দেড়শ বছরেও বদলাল না চা-শ্রমিকের মজুরি!

অন্য অনেক ‘দিবস’-এর মতো সম্প্রতি পালিত হলো ‘বিশ্ব চা দিবস’। ২০১৯ সাল থেকে পালিত হচ্ছে দিবসটি। গত ২০ মে ছিল চা শ্রমিকদের নৃশংস গণহত্যা চালানোর ১০২তম বার্ষিকী। আমরা মানবেতিহাসের নৃশংসতম শ্রমিক অত্যাচারের অজস্র কাহিনি শুনেছি।

প্রাচীন মিশরীয় শ্রমিক অত্যাচার থেকে মধ্য যুগের বর্ণবাদ হয়ে আধুনিক কালের হলোকাস্ট দেখেছি। জালিয়ানওয়ালাবাগের নির্মম হত্যাকাণ্ড আমাদের গায়ের লোম খাড়া করে দেয়; কিন্তু ঘুমন্ত নারী-শিশুসমেত কয়েকশ মানুষকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যার দৃশ্য মানসপটে দাঁড়াতে পারে না! মুহূর্তে শিরা-উপশিরা বেয়ে রক্ত চলাচল বাড়িয়ে দেয়। 

১৮৩৯ সালে এই অঞ্চলে চা বাগানের পত্তন হয়। প্রথমে আসামে। পরে সিলেটে, মৌলভীবাজারে, চট্টগ্রাম, রাঙামটিতে। চা বাগানে কাজ করে শ্রমিক ও তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে পাঁচ লাখের মতো মানুষ। তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি অবাঙালি। ব্রিটিশ আমলে চা বাগান শুরু করার পর বাংলাদেশের মানুষদের দিয়ে চা বাগানে কাজ করানো যেত না। জঙ্গল কেটে, মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে কেউ কাজ করতে চাইত না। তাই ব্রিটিশরা বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শ্রমিক ধরে আনল। তারা সাঁওতাল, মুণ্ড, কোল, ভীল, মাহালি, ওঁরাও, খাড়িয়া, কন্দ, মুসহর, রবিদাস, ভূমিজ, উড়িয়া, শীল, নায়েক, রাজপুত, অসমিয়া, ভর, লোহার, ডুকলা, পাইনকা, গঞ্জু, পাল, তাঁতি, বড়াইক, সিং, বাগদী, মাহাতো, তুরী, নিষাদ, দোসাদ, রাজোয়াড়, পাহাড়িয়া, মালো, মালী। এরা কেউ স্বেচ্ছায় আসেনি। তাদেরকে দাস হিসেবে ধরে আনা হয়েছিল। জাতি, গোত্র, বংশ, নাম, পরিচয় সব মুছে চা বাগানে এদের এক নতুন নাম হয় ‘কুলি’। ছনের কুঁড়েঘরে গাদাগাদি করে থাকার ব্যবস্থা। অস্বাস্থ্যকর, অমানবিক ও অসভ্য ব্যবস্থা।

দুর্গম জঙ্গল সাফ করে বাঘ, ভল্লুক, বিষধর সাপ, মশা ও জোঁকসহ নানা বন্যপ্রাণীর কামড়ে মৃত্যুবরণ করে তারা ব্রিটিশ সাহেবদের নতুন পানীয় চায়ের জোগান দিতে থাকল। ব্রিটিশদের জন্য ও তাদের ম্যানেজারদের জন্য তৈরি করল সুদৃশ্য বাংলো; কিন্তু তাদের নিজের ঠাঁই হলো শ্রমিক কলোনির মাটির ঘরে। যে ঘরের নাম ‘কুলি লাইন’। আজ পৌনে দুশ বছর পরও থাকার ব্যস্থার পরিবর্তন হয়নি। তাদের অনেকেই ডায়রিয়া, কলেরা, গুটিবসন্তসহ রোগ-শোকে মারা পড়ল। 

তারা যেহেতু দাস, তাই তাদের থাকা-খাওয়া ছাড়া আর কোনো উপলক্ষ নেই। তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রম যেন কাবু করতে না পারে, সে জন্য দেদার অস্বাস্থ্যকর চোলাই মদের জোগান দেওয়া হতো। সারাদিন গাধার খাটুনি খেটে রাতে মদ গিলে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকত ওরা। বাগান কর্তৃপক্ষ স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে শ্রমিকদের নিয়ে গিয়ে তাদের শ্রমদাস করে ফেলার জন্য একটি চুক্তি করত। চা-বাগানের অশিক্ষিত শ্রমিকরা একে বলত ‘গিরমিন্ট’। বহুদিন পর্যন্ত কোনো মজুরি ছিল না। দেওয়া হতো টোকেন। প্রতিটি বাগানের জন্য আলাদা টি-টোকেন ছিল। বাগানের বাইরে তার কোনো মূল্য ছিল না। এই টোকেন দেখিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতেন চা-শ্রমিকরা। অর্থাৎ বাগানে বেঁধে রাখার সব রকম ব্যবস্থাই ছিল পাকা। এরপর মজুরি হলো প্রথমে ১ পয়সা, পরে ৩ পয়সা।

সরকারি হিসাবেই প্রথম তিন বছরে ৮৪,৯১৫ জন শ্রমিক দাসকে ধরে আনা হয়েছিল তাদের মধ্যে ৩১,৮৭৬ জন পশুর আক্রমণে মারা যায়! এভাবেই জীবন কেটে যায় ভিন্ন সমাজ থেকে আসা ভিন্নভাষী দাস মানুষগুলোর। খাবার জোটে না, মুখে রক্ত তোলা খাটুনি, ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু; ক্রমশ চা শ্রমিকের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ভারতবাসী আন্দোলন করছে। তার আঁচ লাগল চা-শ্রমিকের গায়ে। তারাও সংঘাতে লিপ্ত হলো। বিশ্বযুদ্ধের পর শ্রমিক-মালিক সংঘাত চরমে উঠল। শ্রমিকদের মজুরি বাড়ল না। বাড়ল অত্যাচার, ধর্ষণ, বেত্রাঘাত। তার প্রতিবাদে চা বাগানগুলোতে বিদ্রোহ শুরু হলো। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নির্যাতিত, বাগানে বন্দি চা মজুর স্লোগান তুললেন : মুল্লুক চলো! ফিরে চলো নিজের জন্মস্থানে। শুরু হলো ঐতিহাসিক মুল্লুক চলো আন্দোলন।

ভাবুন একবার! তারা কাউকে মারতে চাইছে না। কাটতে চাইছে না। আগুন জ্বালিয়ে ভস্ম করতে চাইছে না। তীব্র অত্যচার, অবিচার, নৃশংসতা সইতে না পেরে বলছে ‘মুল্লুক চলো’! অর্থাৎ ‘বাড়ি চলো, বাড়ি যাব!’ অথচ তাদের বাড়ি যেতে দেওয়া হলো না। ওরা চলে গেলে চা উৎপাদনের কী হবে? সায়েবদের ঘরে ঘরে মেরুন রঙের পানীয়র কী উপায় হবে? ব্রিটিশ বনেদিয়ানার কী হবে? এমন সস্তা শ্রমিক কোথায় পাবে? আর তাই ব্রিটিশ পুলিশের নির্দেশে শ্রমিকদের ট্রেনে উঠতে দেওয়া হলো না। আটকানো হলো জলপথ; কিন্তু শ্রমিকরা পণ করেছে, ঘরে ফিরবেই। তাই শুরু হলো হাঁটা। করিমগঞ্জ, ধলই, কাছাড় ভ্যালি, ব্রহ্মপুত্র ভ্যালি ও সিলেট ভ্যালির বিভিন্ন চা বাগান থেকে হাজার হাজার চা শ্রমিক রেললাইন ধরে চাঁদপুরের মেঘনা ঘাটের উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করল। তারা জানে চাঁদপুরে পৌঁছতে পারলে স্টিমারে কলকাতা যাওয়া যাবে! কাছাড় ও সিলেটের প্রায় ৩০ হাজার চা-শ্রমিক রেললাইন ধরে দিনের পর দিন হাঁটতে হাঁটতে নদীবন্দর চাঁদপুরে পৌঁছে গেল। রাস্তায় অনেকে মারা গেল অনাহারে, বিনা চিকিৎসায়, অসুখে। তার পরও তাদের হাঁটা থামেনি।

উত্তেজিত মালিকরা চাঁদপুরে ওদের রুখতে চাইল। বাগান কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি ম্যাকফারসন সাহেব হাজির হলো শ্রমিকদের সামনে। সঙ্গে সশস্ত্র সেনা ও পুলিশ। ১৯ মে জাহাজে উঠতে চাওয়া শ্রমিকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সশস্ত্র সৈন্যরা। শুরু হলো বীভৎস নির্যাতন। জাহাজের পাটাতন সরিয়ে দেওয়া হলো। শত শত শিশু, বৃদ্ধ ও নারীসহ বহু শ্রমিক ভেসে গেল মেঘনার জলে। বর্ণনার অতীত সেই হিংস্রতা!

এর পরও শ্রমিকরা দমে যায়নি। স্বজন হারানোর যন্ত্রণা বুকে নিয়েই তারা তখনো বাড়ি ফেরার যুদ্ধ করে চলেছেন। এর পর পরই ঘটল সেই ঐতিহাসিক লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড। ২০ মে ১৯২১, রাতে শ্রমিকদের চাঁদপুর স্টেশন থেকে স্টিমারে গাদাগাদি করে যাত্রা শুরু করার কথা। সন্ধ্যা থেকেই আশপাশের জেলা থেকে বিপুল সংখ্যক পুলিশ এনে স্টেশন ঘিরে ফেলে ব্রিটিশরা। রাতের দিকে সমস্ত রেলকর্মীদের সরিয়ে নেওয়া হলো স্টেশন থেকে। মধ্যরাতে হাজার হাজার শ্রমিক যখন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঘুমিয়ে আছে, তখন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির গুর্খা রেজিমেন্টের সৈন্যরা বেয়নেট দিয়ে নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে শ্রমিকদের খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করল। দুধের শিশু থেকে শুরু করে স্ত্রী, পুরুষ, বৃদ্ধ কাউকে রেহাই দেওয়া হলো না। অসংখ্য শ্রমিককে নদীতে ফেলে হত্যা করা হলো। শত শত লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হলো। 

গণহত্যার পর অবশিষ্ট শ্রমিকদের বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হলো চা বাগানে। আবারও ছুড়ে ফেলা হলো লেবার লাইনের অন্ধকূপে। চক্রাকারে ঘুরতে থাকল বন্দি শ্রমিকদের ঘরে ফেরার স্বপ্ন ঘুড়ি।

এই ঘটনা যদি বিস্ময় হয় তাহলে মহাবিস্ময় হচ্ছে, এত বড় একটা এথনিক ক্লিঞ্জিং হলো, এত এত মানুষের করুণ মৃত্যু হলো, বিশ্বের নৃশংসতার ইতিহাসে প্রথম সারিতে স্থান পেল এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড। অথচ সেই চাঁদপুরে চা-শ্রমিকদের আত্মাহুতির কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই! মৌলভীবাজারে একটা বেঢপ ভাস্কর্য বানিয়ে লিখে রাখা হয়েছে ‘মুল্লুক চলো আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে’।

১৯২১ সালে চা-শ্রমিকদের মজুরি ছিল ব্রিটিশ ১ পয়সা। সে সময়ের নিরিখে ১ স্টার্লিং মানে আজকের ১ পাউন্ড। এক পাউন্ড মানে আজকের ১২০ টাকা। বিস্ময়করভাবে আজকেও চা-শ্রমিকদের মজুরি ১২০ টাকা! তার মানে ১০২ বছরেও চা-শ্রমিকদের মজুরি এক পয়সাও বাড়েনি! এখন যে ১২০ টাকা মজুরি, সেটাও শর্তযুক্ত। ২৩ কেজি পাতা তুলে জমা দিলে ১২০ টাকা পাবে। ১ কেজি কম তুললে ১০ টাকা কমে যাবে। ২ কেজি কমে ২০ টাকা নেই!

তখন ব্রিটিশ ম্যানেজারের রুমে চা-শ্রমিকরা সামনাসামনি ঢুকে দাঁড়াতে পারত না। হাঁটু গেড়ে বসতে হতো। আবার বেরিয়ে আসার সময় পেছন ফেরা যেত না। পেছনে হেঁটে বেরুতে হতো। ব্রিটিশ ম্যানেজার বদলে পাকিস্তানি ম্যানেজার হয়ে আজ বাঙালি ম্যানেজার, অথচ আজও সেই নিয়ম বহাল।

চা-শ্রমিকদের কোনো রাজনৈতিক সংগঠন করতে দেওয়া হয় না। সমিতিও না। কিছু এনজিও কাজ করে। বাংলাদেশের আইন অনুয়ায়ী, এখন চা-শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন। এমনকি হোটেলের অস্থায়ী নাবালক বেয়ারার চেয়েও কম। দেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে সবচেয়ে চটকদার বিজ্ঞাপন চায়ের। চা নিয়ে বাঙালির কাব্যের অন্ত নেই। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে চায়ের ব্লেন্ড এক মাদকতার সৃষ্টি করে। অথচ স্বাধীন দেশের বয়স ৫০ হয়ে গেলেও চা-শ্রমিকদের দাসানুদাস আইডেন্টিটির পরিবর্তন হয়নি।

চাঁদপুর হত্যাকাণ্ডের কোনো ট্রায়াল-বিচার-শাস্তি কিছুই হয়নি। আজও চা-বাগানের ঘন ঝোপের ভেতরে নৃশংসভাবে হত্যা করা মুণ্ডা, কোল, ভীল, মাহালি, ওঁরাও, খাড়িয়া, কন্দ, মুসহর, রবিদাস, ভূমিজ, উড়িয়া, শীল, নায়েক, রাজপুত, অসমিয়া, ভর, লোহার, ডুকলা, পাইনকা, গঞ্জু, পাল, তাঁতি, বড়াইক, সিং, বাগদী, মাহাতো, কৈরী শ্রমিকদের অতৃপ্ত আত্মা কেঁদে ফেরে।

এটা পরিষ্কার; ওই চা-শ্রমিকরা ক্ষমতাহীন, একতাহীন, ভিনদেশি, দেহাতি অবাঙালি হওয়ায় তাদেরকে ব্রিটিশ, পাকিস্তানি ও জাত্যাভিমানী হালের বাঙালি মালিকশ্রেণি মানুষ বলেই গণ্য করেনি। করে না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //