মহাসংকটের আশঙ্কায় গ্যাস

গ্যাস সংকট নিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা অনেক আগে থেকেই সতর্ক করে আসছিলেন। তাদের কথা কানেই নেয়নি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। সম্প্রতি গ্যাস সংকটের কারণে কয়েক দিন ধরেই সারা দেশে ব্যাপক লোডশেডিং হচ্ছে। আমদানিমুখী নীতি পরিহার না করলে পরিস্থিতি আরও অবনতির শঙ্কা করা হচ্ছে। গ্যাস খাতে দেখা দিতে পারে মহাসংকট।

জানা গেছে, গ্যাস ব্যবহার করেই দেশের মোট বিদ্যুতের ৬০ ভাগেরও বেশি উৎপাদন করা হয়। বিদ্যুতে যেখানে ২২শ এমএমসিএফডির মতো চাহিদা, ৪ জুলাই মাত্র ৮৭৯ এমএমসিএফডি সরবরাহ করা হয়েছে। গ্যাস সংকট হলেই তেলের জোগান বাড়ানোর রেওয়াজ পুরনো। আর এখন সেই তেলের বাজারও দিন দিন চলে যাচ্ছে নাগালের বাইরে। যে কারণে আপাতত লোডশেডিংকেই অবলম্বন মনে করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

আন্তর্জাতিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী খন্দকার সালেক সূফী বলেন, পেট্রোবাংলার মতো স্পেশালাইজড প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে এবং বাপেক্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে যদি নন-টেকনিক্যাল লোকদের বসিয়ে রাখা হয়; তার ফল বুঝতে জ্যোতিষী হতে হয় না। সরকারের উচিত হবে নন-টেকনিক্যাল লোকদের সরিয়ে এখনই তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিশেষ কর্মসূচি শুরু করা। না হলে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেন, আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি। এখনই সঠিক পথে না গেলে বিপদ আরও বাড়বে। এখন আর স্বাভাবিক কর্মসূচি দিয়ে কাজ হবে না। বিশেষ ঝটিকা কর্মসূচি পরিচালনা করা দরকার। কিছু ওয়ার্কওভার করতে পারলে, অল্প সময়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।

বদরুল ইমাম সম্প্রতি অনুষ্ঠিত গ্যাসের দাম বৃদ্ধির গণশুনানিতে অংশ নিয়ে বলেন, দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে আন্তর্জাতিক কোম্পানি স্লামবার্জার। ২০১১ সালে দাখিলকৃত রিপোর্টে বলা হয়, বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্রগুলোর সংস্কার করে ৪০০ থেকে ৮০০ এমএমসিএফডি গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এতে খরচ হতে পারে সর্বোচ্চ ১২৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার। ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই রিপোর্ট রয়ে গেছে অন্ধকারে।

যদিও সম্প্রতি ওয়ার্কওভারের মাধ্যমে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এরই মধ্যে কিছু কিছু সাফল্যও এসেছে; কিন্তু এত দিন কেন করা গেল না সেই প্রশ্নের উত্তর মিলছে না কারও কাছেই।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, হঠাৎ করে যদি কয়েকটা কূপ বন্ধ হয়ে যায়, সত্যি একটা জটিল সমস্যার মধ্যে পড়তে হবে আমাদের। তখন আমাদের তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বেশি চালাতে হবে, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রাখতে হবে এবং রেশনিং করতে হবে। তখন একটি জটিল অঙ্ক তৈরি হবে। আমরা একটি অত্যন্ত শোচনীয় জায়গায় অবস্থান করছি। কপাল ভালো হলে ২০২৭-২০২৮ পর্যন্ত গ্যাস পাওয়া যাবে। আর খারাপ হলে দু-এক বছরের মধ্যেই সমস্যা দেখা দিতে পারে।

তিনি আরও বলেন, ২০২২ সালে বিবিয়ানা ড্রাই (গ্যাস শেষ) হবে এটা তো অঙ্ক করে বলা হয়েছে, এটা সবাই জানে। বিবিয়ানাতে আর বেশি গ্যাস থাকার কথা না। কতটা রিজার্ভ ছিল আর কতটা উত্তোলন করা হয়েছে, সে হিসেব করলেই তো ফল বের হয়। তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাস অনেক আগেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা, ওখানে আমরা বুঝে শুনে কাজটি করছি। বিবিয়ানাতে তো বিদেশিদের হাতে যত বেশি উৎপাদন, তত লাভ। অতিরিক্ত উৎপাদন করে বাখরাবাদের কূপগুলোকে নষ্ট করা হয়েছে।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স ও সিলেট গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাসের প্রতি ঘনমিটারের গড় ক্রয়মূল্য পড়ছে ১.২৬ টাকা, বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন থেকে ২.৮৯ টাকা, তাল্লো থেকে ৩.১০ টাকা দরে কেনা হচ্ছে। অন্যদিকে এলএনজির ক্রয়মূল্য ৩৬.৬৯ টাকা অন্যান্য চার্জ দিয়ে ৫০.৩৮ টাকা পড়ছে।

বর্তমানের চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিদিনই রেশনিং করতে হচ্ছে। তারপরও ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। সংকট সামাল দিতে গিয়ে অনেক গ্যাসক্ষেত্র থেকে অত্যন্ত ঝূঁকিপূর্ণভাবে বাড়তি গ্যাস উৎপাদনের পথ বেছে নিয়েছে। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উৎপাদন দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। সিলেট গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন ক্ষমতা অর্ধেকে নেমে এসেছে। আগে ১৪৯ এমএমসিএফডি উৎপাদন ক্ষমতা থাকলেও কমবেশি ৮৬ এমএমসিএফডি গ্যাস উত্তোলন হচ্ছে। এক সময় বাংলাদেশ সবগুলো গ্যাসক্ষেত্র থেকে ২৭০০ এমএমসিএফডি পর্যন্ত উৎপাদন করেছে। ৪ এপ্রিল উৎপাদন করেছে মাত্র ২৩শ এমএমসিএফডি। ২০২৩ সাল নাগাদ গ্যাস উৎপাদনে বড় ধরনের ধস নামতে পারে বলে শঙ্কা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে ২৮টি গ্যাসফিল্ড আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব ফিল্ডে প্রমাণিত মজুদের পরিমাণ ২১ দশমিক ৪ টিসিএফ, আরও ৬ টিসিএফ রয়েছে সম্ভাব্য মজুদ ধারণা করা হয়। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ১৮ টিসিএফ উত্তোলন করা হয়েছে। সে হিসাবে প্রমাণিত মজুদ অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র ৩ টিসিএফ, আর সম্ভাব্য মজুদ রয়েছে আরও ৭ টিএসএফের মতো। প্রতিবছর প্রায় ১ টিসিএফের মতো গ্যাস উত্তোলিত হচ্ছে। এতে প্রমাণিত মজুদ ২০২৪ সালে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। অন্যদিকে দ্রুত শিল্পায়ন ও ঘরে ঘরে বিদ্যুতের কারণে গ্যাসের চাহিদাও প্রতিবছর বেড়ে যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী খন্দকার সালেক সূফী বলেন, ‘যদি যথাযথভাবে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যেত, তাহলে আজকে এই সংকট হতো না। আমি মনে করি, পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। সবচেয়ে বড় গ্যাস ফিল্ড বিবিয়ানার রিজার্ভ কমে আসছে। এখানে যে কোনো সময় উৎপাদনে ধস নামতে পারে। আমরা কয়েক বছর ধরেই বলে আসছি; কিন্তু কানেই নেওয়া হয়নি। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের চেয়ে আমদানিতে বেশি মনোযোগ দেখা গেছে।’

এদিকে কয়েক বছর ধরেই গ্যাস সংকটের কথা উঠলেই আমদানির কথা বলে আসছে পেট্রোবাংলা। আমদানিকে যেভাবে সামনে আনা হয়েছে বাস্তবতা মোটেই অনুকূলে নয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এফএসআরইউ (ফ্লোটিং স্টোরেজ রি-গ্যাসিফিকেশন ইউনিট) ১ হাজার এমএমসিএফডি এলএনজি আমদানি করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। এই এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা ছিল ২০১৪ সালে। বাস্তবায়ন হতে আর ৫ বছর বেশি সময় লেগে যায়।

২০১৮ সালের আগস্টে প্রথম ইউনিট ৫০০ এমএমসিএফডি আনতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয় ইউনিট এসেছে ২০১৯ সালের এপ্রিলে। সাগর উত্তাল হলেই সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। এলএনজি আমদানি বাড়াতে মাতারবাড়ীতে ১ হাজার এমএমসিএফডি ক্ষমতা সম্পন্ন ল্যান্ডবেজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা। এখনো টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করা যায়নি।

অন্যদিকে মাতারবাড়ীতে ও পায়রাতে পৃথক দুটি এফএসআরইউ স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সেগুলোও এখন কাগজে সীমাবদ্ধ। চুক্তির পর ১৮ মাসের অধিক সময় প্রয়োজন পড়বে। অর্থাৎ ঘাটতি বেড়ে গেলেও বাড়তি এলএনজি আমদানির পথ প্রায় বন্ধ। এর সঙ্গে রয়েছে অস্থিতিশীল আন্তর্জাতিক বাজার দরের ইস্যু। যার ফল আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেতে শুরু করেছি।

জ্বালানি বিভাগ যখন বেহাল, তখন বিদ্যুৎ বিভাগ নতুন নতুন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়ন করে চলেছে। ২০১৬ সালের রিভাইস মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে ১১৮৮ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র যুক্ত হওয়ার কথা। গ্যাসের ঘাটতি মোকাবেলায় আরেকটি ভালো উপায় হতে পারত দেশীয় কয়লার বিশাল মজুদ; কিন্তু সেই ট্রেন মিস করেছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য (গ্যাস) মকবুল ই ইলাহী চৌধুরী বলেন, আমরা এখন যেভাবে আমদানি-নির্ভরতার দিকে যাচ্ছি, ২০৩০ সালে ২৫-৩০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে জ্বালানি আমদানিতে। ফরেন রিজার্ভের সিংহভাগ যদি জ্বালানিতে ব্যয় করি, তাহলে উন্নত দেশে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। দেশে গ্যাসের সম্ভাবনা নেই যাদের এই দর্শনে বিশ্বাস রয়েছে, তারা দয়া করে রাস্তাটা ছেড়ে দেন। জরুরিভিত্তিতে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোর সংস্কার করে উৎপাদন বৃদ্ধি করা উচিত।

বাংলাদেশ ভূখণ্ডে স্বাধীনতার পর মাত্র ৬৮টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে, ত্রিপুরা তার স্বল্প আয়তনে কূপ খনন করেছে ১৬০টি। ত্রিপুরা ১৬০টি কূপ খনন করে মাত্র ১১টি গ্যাসফিল্ড আবিষ্কার করেছে। বাংলাদেশ গত ১১০ বছরে মাত্র ৯৫টি কূপ খননের মাধ্যমে ২৮টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে। বাংলাদেশের সফলতার হার উচ্চ হলেও এখন তিমিরেই রয়ে গেছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান। ১৯৯৫ সালের জ্বালানি নীতিমালায় বছরে ৪টি অনুসন্ধান কূপ খননের কথা বলা হলেও কোনো সরকারেই তা মেনে চলেনি। বিশাল সমুদ্রসীমা অর্জন করলেও সেখানে কোনো কাজ করা যায়নি। সাগরে পিএসসি (উৎপাদন বণ্টন চুক্তি) আহ্বান করা হলে আগ্রহ দেখাচ্ছে না বিদেশি কোম্পানিগুলো।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //