে নারীবান্ধব পাবলিক টয়লেট

রাজধানীর কারওয়ানবাজারে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন আসমা চৌধুরী জয়িতা। বেশির ভাগ দিনই মিরপুর থেকে অফিস আসতে দীর্ঘ যানজটে পড়তে হয় তাকে। ফেরার পথেও একই হাল। আসা-যাওয়ার এই নিত্য ধকলের মধ্যেই কখনো কখনো প্রয়োজন পড়ে টয়লেটে যাওয়ার; কিন্তু রাজধানীর মতো ব্যস্ত নগরে নেই তেমন নারীবান্ধব পাবলিক টয়লেট। তাই অতিপ্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক কর্মের ডাক এলেও অপেক্ষা করতে হয় বাসা বা অফিস পৌঁছানো পর্যন্ত।

কারওয়ানবাজারের কাঠপট্টি এলাকায় কথা হয় জয়িতার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘শুধু রাজধানী নয়, নারীদের ব্যবহারোপযোগী পাবলিক টয়লেট দেশের কোথাও নেই। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পাবলিক টয়লেটের অভাবও আছে।’ 

রাজধানীর প্রায় সব নারীকে একই ভোগান্তি পোহাতে হয়। জনসংখ্যার তুলনায় ঢাকায় পাবলিক টয়লেটের বেশ অভাব রয়েছে। যেগুলো আছে সেগুলোও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সব সময় অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন হয়ে থাকে। দুর্গন্ধে টেকা যায় না এক মুহূর্তও। বিশেষ করে নারী বা মেয়েদের জন্য এসব পাবলিক টয়লেট মোটেও ব্যবহারোপযোগী নয় বলে অভিযোগ করেন ব্যবহারকারীরা। আবার নারী-পুরুষ একই টয়লেট ব্যবহার করায় অনেকে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন।

একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্রী রুহি। তিনি বলেন, ‘পাবলিক টয়লেটগুলো বেশির ভাগ সময়ই স্বাস্থ্যসম্মত হয় না। অনেক জায়গায় স্যানিটারি ব্যবস্থাও থাকে না। আবার টয়লেটগুলোর ভেতরের চিত্র এত বাজে আর এত দুর্গন্ধ যে, একবার গেলে দ্বিতীয়বার যাওয়ার রুচি হয় না। এটা আমাদের জন্য একটা বড় সমস্যা।’

রাজধানীতে নারীবান্ধব পাবলিক টয়লেটের অপ্রতুলতার কথা স্বীকার করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান বলেন, ‘রাজধানীতে পাবলিক টয়লেটের অপ্রতুলতা তো অবশ্যই আছে। বিশেষ করে নারীদের জন্য এটা খুবই অপ্রতুল। এ ব্যাপারে অস্বীকার করার মতো কিছু নেই। তবে আমরা আমাদের উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান এবং দাতা সংস্থাগুলোর আর্থিক সহায়তায় ইতোমধ্যে বেশ কিছু নারী ও পরিবেশবান্ধব পাবলিক টয়লেট তৈরি করেছি। অনেকগুলো পাবলিক টয়লেটকে ব্যবহার উপযোগী করা হচ্ছে। আমাদের এই প্রক্রিয়া চলমান আছে।’

বেসরকারি সংস্থা ওয়াটার এইড বছর চারেক আগে এক জরিপ চালিয়েছিল। সেই জরিপে দেখা যায় ঢাকায় বসবাসরত ও বহিরাগত মিলিয়ে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ প্রতিদিন চলাচল করে। বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় ১ কোটি হবে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। রাজধানীতে এত সংখ্যক মানুষের জন্য দুই সিটি করপোরেশনের অধীনে সচল পাবলিক টয়লেট আছে মাত্র ৮৬টি।

অপরদিকে বেসরকারি এক জরিপে জানা গেছে, উত্তর সিটি করপোরেশনে ৩৯টি ও দক্ষিণে ৪৭টি শৌচাগার চালু আছে, যা লোকাল কমিটি ও লিজ দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এগুলো সার্ভিস চার্জ দিয়ে পরিচালিত হয়। তবে তাতে নারীদের ব্যবহার ২০ শতাংশেরও কম। প্রায় ২ কোটি মানুষের শহরে দুই সিটি করপোরেশন মিলিয়ে গণশৌচাগারের সংখ্যা প্রায় ৮৬টি সচল থাকলেও নারীদের ব্যবহার উপযোগী হাতে গোনা কয়েকটি। এমনটাই অভিযোগ রাজধানীতে চলাচলকারী নারীদের। যদিও অনেকের আবার অভিমত পরিবেশ ভালো হলেও নারীরা ঘরের বাইরে শৌচাগার ব্যবহার করছেন না। বর্তমানে রাজধানীতে নারীদের ব্যবহারোপযোগী মাত্র ২৬টি টয়লেট রয়েছে। তবে এ অবস্থার পরিবর্তনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ ওয়াটার এইড এবং এফএম ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নারীবান্ধব পাবলিক টয়লেট নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের কাজ শেষ হলে কর্মজীবী নারীরা রাজধানীতে ব্যবহারোপযোগী ২০০টি পাবলিক টয়লেট পাবেন।

ডিএসসিসির মেগা প্রকল্পের পরিচালক ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, ‘নতুন প্রকল্পের আওতায় ৫০টি পাবলিক টয়লেট তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটি করার জন্য ওয়াটার এইডের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের চুক্তি হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি টয়লেট বানানো হয়েছে। বাকিগুলো বানানোর প্রক্রিয়া চলছে। সব মিলিয়ে ২০০টি পাবলিক টয়লেট তৈরি করা হবে।’

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক সীমা মোসলেম বলেন, ‘একটা সময় পাবলিক টয়লেটে  মেয়েরা যাবে এটা ভাবাই যেত না। এখন সেই অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিছু কিছু স্থানে নতুন ঝকঝকে, পরিচ্ছন্ন পাবলিক টয়লেট হয়েছে। সেখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থাও বেশ ভালো।’

উন্নয়ন কর্মী সৈয়দ সাইফুল আলম শোভন বলেন, ঢাকা শহরের মসজিদ, মার্কেটগুলোতে যে টয়লেট আছে, সেখানে নারী-পুরুষ সবার যাওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত। এসব পাবলিক টয়লেট বিনা খরচে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত রাখা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অভিযোগ রয়েছে, রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনই পাবলিক টয়লেটগুলো নিজেরা পরিচালিত না করে বেসরকারি পর্যায়ে ইজারা দিয়ে রেখেছে। সেগুলো ব্যবহার করতে খরচ করতে হয় পাঁচ থেকে দশ টাকা, যা দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষের জন্য অসম্ভবপ্রায়। অন্যদিকে নজরদারিতে না থাকায় ইজারাদাররা বেশি টাকা আয়ের জন্য পাবলিক টয়লেটের পানি বিক্রি করে থাকে। আশপাশের দোকানপাট, গাড়ির গ্যারেজ, টোকাই কিংবা ছিন্নমূল মানুষ হলো এই পানির ক্রেতা। এমনকি টয়লেটগুলো পরিণত হয়ে উঠেছে মাদক ব্যবসায়ীদের লেনদেনের স্থান হিসেবে।

এ বিষয়ে ওয়াটারএইডের প্রকল্প পরিচালক এ বি এম মোবাশ্বের হোসেন বলেন, সিটি করপোরেশনের জায়গায় স্থাপিত টয়লেটগুলো প্রচলিত প্রথায় ইজারা দেওয়া হতো; কিন্তু আমাদের স্থাপিত আধুনিক পাবলিক টয়লেটগুলো ইজারা না দিয়ে দায়িত্বশীল প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরিচালনা করছি। যার ব্যয় মেটানো হয় টয়লেট ব্যবহার থেকে পাওয়া অর্থ থেকে। অর্থ সংকট দেখা দিলে ওয়াটারএইডের তহবিল থেকে তা মেটানো হয়।

পরিবেশবিদদের মতে, ঢাকা শহরের পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য পরিবেশবান্ধব টয়লেট ব্যবস্থার বিকল্প নেই। বিশেষ করে জনবহুল ঢাকা মহানগরীর বিপুলসংখ্যক ভাসমান দরিদ্র মানুষের থাকার কোনো জায়গা নেই। রাষ্ট্রের সব সুবিধা থেকে এ মানুষগুলো বঞ্চিত হয়ে আসছে যুগের পর যুগ। খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ একদিকে যেমন পরিবেশের ক্ষতি করছে, তেমনি নষ্ট হচ্ছে শহরের সৌন্দর্যও।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণশৌচাগারকে আর্থিক আয়ের উৎস হিসেবে না দেখে শুধু নাগরিক সেবা হিসেবে দেখলে অনেকাংশেই নিরাপদ হবে এই শহরে নারীর বিচরণ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //